ঢাকা, ৬ জুন ২০২৩, মঙ্গলবার, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৬ জিলক্বদ ১৪৪৪ হিঃ

মত-মতান্তর

ওষুধ শিল্পের সমসাময়িক অবস্থান, সমৃদ্ধি ও সম্ভাবনা

মিনা বুলবুল হোসাইন

(৯ মাস আগে) ২০ আগস্ট ২০২২, শনিবার, ৯:২০ অপরাহ্ন

mzamin

লাভজনক বিনিয়োগের নতুন দিগন্ত চিকিৎসাসেবার একটি আবশ্যিক অনুষঙ্গ ওষুধ উৎপাদন যেকোন বিচারেই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এই অসাধারণ পণ্যটির সঙ্গে মানুষের জীবন সরাসরি সম্পৃক্ত। মানুষের অসুস্থতায় পরিত্রাণ এবং আশঙ্কা ও অস্থিরতা নিরসনে মানুষের সুস্থতা ও স্বচ্ছলতা নিশ্চিতকরণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভুমিকা রাখে ওষুধ। তাইতো বর্তমান দুনিয়ায় ওষুধ অন্যতম বৃহত্তম এবং লাভজনক শিল্প। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প অত্যন্ত সম্ভাবনাময় উদীয়মান শিল্পখাত হিসেবে চিহিৃত। যা দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে।অনেক সংকটের মধ্য দিয়েও এই শিল্পের সুস্থ বিকাশ ও মানসম্মত উৎপাদনশীলতার জন্য যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে, আন্তর্জাতিক মান অর্জনে সক্ষম হয়েছে। জীবন বাঁচায় যে পণ্য সেই শিল্পের সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দাপটের সঙ্গে টিকে আছে। দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে শক্তিশালীকরণে এই সেক্টরে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখা খুবই জরুরি।

বর্তমানে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্পে আমদানিকারক দেশের পরিবর্তে রপ্তানিকারক দেশের গৌরব অর্জন করেছে। বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যা অভ্যন্তরীণ প্রয়োজন মেটানোর পর রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করছে। বর্তমানে দেশের মোট চাহিদার ৯৭ শতাংশ ওষুধ দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন
অথচ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ৯৬ শতাংশ ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্যএশিয়াসহ প্রায় ৮০টি দেশে ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। বর্তমান বাংলাদেশে এই শিল্প রপ্তানির দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন গার্মেন্টস শিল্পের আয়কে এই শিল্প ছাড়িয়ে যাবে।

স্বাস্থ্য মানুষের উন্নয়ন পরিমাপের একটি বিশ্বজনীন সূচক এই মানদণ্ডে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হল জাতীয় ওষুধনীতি।  ১৯৮২ সালে কার্যকর হওয়া এই নীতির উদ্দেশ্য বাজার থেকে ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধ অপসারণ করে সকল ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ওষুধের ন্যায্যমূল্যে প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। এই নীতির ফলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প বিকাশ লাভ করেছে।

বাংলাদেশে দ্রুততম ক্রমবর্ধমান সেক্টর এই ওষুধ শিল্পের মতো সংবেধনশীল শিল্পে যে অগ্রগতি অর্জন করেছে তা বিস্ময়কর ও প্রশংসার দাবিদার। দেশের ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো দেশের ৯৭শতাংশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে সক্ষম। এছাড়া আজ বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালস শিল্প সাফল্যের সাথে APIs রপ্তানি করছে। বাংলাদেশ এর সাথে রপ্তানি করছে উচ্চ কারিগরি সম্পন্ন HFA Inhalers, CFC Inhalers, Suppositories, Nasal Sprays, Injectables, IV Infusions, Cancer ও Biotech related medicine ইত্যাদি। বাংলাদেশের বেশ কিছু ওষুধ কোম্পানি UKMHRA, EU, TGA, Australia এবং CGMP সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য প্রক্রিয়াধীন।

খুবই উন্নত প্রযুক্তির ওষুধ ছাড়া প্রয়োজনীয় প্রায় সকল প্রকার ওষুধ বর্তমানে বাংলাদেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। বড় পরিসরে বলতে গেলে বর্তমান বাংলাদেশে ৫ হাজার ব্রান্ডের ৮ হাজারেরও বেশি ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে।

