অনলাইন
ইসরাইল-ইরান সংঘাত যখন তীব্র হচ্ছে, তখন রাশিয়ার নজর যেদিকে
মানবজমিন ডিজিটাল
(১২ ঘন্টা আগে) ১৫ জুন ২০২৫, রবিবার, ৩:৪৮ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৪:২৩ অপরাহ্ন

রাশিয়া কয়েক দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্যমূলক পদক্ষেপ বজায় রেখেছে। ইরানের সাথে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার পাশাপাশি ইসরাইলের সাথে তার উষ্ণ সম্পর্ককে দৃঢ় করার চেষ্টা করছে। এই সপ্তাহান্তে ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনাগুলোতে ইসরাইল সামরিক হামলা চালিয়ে শীর্ষ জেনারেল ও বিজ্ঞানীদের হত্যা করেছে। প্রতিক্রিয়ায় তেহরান ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এর জেরে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে মস্কো। উভয় পক্ষের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য সূক্ষ্ম কূটনৈতিক দক্ষতার প্রয়োজন। তবে এটি রাশিয়ার জন্য ‘পাওয়ার ব্রোকার’ হবার সুযোগ খুলে দিতে পারে, যাতে তারা সংঘর্ষের অবসান ঘটাতে ভূমিকা নিতে পারে। মস্কোর কিছু পর্যবেক্ষক আরও যুক্তি দেন যে, ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে সংঘর্ষের উপর মনোযোগ ইউক্রেনের যুদ্ধ থেকে বিশ্বব্যাপী মনোযোগ সরিয়ে নিতে পারে এবং কিয়েভের প্রতি পশ্চিমা সমর্থনকে দুর্বল করে রাশিয়াকে সুবিধা করে দিতে পারে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান উভয়ের সাথেই কথা বলেছেন, সংঘাত কমাতে সাহায্য করার প্রস্তাব দিয়েছেন। পেজেশকিয়ানের সাথে তার ফোনালাপে, পুতিন ইসরাইলি হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং তার সমবেদনা জানিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, রাশিয়া ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির আশেপাশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসরাইলি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে একটি বিবৃতি জারি করেছে, যেখানে তারা স্পষ্টতই এই হামলাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে উল্লেখ করেছে এবং সতর্ক করে দিয়েছে যে, এই উস্কানির সমস্ত পরিণতি ইসরাইলি নেতৃত্বের উপর বর্তাবে। উভয় পক্ষকে উত্তেজনা কমাতে এবং সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে রাশিয়া। কিন্তু ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের কঠোর ভাষায় নিন্দা জানানো সত্ত্বেও, মস্কো তেহরানের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থনের বাইরে অন্য কিছু দেয়ার কোনও ইঙ্গিত দেয়নি।
নেতানিয়াহুর সাথে তার ফোনালাপে পুতিন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উপায়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সাথে সম্পর্কিত সমস্ত সমস্যা সমাধানের গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছিলেন। আরও উত্তেজনা বৃদ্ধি রোধ করার জন্য পুতিন মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন বলে এক বিবৃতিতে বলেছে ক্রেমলিন।সেইসঙ্গে বলা হয়েছে, সমগ্র অঞ্চলের জন্য সবচেয়ে বিপর্যয়কর পরিণতি এড়াতে রাশিয়ান পক্ষ ইরান ও ইসরাইল উভয়ের নেতৃত্বের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ অব্যাহত রাখবে। শনিবার পুতিন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ফোনে মধ্যপ্রাচ্যের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। পুতিনের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ইউরি উশাকভ বলেছেন যে, ক্রেমলিন নেতা মধ্যস্থতা প্রচেষ্টা চালানোর জন্য রাশিয়ার প্রস্তুতির উপর জোর দিয়েছেন এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে মার্কিন-ইরান আলোচনার সময় পারস্পরিকভাবে গ্রহণযোগ্য চুক্তি খুঁজে বের করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তাব করেছেন।
শীতল যুদ্ধের সময় মস্কো এবং তেহরানের মধ্যে সম্পর্ক প্রায়শই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর, নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বড় শয়তান’ বলে অভিহিত করেছিলেন, একইসঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমালোচনা করতেও ছাড়েননি। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া-ইরান সম্পর্ক গভীর হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হওয়ার পর মস্কো ইরানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার এবং অস্ত্র ও প্রযুক্তির শীর্ষ সরবরাহকারী হয়ে ওঠে। রাশিয়া বুশেহর বন্দরে ইরানের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে যা ২০১৩ সালে কার্যকর হয়। ২০১৫ সালে ইরান এবং ছয়টি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে রাশিয়া অংশ নিয়েছিল, যেখানে তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ এবং আন্তর্জাতিক তদন্তের জন্য উন্মুক্ত করার বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে চুক্তি থেকে সরে আসার পর রাশিয়া রাজনৈতিক সমর্থন প্রদান করেছিল।
