শেষের পাতা
কালোটাকা সাদার প্রথা বাতিল করে নতুন অর্থবছরের বাজেট পাস
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২৩ জুন ২০২৫, সোমবার
কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করে নতুন অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার জাতীয় বাজেট অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। রোববার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় বাজেট চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। সেখানে ২রা
জুন ঘোষিত বাজেটে আয়কর, শুল্ক, ভ্যাট-সংক্রান্ত কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাজেট কার্যকর হবে।
কালোটাকা বৈধ করার পথ বন্ধ: এবারের বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ করাই বড় পরিবর্তন। ২রা জুন প্রস্তাবিত বাজেটে অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট এবং ভবন কেনায় কালোটাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হয়। তবে আগের চেয়ে করের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছিল। বলা হয়, এলাকাভেদে আয়তন অনুসারে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিলেই টাকার উৎস সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে বলে ধরে নেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, পৌর এলাকাভেদে প্রতি বর্গফুটে ১০০ থেকে ২ হাজার টাকা করহারের প্রস্তাব ছিল। এ ছাড়া একই সুবিধা পেতে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে এলাকাভেদে প্রতি বর্গফুটে ৫০ থেকে ৯০০ টাকা কর নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এখন এসব সুযোগ বাতিল হলো।
এনবিআরের সূত্রগুলো বলছে, এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে অপ্রদর্শিত প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা ঘোষণায় এসেছে, অর্থাৎ সাদা হয়েছে। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশ থেকে পাচার করা টাকা ফেরত আনার সুযোগ দেয়া হলেও কেউ এ সুযোগ নেননি।
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় শুল্ক-করের পরিবর্তন নিয়ে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে। এতে শুল্ক করে বেশ কিছু বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে।
আয়কর: পাবলিকলি ট্রেডেড কোম্পানি যাদের পরিশোধিত মূলধনের অন্যূন ১০ শতাংশ শেয়ার আইপিও বা সরাসরি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে হস্তান্তর হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে আয়ের সাড়ে ২২ শতাংশ করারোপ করা হয়েছে। তবে বিবেচ্য আয়বর্ষে সব ধরনের আয় ব্যাংক লেনদেনের মাধ্যমে সম্পন্ন করলে করহার ২০ শতাংশ হবে। অন্য সব পাবলিকলি ট্রেডেড কোম্পানির ক্ষেত্রে সাড়ে ২৭ শতাংশ করারোপ করা হয়েছে। তবে বিবেচ্য আয়বর্ষে সব আয় ব্যাংক লেনদেনের মাধ্যমে সম্পন্ন করলে করহার ২৫ শতাংশ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা কেবল তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষাদানে নিয়োজিত বেসরকারি কলেজের করহার ১৫ শতাংশের স্থলে ১০ শতাংশ হবে। সম্পত্তি হস্তান্তর হতে কর সংগ্রহের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কর কর্তনের হার ৮ শতাংশ, ৬ শতাংশ ও ৪ শতাংশের স্থলে যথাক্রমে ৫ শতাংশ, ৩ শতাংশ ও ২ শতাংশ করা হয়েছে।
মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট: রিফাইন্ড পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে আগাম কর সাড়ে ৭ শতাংশের পরিবর্তে ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। ঝুট থেকে রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত তুলার উৎপাদন পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। নারী উদ্যোক্তা কর্তৃক পরিচালিত বিউটি পার্লারের স্থান ও স্থাপনাভাড়ার ওপর মূসক অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। বলপয়েন্ট কলমের আমদানি পর্যায়ে মূসক অব্যাহতি প্রদান করা। হার্টের রিং ও চোখের লেন্স আমদানির ক্ষেত্রে আগাম কর অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।
শুল্ক: সব ধরনের পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানিতে ট্যারিফ মূল্যের পরিবর্তে ইনভয়েস মূল্যের ভিত্তিতে শুল্কায়ন-ব্যবস্থা চালু করতে চায় সরকার। এ জন্য ক্রুড পেট্রোলিয়াম পণ্যের ক্ষেত্রে নির্ধারিত ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ককে কমিয়ে ৩ শতাংশ এবং অন্য ক্ষেত্রে নির্ধারিত ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ককে কমিয়ে ৬ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। সৌরশক্তি উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতিকে আরও সহজলভ্য করার উদ্দেশ্যে সোলার ইনভার্টারের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে। দেশে মানসম্পন্ন টায়ার উৎপাদনের জন্য টায়ার তৈরির অন্যতম কাঁচামাল টেকনিক্যাল স্পেসিফায়েড ন্যাচারাল রাবারের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে।
এদিকে রোববার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়িয়ে আগামী (২০২৫-২৬) অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট পাস করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ৮১ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। সেটি বাড়িয়ে ৯১ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা করে বাজেট পাস করা হয়েছে। এতে এ খাতে বরাদ্দ বেড়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আমরা জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ৫.৫০ শতাংশ ধরেছি। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬.৫০ শতাংশ।
সরকারি চাকুরেদের বিশেষ সুবিধা বাড়লো: অর্থ উপদেষ্টা বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটের তিনটি জায়গায় পরিবর্তন করে, বাকি অংকগুলো অপরিবর্তিত রেখে বাজেট পাস করা হয়েছে। তিনি বলেন, সরকারি চাকরিরতদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ১ হাজার ৫০০ টাকা এবং পেনশনভোগীদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৭৫০ টাকা বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। নিট পেনশন ১৭ হাজার ৩৮৮ টাকার ঊর্ধ্বে প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ এবং তার কমের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে বিশেষ সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীদের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী, বিচারপতি এবং এমপিওভুক্তদের ক্ষেত্রে পৃথক আদেশ করার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পরবর্তীসময়ে রপ্তানিনির্ভর প্রণোদনা ধীরে ধীরে প্রত্যাহারের তৃতীয় ধাপ হিসেবে হ্রাসের কার্যক্রম আগামী ১লা জুলাই ২০২৫ এর পরিবর্তে ১লা জানুয়ারি ২০২৬ করা হয়েছে।
গত ২রা জুন টেলিভিশনে বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে যার আকার ধরা হয় ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। আর এনবিআরকে আদায়ের লক্ষ্য দেয়া হয় ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি ধরা হয় জিডিপি’র ৩.৬ শতাংশ। তবে, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখার পর নানা মহলের সমালোচনায় তা বাদ পড়ে চূড়ান্ত অনুমোদনে।