ফার্মাসিউটিক্যালসের সকল ধরনের প্রোডাক্ট ডাক্তার, ওষুধ বিক্রেতা ও ক্রেতাদের আস্থা অর্জনে করতে সক্ষম হলে তা বিনিয়োগকারীর ব্যাপক লাভের অমিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে।  মানবসেবার মহান ব্রত ছাড়া শুধু অর্থনৈতিক লাভ কিংবা নিছক ব্যবসায়িক স্বার্থকে কেন্দ্র করে চলাটা কাংখিত নয়। ওষুধ শিল্পদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ইতিবাচকবোধ এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার অপরিহার্য ক্ষমতা, আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সৃজনশীলতায় নতুনত্ব আর রুচিশীলতায় এগিয়ে থাকার পরিকল্পিত প্রয়াস দ্রুততর এই শিল্পের বিস্তৃতি লাভকে সহজ করে।

ওষুধ শিল্পে বিনিয়োগকারীরা ইতিমধ্যেই লাভজনক প্রতিষ্ঠানের গর্বিত মালিক হতে পেরেছেন।  উন্নয়নশীল এই দেশটির স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে জাতীয় অগ্রগতিতে অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখার পাশাপাশি লাভবান হবার নিশ্চয়তাই বিনিয়োগকারীকে আকৃষ্ট করে। ভাল উদ্যোগকে অর্থবহ ও স্বার্থক করে তুলে নিজেও লাভবান হওয়া যায়। নিজে ভাল থাকা, অন্যকেও ভাল থাকতে দেয়া, অপরকে সহযোগিতা করা, নিজেরও কল্যাণ নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা থাকা দরকার।

ওষুধ শিল্পের সাথে জড়িতদের WHO কর্তৃক আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ওষুধ তৈরির উত্তম পদ্ধতি CGMP (Current Good Manufacturing Practices) এর নির্দেশনাসমূহ অনুসরণ অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। ওষুধ কোম্পানির আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএফপিএমএ ((International Federation of Pharmaceuticals Manufactories Association)) এর নির্দেশনার ব্যাপারেও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। WHO এর Ethical Criteria for Medical Drug Promotion শীর্ষক সিদ্ধান্তের ব্যাপারেও পূর্ণ মনোযোগ থাকতে হবে।

ওষুধের কাঁচামলের বেশিরভাগ প্রায় ৭০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কাঁচামাল দেশেই তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। নতুন নতুন ওষুধ আবিস্কারে আমাদের মৌলিক গবেষণার দিকেও নজর দেয়া দরকার।

স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে WTO নীতিমালা অনুযায়ী ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য প্যাটেন্ট ড্রাগ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কোন ধরণের রয়েলিটি আরোপ করা হয়নি। দ্রুত এপিআই শিল্প পার্ক স্থাপন করা হলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পখাত আগামী ৫ বছরে তৈরি পোশাক শিল্পের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হবে।

সমগ্র বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৪৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ভেষজ উদ্ভিদের চাহিদা রয়েছে। সুতরাং এলোপ্যাথিক ওষুধের পাশাপাশি ভেষজ ওষুধ তৈরিও করা যায়। দেশের বেশির ভাগ মানুষ গরীব হওয়ায় বেশি দামে ওষুধ ক্রয় করা সম্ভবপর হয় না। পুরো ডোজ শেষ না করেই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেয়। ওষুধের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা দরকার। ওষুধ শিল্পের অধিকাংশ কাঁচামাল দেশেই উৎপাদন করা সম্ভব হলে মানবতার কল্যাণে এ শিল্পের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যেত।

উৎপাদিত ওষুধের মূল্য সংযোজন এবং জেনেরিক প্রোডাক্ট উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ওষুধের আন্তর্জাতিক বাজার দখল করতে পারে। বর্তমান বিশ্বে ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওষুধের বাজার রয়েছে। ভারত ও চীন চুক্তিবদ্ধ উৎপাদনের মাধ্যমে বিশাল অংকের ওষুধ রপ্তানি করলেও আভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির কারণে তাদের রপ্তানির সুযোগ সীমিত হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এ সুযোগ লুফে নিতে পারে।