২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, রাশিয়া এবং ইরান বাশার আল-আসাদের সরকারকে শক্তিশালী করার জন্য একত্রিত প্রচেষ্টা চালায়। তারা আসাদকে দেশের বেশিরভাগ অংশ পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেছিল, কিন্তু ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বিরোধীদের তীব্র আক্রমণের পর তার শাসনের দ্রুত পতন রোধ করতে ব্যর্থ হয়। ২০২২ সালে যখন মস্কো ইউক্রেনে পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণ শুরু করে, তখন পশ্চিমারা অভিযোগ করে যে তেহরান শাহেদ ড্রোন সরবরাহ এবং পরে রাশিয়ায় উৎপাদন শুরু করার জন্য ক্রেমলিনের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক সম্পর্কের স্বার্থে জানুয়ারিতে, পুতিন এবং পেজেশকিয়ান ‘ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারিত্ব’ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
শীতল যুদ্ধের সময়, মস্কো ইসরাইলের আরব শত্রুদের সশস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। ১৯৬৭ সালে ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ভেঙে যায় , ১৯৯১ সালে আবার তা পুনরুদ্ধার করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া-ইসরাইল সম্পর্ক দ্রুত গভীর এবং শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তেহরানের সাথে মস্কোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও, পুতিন বারবার ইসরাইলি স্বার্থ নিজের বিবেচনায় রেখেছেন। তিনি নেতানিয়াহুর সাথে উষ্ণ, ব্যক্তিগত সম্পর্ক বজায় রেখেছেন, যিনি ইউক্রেন যুদ্ধের আগে প্রায়শই রাশিয়া ভ্রমণ করতেন। রাশিয়া এবং ইসরাইলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক সিরিয়ার উন্নয়নসহ নাজুক এবং বিভেদমূলক বিষয়গুলো মোকাবেলায় তাদের সহায়তা করেছে।
যদিও রাশিয়া ইরানকে অত্যাধুনিক S-300 বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা সরবরাহ করেছিল, যা ইসরাইল গত বছর ইরানে তাদের হামলার সময় ধ্বংস করে দিয়েছিল বলে দাবি করেছিল, মস্কো ইসরাইলি উদ্বেগের প্রতিক্রিয়ায় অন্যান্য অস্ত্র সরবরাহ থেকে বিরত রয়েছে। বিশেষ করে, রাশিয়া ইরানের প্রয়োজনীয় Su-35 যুদ্ধবিমান সরবরাহ বিলম্বিত করেছে যাতে তারা তাদের পুরনো নৌবহর আপগ্রেড করতে পারে। ইসরাইলের সাথে ক্রেমলিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তেহরানে অসন্তোষের সূত্রপাত করেছে, যেখানে রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের কিছু সদস্য মস্কোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বলে জানা গেছে। ইসরাইল এবং ইরান উভয়ের সাথেই সুসম্পর্ক বজায় রাখা এখন ফলপ্রসূ হতে পারে, যার ফলে মস্কো উভয় পক্ষের কাছেই বিশ্বস্ত অবস্থানে পৌঁছে যাবে এবং তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে ভবিষ্যতের যেকোনো চুক্তিতে সম্ভাব্য অংশগ্রহণকারী হয়ে উঠবে।
শুক্রবারের হামলার অনেক আগে, পুতিন ট্রাম্পের সাথে তার ফোনালাপে মধ্যপ্রাচ্যের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা নিয়ে আলোচনা করেন। রাশিয়ান নেতার সামনে ইউক্রেনের যুদ্ধ থেকে সরে আসার এবং বিশ্বব্যাপী বিষয়গুলোতে ওয়াশিংটনের সাথে আরও বিস্তৃতভাবে জড়িত হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ পরামর্শ দিয়েছেন যে রাশিয়া ইরান থেকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম নিতে পারে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে একটি সম্ভাব্য চুক্তির অংশ হিসাবে এটিকে বেসামরিক চুল্লি জ্বালানিতে রূপান্তর করতে পারে। ইসরাইলি হামলার পর ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচির উপর কঠোর বিধিনিষেধ মেনে নেবে এমন একটি চুক্তির আলোচনার সম্ভাবনা ম্লান। কিন্তু যদি আলোচনা আবার শুরু হয়, তাহলে রাশিয়ার প্রস্তাব চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে উঠে আসতে পারে। অনেক পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করেন যে ইসরাইলি হামলা সম্ভবত বিশ্বব্যাপী তেলের দাম বাড়িয়ে দেবে এবং মস্কোকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করবে বিশেষ করে যখন এর অর্থনীতি সংকটে রয়েছে।
মস্কোভিত্তিক সামরিক বিশ্লেষক রুসলান পুখভ একটি মন্তব্যে লিখেছেন, ‘এটি ইউক্রেন এবং পশ্চিম ইউরোপে তার মিত্রদের রাশিয়ার তেল রাজস্ব হ্রাসের আশা ম্লান করে দেবে, এই রাজস্ব রাশিয়ার সামরিক বাজেট পূরণের জন্য অপরিহার্য।’
মস্কোর কিছু ভাষ্যকার আরও যুক্তি দেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত সম্ভবত ইউক্রেনের যুদ্ধ থেকে পশ্চিমা মনোযোগ এবং সম্পদকে সরিয়ে দেবে এবং রাশিয়ার জন্য তার যুদ্ধক্ষেত্রের লক্ষ্য অর্জন সহজ করে তুলবে। ক্রেমলিনপন্থী বিশ্লেষক সের্গেই মার্কভ বলেছেন, ‘ইউক্রেনের প্রতি বিশ্বের মনোযোগ দুর্বল হয়ে পড়বে। ইসরাইল এবং ইরানের মধ্যে যুদ্ধ ইউক্রেনে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর সাফল্যে সহায়তা করবে।’
সূত্র : সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট
পাঠকের মতামত
রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধের শুরু থেকেই ইরান ব্যাপক ভাবে ড্রোন সহ গোলাবারুদ ও ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছে। বিনিময়ে রাশিয়ার তরফ থেকে su35 অত্যাধুনিক বিমান ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহের আশ্বাস দিয়েছিল! কিন্তু ইজরায়েলের সাথে বন্ধুত্ব রক্ষার জন্য রাশিয়া ইরানকে আধুনিক যুদ্ধ বিমান সরবরাহ করেনি। এখনো ইজরায়েলকে খুশি রাখতে প্রকৃতপক্ষে রাশিয়া ও চীন ইরানকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়নি!