ঢাকা, ৬ জুন ২০২৫, শুক্রবার, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৮ জিলহজ্জ ১৪৪৬ হিঃ

অনলাইন

জাতীয় বাজেট ২০২৫–২৬ এবং সামাজিক সুরক্ষার চ্যালেঞ্জ


ডক্টর জিয়াউদ্দীন হায়দার

(১ দিন আগে) ৫ জুন ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১০:৪৭ পূর্বাহ্ন

চরম দারিদ্র্যের নতুন চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে চরম দারিদ্র্য দূর করার কাজ খুব জরুরি, আর এটা অনেক কঠিন। ১৯৯০ এর পর থেকে বিগত কয়েক দশকে দরিদ্র পরিবারের সংখা কমেছে। কিন্তু অপশাসনের সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক সমস্যা আবার আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে। পতিত সরকারের ভ্রান্তনীতি, কুশাসন আর সীমাহীন দুর্নীতির সাথে সাথে করোনা মহামারি, বিশ্বব্যাপী মূল্যবৃদ্ধি আর মুদ্রাস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের অনেক পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। ২০২২ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিলো ১৮.৭, আর ৫% জনগণের অবস্থান ছিল চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে (মানে, প্রতিদিন তাদের আয় ২.১৫ ডলারেরও কম)। বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০২৫ সালের মধ্যে এই চরম দারিদ্র্য বেড়ে ৯.৩% হবে, যার মানে আরও প্রায় ৩০ লাখ মানুষ চরম দরিদ্রসীমার নিচে থাকবে। দারিদ্র্যের এই উচ্চ হারের বহুবিধ কারণ রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো হঠাৎ করে চাকরি হারানো, একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু অথবা কঠিন রোগে ভোগা, আর, সর্বোপরি, খাদ্য সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি।

বিএনপির ৩১ দফা পরিকল্পনা: দারিদ্র্য কমানোর নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
গণতন্ত্রকামী সকল দলের অংশগ্রহণে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংস্কারের জন্য ৩১ দফার একটা বড় পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। সেখানে বলা হচ্ছে, শুধু আয় কম থাকলেই কেউ দরিদ্র হয় না—দারিদ্র্যের পেছনে অনেক গভীর কারণ থাকে। যেমন: দুর্নীতি, এককেন্দ্রিক শাসন, প্রতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, আর সকলকে অর্থনীতিতে সমভাবে অংশগ্রহণ করতে না দেয়া। এই পরিকল্পনায় বিএনপি বলছে, প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে দেশকে নতুনভাবে গঠন করতে হবে এবং দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। এর জন্য দরকার: স্থানীয় সরকারকে ঢেলে সাজিয়ে স্থানীয় উন্নয়নের কেন্দ্রে পরিণত করা ও অধিক ক্ষমতা দেয়া, শাসনে জবাবদিহিতা ফিরিয়ে আনা আর গ্রাম শহরের নারী-যুবকসহ সবাইকে নিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা। বিএনপি বিশ্বাস করে, স্থানীয় সরকারকে অর্থ ও প্রশাসনের ক্ষমতা দিলে তারা দরিদ্র মানুষদের ভালোভাবে চিনে তাদেরকে যুগোপযোগী সেবা দিতে পারবে। এখন যেভাবে কিছু ক্ষমতাবান লোক সব সুযোগ দখল করে রাখে, তা দূর হবে। কারণ, তারা গণ বিছিন্নতার কারণে দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ তহবিল নিজেদের মতো করে ব্যবহার করে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই: মূল বাধা দূর করার চেষ্টা
বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমাতে যে সব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তার অনেকটাই বাধাগ্রস্ত হয়েছে দুর্নীতির কারণে। বিদেশি দাতারা অনেক প্রকল্পে টাকা দিলেও ভুলভাবে চালানো, অপরিপক্কতা, দুর্নীতি আর রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টু ব্যবস্থার কারণে সে প্রকল্পগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। দুর্নীতি রুখতে স্বাধীন দুর্নীতি বিরোধী কমিশন, বিচার ব্যবস্থার সংস্কার, আর স্বচ্ছ নজরদারি ব্যবস্থা গড়া দরকার—যেন দারিদ্র্য কমানোর জন্য যে টাকা বরাদ্দ হয় সেটা প্রকৃত উপকার ভোগীদের কাছেই পৌঁছায়। না হলে প্রকল্পগুলো দুর্বল আর ফাঁকফোকর ভরা থেকে যায়। তখন এসব উদ্যোগ আসলে দরিদ্রদের জন্য সহায়তা নয়, বরং কিছু প্রভাবশালীর সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়।

অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন: চাকরি ও আয়ের পথ তৈরি করা
দারিদ্র্য থেকে মানুষকে টেকসইভাবে বের করতে হলে চাকরি আর আয়ের সুযোগ বাড়াতে হবে। এজন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় সহায়তা দিতে হবে, কৃষি খাতকে আধুনিক করতে হবে, গ্রামীণ এলাকায় ছোট শিল্প গড়তে হবে, আর দরিদ্র মানুষদের কাজের উপযোগী প্রশিক্ষণ দিতে হবে। 

এছাড়া, ৩১ দফার কাঠামোর আলোকে দরিদ্র বিমোচনের জন্য বিএনপি একটি নতুন সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা চালু করতে চায়—'পরিবারভিত্তিক ইলেকট্রনিক কার্ড'। প্রতিটি দরিদ্র পরিবার (৪ জনের সমান ধরে) এই কার্ড পেলে তারা নিকটবর্তী নির্দিষ্ট দোকান থেকে কম দামে বা বিনা দামে প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করতে পারবে। এর ফলে: পরিবারগুলোর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, খাদ্যদ্রব্য কেনার খরচ কমবে এবং প্রতি মাসে পরিবারটির কিছু টাকা সঞ্চয় হবে। এই সঞ্চয় দিয়ে তারা প্রোডাকটিভ অ্যাসেট বৃদ্ধি করতে পারবে এবং ছোট ব্যবসা শুরু করতে পারবে। এই প্রক্রিয়ায় পরিবারটি সেলফ হেল্পের মাধ্যমে ধীরে ধীরে আত্মনির্ভরশীল হতে পারবে। এতে করে শুধু সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভর না করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পথ তৈরি হবে। এছাড়া, প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও গ্রামীণ অবকাঠামো খাতে বড় বিনিয়োগ করতে হবে, যাতে গ্রামীণ পরিবারগুলোর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দারিদ্র্যের বেড়াজালের মধ্যে আর না পড়ে।

২০২৫–২৬ বাজেট ও বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা 
বর্তমান সরকারের দেয়া ২০২৫–২৬ সালের বাজেট মূলত প্রায় পূর্বের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য এই বাজেটে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আশা-আকাঙক্ষার কোনো প্রতিফলন নাই। তারা শুধু বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার পরিকল্পনা করছে। ২০২৫–২৬ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ৯৫,৯০৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিছু কিছু ভাতা (বয়সভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধীভাতা) একটু বাড়ানো হয়েছে, আর কিছু নতুন মানুষকে সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে। তবে এই ব্যবস্থাগুলো এখনো আগের মতোই কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনিক ব্যবস্থাভিত্তিক, কাগজপত্র-নির্ভর, আর অনেক ধরনের জটিলতা ও দুর্নীতির মধ্যেই আছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এ ধরনের ব্যবস্থা শুধুমাত্র কিছু টাকা দিয়ে কিছু মানুষকে সাহায্য করবে, কিন্তু দরিদ্র মানুষকে স্বনির্ভর করার পথ দেখাবে না। অথবা, কাজ শেখানো, শিক্ষা–চিকিৎসা সুবিধা দেয়া বা ব্যবসার সুযোগ তৈরির মতো কিছু করবে না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, বর্তমান মূল্যস্ফীতির কারণে ভাতায় পাওয়া এই পরিমাণ টাকা খুব একটা প্রয়োজন মেটাবে না। টাকার পরিমাণের বিপরীতে পাল্লা দিয়ে জিনিসের দাম আরও বেশি বাড়ছে। ফলে দরিদ্র পরিবারগুলো পূর্বের ধারাবাহিকতায় খাবার, চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় সেবা পেতে হিমশিম হিমসিম খাবে।