জনগণের উন্নত পরিসেবার মানসে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেই সুলভমূল্যে উচ্চমানের ওষুধ সরবরাহ এবং ওষুধের উপাদানগুলো যথাযথ মাত্রায় রাখা সম্ভব।  শুধু অধিক মুনাফার মাধ্যমে বাণিজ্যিক স্বার্থ হাসিল নয়, মারাত্বক রোগব্যাধির শিকার হয়ে প্রাণশক্তির নি:শেষ বন্ধ করার প্রয়াসে নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টার অংশ হলে তা নি:সন্দেহে প্রশংসনীয় এবং এক্ষেত্রে ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা অপরিসীম। ফার্মাসিস্টদের অগ্রগতির জন্য জাতীয় সংগঠন গঠন করা খুবই জরুরি এবং তারাই ওষুধ নীতি প্রণয়নে সহযোগিতার অংশ হিসেবে কাজ করবে, এডভাইজরি বোর্ডে থাকবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি, কেমিস্ট্রি, অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি ও মেডিসিনাল কেমিস্ট্রি বিভাগের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ ও সাইন্টিস্টরা। সুস্বাস্থ্যবান জাতি গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ থাকলেই সাধারণ ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ সম্ভব।

বিশ্বায়নের এই যুগে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে  ওষুধ শিল্প একটি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। তাই দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ওষুধ বেচাকেনায় যোগ দিতে পণ্যের সর্বোচ্চ মান নিয়ন্ত্রণ রপ্তানির পূর্বশর্ত। তাই পণ্য গুণে ও মানে এমন হবে যে, প্রচারে ও প্রসারে বাংলাদেশ থাকবে সামনের সারিতে। বিদেশে এদেশের ওষুধের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য এর গুণগতমান পরীক্ষার পদ্ধতি অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার, নেপাল, ভূটানসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশ এখনও বেশীর ভাগ ওষুধ আমদানি করে অথচ ৮০টিরও অধিক দেশে প্রধান চিকিৎসামূলক ডোজ, ট্যাবলেট, ক্যাপসুল ও সিরাপ ওষুধ রপ্তানি হয়।

চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পকে বিদেশে উপস্থাপন করতে ওষুধ শিল্প প্রদর্শনী মেলা বেশি বেশি করা জরুরি। চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ওষুধে ভেজাল থাকার কারণে অনেক রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে এসকল ব্যাপারে সংশিস্নষ্টদের সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে।

দিনে দিনে ওষুধের জন্য ব্যয় বাড়ছে। ওষুধ কেনার ক্ষমতা সবার সমান নয়, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে বিরাট এক বৈষম্য। উন্নত দেশগুলো উৎপাদিত ওষধের ৮৬ শতাংশ ব্যবহার করে, যেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলো ব্যবহার করে ১৪ শতাংশ ওষুধ। অথচ জনসংখ্যার মাত্র ২৫ শতাংশ মানুষ বসবাস করে উন্নত দেশে আর ৭৫ শতাংশ বাস করে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে।

ওষুধ শিল্পের মতো একটি জীবন রক্ষাকারী পণ্যে ভেজাল কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আমাদের উৎপাদিত ওষুধ খেয়ে শিশু মৃত্যুর ঘটনায় দেশে-বিদেশে আমাদের বিভিন্ন সময়ে ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে যা একেবারেই কাম্য নয়।

পৃথিবীতে যে তিনটি ব্যবসা সবচেয়ে বেশী অর্থ এনে দেয় তার মধ্যে ওষুধ সর্বোত্তম। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতেও এটি নি:সন্দেহে বলা যায় যে, বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি শিল্পের ভবিষ্যৎ অনেক উজ্জল। স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম উপকরণ। ওষুধ মানব কল্যাণে বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় অবদান। আলেকজান্ডার ফ্লেমিং আবিস্কৃত পেনিসিলিন কিংবা গুটি বসন্ত, পোলিওসহ বিভিন্ন রোগের টিকা অথবা আমাদের আইসিডিডিআরবি আবিস্কৃত খাবার স্যালাইন পৃথিবীর কোটি মানুষের প্রাণ রক্ষা করছে। সবচেয়ে জনপ্রিয়, দ্রুতবর্ধনশীল, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং সেবামূলক এই শিল্পে সততার সাথে বিনিয়োগ করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও কর্মক্ষম সুস্থ সবল জাতি গঠনে অবদান রাখছেন সমর্থবান অনেকেই।

লেখক: কর্মকর্তা, বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।

 

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2023
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status