প্রথম পাতা
আকার কমছে, বাজেটে বড় সংস্কার নেই
এমএম মাসুদ
১ জুন ২০২৫, রবিবার
দেশের অর্থনীতি নানা চাপের মুখে। এমন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার আগামী বাজেটের আকার চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়েও ছোট করে এনেছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা চলতি বাজেটের চেয়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কম। মূলত সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এবারের ছোট বাজেট দিতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
তাদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার নিয়ে বড় বড় কথা বললেও অর্থনীতি নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। সরকার অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত কয়েকটি কমিটি এবং টাস্কফোর্স গঠন করেছিল। এরমধ্যে শ্বেতপত্র কমিটি ছিল। কিন্তু এবারের বাজেটে টাস্কফোর্স ও কমিটিগুলোর সুপারিশের প্রতিফলন খুব বেশি থাকছে না বলেই মনে হচ্ছে। নতুন কোনো অর্থনৈতিক পথনকশাও দেখা যাচ্ছে না। অর্থাৎ আরেকটি গতানুগতিক বাজেটই দিতে যাচ্ছেন অর্থ উপদেষ্টা।
তবে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সংস্কার কমিটিগুলোর কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা থাকবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে। সূত্র বলছে, জুলাই অভ্যুত্থানে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এটিই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট। আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন দিলে অন্তর্বর্তী সরকারের একমাত্র বাজেট হবে এটি। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অনিশ্চয়তার মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বেসরকারি বিনিয়োগ জোরদার করা এবং সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে মজবুত করার মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বর্তমান সরকার।
সরকারের তথ্য বিবরণ বলছে, সংসদ না থাকায় ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের বাজেট রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম বিটিভিসহ অন্যান্য বেসরকারি গণমাধ্যমে একযোগে প্রচার করা হবে। আগামী সোমবার (২রা জুন) অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জাতির উদ্দেশ্যে নতুন অর্থবছরের জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করবেন। ওইদিন বিকাল ৪টায় ধারণকৃত বাজেট বক্তৃতা বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত হবে। এর আগে সংসদের বাইরে বাজেট দেয়া হয়েছিল ২০০৮ সালে। তখন ক্ষমতায় ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ওই বছরের ৯ই জুন তখনকার অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম ২০০৮-০৯ অর্থবছরের জন্য ৯৯ হাজার ৯৬২ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিলেন। সেদিনও ছিল সোমবার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবার সংসদ না থাকায় সংসদের আলোচনা বা বিতর্কের কোনো সুযোগ থাকছে না। তবে বাজেট ঘোষণার পর প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর নাগরিকদের নিকট মতামত চাইবে অর্থ মন্ত্রণালয়। মতামতের ভিত্তিতে তা চূড়ান্ত করা হবে। এরপর আগামী ২৩শে জুনের পর যেকোনো একদিন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদন নিয়ে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে তা আগামী এক জুলাই থেকে কার্যকর করা হবে।
বাজেটে বড় সংস্কার নেই: বাজেটে সংস্কারের সুপারিশের প্রতিফলন কমই থাকছে। এনবিআর সংস্কার কমিটির প্রতিবেদন তৈরির কাজ কবে শেষ হবে, তা জানা যায়নি। তবে প্রতিবেদন তৈরির আগেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে এনবিআরকে নীতি বিভাগ ও বাস্তবায়ন বিভাগ নামে দুই ভাগ করার যে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এনবিআরের ভেতর থেকে আন্দোলন শুরু হওয়ায় সরকার এখন এ অধ্যাদেশ সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা তলানিতে নেমেছে। পাঁচ বছরের মধ্যে সূচক সর্বনিম্ন অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। পুঁজিবাজারের অবস্থা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেমন খারাপ ছিল, এখনো তাই আছে। পুঁজিবাজারের উন্নতির জন্য পাঁচ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে গত বছরের অক্টোবরে। তবে টাস্কফোর্স ছয়টি বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। বাকিগুলোর কাজ চলছে।
