প্রথম পাতা
৩ দিন ধরে বন্ধ চিকিৎসাসেবা
চক্ষু বিজ্ঞানে ভুতুড়ে পরিস্থিতি
সুদীপ অধিকারী
৩১ মে ২০২৫, শনিবার
নিরাপদ কর্মপরিবেশের দাবিতে গত তিনদিন ধরে কর্মবিরতি পালন করছেন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্সসহ প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে হাসপাতালটির চিকিৎসাসেবা। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন হাসপাতালে ভর্তি থাকা সাধারণ রোগীরা। এমনকী খাবার পর্যন্ত পাচ্ছে না কেউ। এদিকে বহির্বিভাগও বন্ধ থাকায় দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীরাও চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
এর আগে হাসপাতালটিতে ভর্তি থাকা জুলাই আন্দোলনে আহত যোদ্ধাদের খারাপ ব্যবহার ও লাঞ্ছিত হওয়ার অভিযোগ তুলে বুধবার থেকে কর্মবিরতি শুরু করে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সেদিন হাসপাতালে আগত রোগী ও জুলাই আন্দোলনে আহত যোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষ বাধে। একপর্যায়ে চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যায় সকলে। পরে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব ও কোস্ট গার্ডের সদস্যরা এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। সেই থেকেই বন্ধ রয়েছে হাসপাতালের পুরো কার্যক্রম। ছুটিতে রয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরীও।
গতকাল সরজমিন দেখা যায়, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অভ্যন্তরে কোনো চিকিৎসক-নার্স, অফিস স্টাফ কেউ নেই। গেটে ও হাসপাতালের ভেতরে কয়েকজন আনসার সদস্য তাদের দায়িত্ব পালন করছেন। জরুরি বিভাগ থেকে শুরু করে প্যাথলজি, চিকিৎসকদের রুমসহ সকল সেবা বন্ধ রয়েছে। তিনদিন ধরে হাসপাতালের সিডিউল অপারেশন একটিও সম্পন্ন হয়নি। অলস ঘোরাফেরা করছে হাসপাতালে ভর্তি রোগীরা। এমনই একজন মো. রিমন মিয়া। জুলাই আন্দোলনে চোখে বুলেটবিদ্ধ হয়ে ৬ মাস ধরে তিনি হাসপাতালের ৪ তলায় ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। রিমন মিয়া বলেন, বুধবার সকাল থেকে আমাদের এই হাসপাতালের সকল চিকিৎসাসেবা বন্ধ রয়েছে। হাসপাতালে কোনো চিকিৎসক-নার্স এমনকী কোনো অফিস স্টাফরাও আসছেন না। এখানে আমরা সকলে চোখে আঘাতপ্রাপ্ত রোগী। অনেকেরই চোখের মধ্যে বুলেট বিঁধে রয়েছে। অনেক সাধারণ রোগীরাও চোখের যন্ত্রণায় চিৎকার চেঁচামেঁচি করছেন। এরপরও কেউই চিকিৎসা পাচ্ছে না। এমনকী হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের জন্য প্রতিদিন হাসপাতাল থেকে যেই খাবার দেয়া হতো তাও দেয়া হচ্ছে না। জুলাই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আমাদের কয়েকজনের জন্য জরুরি ওষুধ ও খাবারের ব্যবস্থা করা হলেও বাকি সাধারণ রোগীরা বাইরে থেকে খাবার কিনে খাচ্ছে। তিনি বলেন, যতো যাই হোক এইভাবে একটা হাসপাতালের সকলে মিলে জোটবদ্ধ হয়ে চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেয়া মোটেও উচিত নয়। ইব্রাহিম নামে হাসপাতালটিতে ভর্তি থাকা আরেক রোগী বলেন, আমার ডান চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। কিছুই দেখতে পাই না। গত তিনদিন ধরে এই হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা বন্ধ রয়েছে। এখন ডান চোখের প্রভাব বাম চোখেও দেখা যাচ্ছে। শুধু পানি পড়ছে আর জ্বালা করছে। এরপরও কোনো চিকিৎসকের দেখা পাচ্ছি না। এই পরিস্থিতিতে কী করবো কিছুই মাথায় আসছে না।
এদিকে চিকিৎসা না পেয়ে ভর্তি থাকা অনেক রোগীই হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এমনই একজন রোকসানা বেগম। তিনি ও তার সন্তান রাহাতকে নিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। রোকসানা বেগম বলেন, আমার ছেলের চোখে সমস্যা। আমরা বেশ কয়েকদিন ধরে এই হাসপাতালের ৪তলার ১০ নম্বর বেডে ভর্তি ছিলাম। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমরা খুব শঙ্কায় আছি। কোনো চিকিৎসাও পাচ্ছি না। ঢাকাতেও আমাদের কোনো থাকার জায়গা নেই। তাই আপাতত আশুলিয়ায় বোনের বাসায় গিয়ে ওঠবো। পরিস্থিতি ঠিক হলে আবার এসে চিকিৎসা করাবো। তারপর বাড়িতে পাবনায় ফিরবো। তিনি বলেন, বুধবার মারামারি হওয়ার পর সেদিন থেকে অনেক রোগীই ব্যবস্থাপত্র নিয়ে চলে গেছেন। আমরা অপক্ষোয় ছিলাম মনে হয় সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সে সবের কোনো লক্ষণ নেই। কবে ডাক্তারেরা আসবেন, রোগী দেখা কবে থেকে শুরু হবে, অপারেশন আবার কবে থেকে শুরু হবে, আদৌ কী ডেট পাওয়া যাবে কিনা তা কেউ বলতে পারছে না। তাই দুইদিন বসে থাকার পর আজ বাধ্য হয়ে চলে যাচ্ছি।