বাজেট, রাজস্ব ও প্রতিষ্ঠানগত সীমাবদ্ধতা: বড় ধরনের সংস্কারের প্রয়োজন 
যে কোনো সরকার দারিদ্র্য কমাতে চাইলে অর্থ কোথা থেকে আসবে, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশে সরকারের রাজস্ব আয় তুলনামূলকভাবে খুব কম—জিডিপির মাত্র ৭.৫ থেকে ৮ শতাংশর মতো আসে কর থেকে। এর কারণ—কর ফাঁকি, কর আদায়ে দুর্বলতা, এবং রাজস্ব বোর্ডের সীমিতক্ষমতা। সরকার প্রতি বছর অনেক টাকা দেশীয় ব্যাংক থেকে ঋণ করে। আবার অবকাঠামো, ভর্তুকি আর ঋণ পরিশোধেও প্রতি বছর অনেক টাকা খরচ করে। ফলে গরিব মানুষের জন্য যে প্রকল্প দরকার, সেগুলো করার মতো বাজেট বরাদ্দ আর অবশিষ্ট থাকে না। এই ব্যবস্থা নিরসনের জন্য দরকার কর ব্যবস্থার সংস্কার, আয় রাজস্বের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য সঠিক পরিকল্পনা এবং অর্থ খরচের ক্ষেত্রে দক্ষতা আর স্বচ্ছতা। এছাড়া, বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর আরও কিছু বড় ধরনের সমস্যা আছে—একাধিক মন্ত্রণালয়ের ওভারল্যাপিং দায়িত্ব, কারা ভাতা পাবে সেই তথ্যের নির্ভরযোগ্য ডাটাবেস নেই, সেইসাথে সুবিধাভোগী পরিবার বাছাইয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। ফলে অনেকে প্রকৃত দরিদ্র হয়েও বাদ পড়ে যায়, আর এই সুযোগে প্রভাবশালী লোকজন সুবিধা নিয়ে নেয়।

বিএনপি একটি প্রযুক্তিভিত্তিক জাতীয় সামাজিক রেজিস্ট্রি গঠনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, যার তদারকি করবে স্বাধীন অডিট প্রতিষ্ঠান। এতে প্রকৃত গরিবদের খুঁজে বের করে তাদের উপযুক্ত সহায়তা দেয়া যাবে। পাশাপাশি, স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা বাড়ানো হবে, যাতে তারা নিজের এলাকার মানুষকে চিনে শনাক্ত করে দ্রুত এবং যথাযথ সেবা দেয়ার সক্ষমতা রাখে।

আরও ন্যায়ভিত্তিক, স্থিতিশীল এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের পথে
সবশেষে বলা যায়, শুধু ভাতা বা সহায়তার পরিমাণ একটু বাড়ালেই চরম দারিদ্র্য কমবে না। বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা পরিকল্পনা জাতীয় উন্নয়নের একটি রূপরেখা যেখানে কাঠামোগত সংস্কার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা, স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধি আর সবার জন্য উন্নয়ন নিশ্চিত করার দৃঢ় প্রত্যয় আছে। বর্তমান সরকারের বাজেট হয়তো কিছু সময়ের জন্য সাময়িক সাহায্য দেবে, কিন্তু সেটি দারিদ্র্যের মূল কারণ দূর করবে না। যদি আমরা আয় বাড়ানোর ব্যবস্থা করি, প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের গুণগত মান বাড়াই আর দরিদ্র মানুষদের ক্ষমতায়ন করি—তবে এইসব উদ্যোগ সত্যিকার অর্থে দারিদ্র্য দূর করতে পারবে। বিএনপির কাঠামোগত পরিকল্পনাকে স্বল্পমেয়াদি সহায়তার সঙ্গে একত্র করে যদি একটি সমন্বিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়, তবে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই চরম দারিদ্র্য মুক্ত, ন্যায্য ও অংশগ্রহণমূলক একটি সমাজে পরিণত হতে পারবে।

লেখক -বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য এবং সাবেক বিশ্ব ব্যাংক কর্মকর্তা

অনলাইন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

অনলাইন সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status