বাজেটে যেসব পরিবর্তন আসছে: সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নতুন বাজেটে ৬২২টি পণ্যে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার বা হ্রাস এবং ১০০টি পণ্যে কাস্টমস ডিউটি কমানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। উপকৃত পণ্যের তালিকায় রয়েছে কোল্ড স্টোরেজ যন্ত্রপাতি, পেপার পণ্য, বাস, নিউজপ্রিন্ট, ক্যান্সার চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং ওষুধ ও পরিবেশবান্ধব পণ্যের কাঁচামাল। এ ছাড়া তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও ওষুধ শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের ওপর শুল্ক অব্যাহতির প্রস্তাবও থাকছে। আমদানি ঘোষণায় ভুল থাকলে বর্তমানে ৪০০ শতাংশ শাস্তির পরিবর্তে তা কমিয়ে ২০০ শতাংশ করার সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে ব্যবসায়িক পরিবেশ আরও সহনশীল হয়। ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এনবিআর ১০০টি পণ্যে শূন্য শুল্কের প্রস্তাব আনছে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে টেক্সটাইল খাতের কাঁচামাল, শিল্প যন্ত্রপাতি এবং সামরিক সরঞ্জাম।
কৃষিপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে কোল্ড স্টোরেজ যন্ত্রপাতির (বিশেষ করে কম্প্রেসার) ওপর শুল্ক ছাড় দেয়া হচ্ছে। খেলনা ও ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কাঁচামালে শুল্ক কমানোর পাশাপাশি প্রস্তুত খেলনার আমদানি শুল্কমূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে প্রতি কেজি ৪ ডলার। উইলো কাঠের (ক্রিকেট ব্যাট তৈরির জন্য জনপ্রিয় কাঠ) শুল্ক ৩৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৬ শতাংশ করার প্রস্তাবও থাকছে।
সুদ পরিশোধের পরই পরিচালনা বাজেটের অন্যতম বড় খাত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা। চলতি বাজেটে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বাবদ বরাদ্দ রয়েছে ৮২ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৬ শতাংশ বাড়িয়ে নতুন বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে প্রায় ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এর অন্যতম কারণ হলো, ১ম থেকে ৯ম গ্রেডের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ১৫ শতাংশ এবং ১০ম থেকে ২০তম গ্রেডভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আগামী ১লা জুলাই থেকে সরকারি চাকরিজীবীরা এ সুবিধা পেতে পারেন। এজন্য বাড়তি প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে।
শনিবার এক বিতর্ক অনুষ্ঠানে গবেষণা সংস্থা সিপিডি’র বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আগামী অর্থবছরের জন্য একটি গতানুগতিক বাজেট প্রণয়ন হতে যাচ্ছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে খেলাপি ঋণ আদায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত ও করের আওতা বাড়ানোর মতো নতুন কিছু না থাকায় বাজেটে নতুন চমক নেই। বাজেট যেমন হওয়া দরকার ছিল, তা হচ্ছে না। দেশের ৮৫% সম্পদ ১০% লোকের হাতে চলে গেছে, কিন্তু বরাবরের মতো এবারো পরোক্ষ করের উপর নির্ভরশীল বাজেট হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকার কোনো আলোচনা করেনি।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অর্থ উপদেষ্টা পতিত সরকারের বাজেটের ধারণা নিয়েই এগিয়েছে। সরকার চলতি বাজেটকে কী কী নীতির ভিত্তিতে সংশোধন করলো, তা বুঝা গেল না। পরোক্ষ করের উপর নির্ভরশীলতা কমানো হলো কিনা, ভর্তুকি, সুদ পরিশোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোন কোন নীতি নেয়া হলো- এগুলো সংশোধনের সময় সরকার কিছুই বললো না। অন্যদিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৪০ শতাংশই ভুয়া বলে আমরা শ্বেতপত্রে দেখিয়েছি। এডিপি কোন নীতিমালার ভিত্তিতে সংশোধন হলো, মেগা প্রকল্প কোনটা বাদ দেয়া হলো, কোনটার মূল্য সংশোধন করা হলো সেগুলোও বুঝলাম না।
পাঠকের মতামত
অংক কমবেশি করে কপি পেস্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে! কিন্তু গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারের কাছে গণমুখী বাজেটের প্রত্যাশা ছিল সর্ব মহলের।