অপরদিকে জাতীয় এই চক্ষু হাসপাতালের বহির্বিভাগে নিয়মিত চিকিৎসা নিতে সকাল থেকেই সাধারণ রোগীদের ভিড় লেগে থাকে। টিকিট বিক্রির শুরুর আগে থেকেই কাউন্টারের সামনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষের লম্বা লাইন থাকে। কিন্তু বহির্বিভাগ বন্ধ থাকায় বহিরাগত রোগীরাও পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে। রাজশাহী, খুলনা, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, সাভারসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের রোগীরা রাত জেগে রওনা করে সকালে আগারগাঁও-এর চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে এসে চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। অনেকেই আবার চোখের যন্ত্রণা সহ্য না করতে পেরে চিকিৎকের আশায় দীর্ঘক্ষণ হাসপাতালের গেটের সামনে ঠাঁই বসে থাকছেন। এমনই একজন চাঁদপুরের মতলব থেকে আসা রাশেদ হোসেইন। তিনিও গতকাল এসেছিলেন চক্ষুবিজ্ঞানে। রাশেদ বলেন, আমার দুই চোখেই অনেক সমস্যা। স্থানীয় জেলা সদরে ডাক্তার দেখানোর পর সেখান থেকে বেশ কয়েকটি টেস্ট করাতে বলেছে। কিন্তু সেই টেস্টগুলো একমাত্র এই হাসপাতালেই হয়। তাই গতকাল রাতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করি। সিরিয়াল আগে পাওয়ার আশায় সকালে এখানে আসি। কিন্তু দেখি হাসপাতাল বন্ধ। টেস্ট তো দূরের কথা কোনো ডাক্তার-নার্সই নেই হাসপাতালে। কিন্তু এই টেস্টগুলো না করালে আমার চোখের কোনো চিকিৎসাই শুরু হবে না। তাই অপেক্ষায় আছি। তিনি বলেন, এখন দেখি আশপাশের কোনো হোটেলে ওঠবো। কালকে আবারো এই হাসপাতালে আসবো। এই টেস্ট না করিয়ে বাড়ি ফিরতেও পারছি না। আফসানা বেগম নামে নাটোর থেকে আসা আরেক রোগী বলেন, মাসখানেক আগে এখানে আমার চোখের অপারেশন হয়েছিল। আজকে ওই চোখের চেকআপের জন্য দিন ধার্য ছিল। তাই ঢাকায় এসেছি। কিন্তু হাসপতাল তো বন্ধ। এখন কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।
এই কর্মবিরতির বিষয়ে এক চিকিৎসক বলেন, আমরা বার বার লাঞ্ছিত হবো। আমাদের নার্স-চিকিৎসকদের সঙ্গে খারাপ ব্যাহার করা হবে। মারধর করা হবে আর আমরা সব সহ্য করে সেবা দিয়ে যাবো? তিনি বলেন, বুধবারও আমাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। আমাদের সিনিয়র চিকিৎসকদের পর্যন্ত ছাড় দেয়া হয়নি। তাদের জাপটে ধরে লাঠিসোটা দিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয়েছে। অনেকের মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছে। এসবের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ও আমাদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ না ফিরে আসা পর্যন্ত আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেউ কাজ করবো না।
এ বিষয়ে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জানে আলম বলেন, হাসপাতালে কোনো চিকিৎসক ও কর্মচারী প্রবেশ করতে পারছেন না। কবে নাগাদ পুনরায় সেবা চালু হবে, সেটা জানা নেই। হাসপাতালে কোনো রোগীর অবস্থানের তথ্যও আমার কাছে নেই।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. খায়ের আহমেদ বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত রোগীরা আমাদের চিকিৎসকদের চিকিৎসায় সন্তুষ্ট নয়। এই মুহূর্তে ওই রোগীদের কোনো ওষুধ দিলে তারা মনে করতে পারেন চিকিৎসকেরা শত্রুতাবশত তাদেরকে কিছু খাইয়ে দিয়েছেন। তাই জুলাই আহতদের মধ্যে যারা অন্তত ৯০ শতাংশ সুস্থ আছেন, তাদেরকে বর্তমানে বাড়ি পাঠানো যেতে পারে। এর বাইরে যাদের চিকিৎসার প্রয়োজন হবে, তাদের অন্য হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া উচিত। তা না হলে এই সংকটের সমাধান হবে না।
পাঠকের মতামত
৫৫ জন রোগীর মধ্যে ৪৬ জন ছুটি দেয়ার মতো। তোমরা এখন এখানে ফ্রি খাওয়া দাওয়ার জন্য বসে থাকবা, টাকা পয়সা মারতে থাকবা, যখন খুশি তখন ডাক্তার নার্সদের মারধর করবা, তোমাকের অন্যায় আবদার না মানলে জুলাই এর মুলা ঝুলাবা এভাবে চলে না।
রোগী যদি সন্তোষ জনক সেবা না পায় তবে এর জন্য ডাঃ গণ দায়ী
এসব ডাক্তার কে বের করে চিনা চিকিৎসক এনে চিকিৎসা করাতে হবে , এরা সবাই ভারতের ট্যাবলেট খেয়ে এসব করে ছে।
যা হবার হয়েছে। তাই বলে ন্যাশনাল আই হসপিটাল বন্ধ। তাও ৩ দিন হতে বন্ধ। এটা কি ভাবে হতে পারে।৷ এ কদিন বেতন না নিলেই হয়। অনুগ্রহ করে হাস্পাতালটি বন্ধ করবেন না। আজকের মধ্যে চালুর পরিকল্পনা করুন।