দেশ বিদেশ
মর্মান্তিক মৃত্যু রহস্যে ঘেরা
নাটোর প্রতিনিধি
১৫ আগস্ট ২০২২, সোমবার
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় থেকে প্রেম অতঃপর বিয়ে। আর সেই বিয়েও ভাইরাল হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিয়ের পর সংসারের স্থায়িত্ব ধরা দিলো না সুখের বাসর হয়ে তাদের জীবনে। বছর না ঘুরতেই মর্মান্তিক মৃত্যুতে পরিসমাপ্তি হলো একটি অসম প্রেমের। ৪৭ বছরের কলেজ শিক্ষিকার জীবনের অবসান ঘটলেও এ মৃত্যু নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে জনমনে। আর সেই প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে ২২ বছরের মামুন হোসেনকে আটক করেছে পুলিশ। এদিকে রাত আড়াইটার দিকে মামুনকে শহরের স্টেশন এলাকায় ঘুরতে দেখা গেছে বলে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন।
গতকাল ভোররাতে নাটোর শহরের বলারীপাড়ার ভাড়া বাসার ৪তলায় সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে নাহার আত্মহত্যা করেন বলে মামুন দাবি করেছেন। তবে হত্যা না আত্মহত্যা বিষয়টি নিশ্চিত হতে ভবনের অন্য বাসিন্দারা স্বামী মামুনকে আটক করে রাখলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে। মামুন-নাহার দম্পতি নাটোর শহরের বলারীপাড়ার হাজী নান্নু মোল্লা ম্যানশনের ৪তলায় ভাড়া থাকতেন।
ওই ভবনের সিকিউরিটি গার্ড নিজাম উদ্দিন জানান, মামুন ও নাহার গত রাত ১১টার দিকে বাইরে থেকে বাসায় প্রবেশ করে। পরে রাত ২টার দিকে মামুন গেটে নক করে একটু প্রয়োজনের কথা বলে বাইরে চলে যায়। রাতে তিনি আর বাসায় ফেরেননি। গতকাল ভোর ৬টার দিকে মামুন বাসায় প্রবেশ করে। এর কয়েক মিনিট পরেই নাইটগার্ডকে সে ডাকতে ডাকতে নিচে আসে। পরে নাইটগার্ড গিয়ে নাহারের দেহ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলতে দেখে। পরে মামুন ফ্যান থেকে নাহারের মরদেহ নামায়। বিষয়টি নৈশপ্রহরী ভবনের মালিককে জানালে মালিক ওই ভবনে ভাড়া থাকা একজন বিচারককে জানালে তিনি পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করেন। পরে পুলিশ গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে।
ভবনের বাসিন্দা ও এলাকাবাসী জানান, মামুন অন্যদের জানান, স্ত্রী খুবজিপুর ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক খায়রুন নাহার শেষরাতে আত্মহত্যা করেছেন। লোকজন তার বাসায় গিয়ে খায়রুন নাহারের লাশ মেঝেতে শোয়া অবস্থায় দেখতে পেয়ে তাদের সন্দেহ হওয়ায় তারা মামুনকে বাসায় আটকে পুলিশে খবর দেন। সহকারী অধ্যাপক খায়রুন নাহার গুরুদাসপুর উপজেলার চাঁচকৈড় পৌর এলাকার মো. খয়ের উদ্দিনের মেয়ে। তার স্বামী মামুন হোসেন একই উপজেলার ধারাবারিষা ইউনিয়নের পাটপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে ও নাটোর নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা সরকারি কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। এর আগে ৬ মাসের প্রেমের পর স্বামী পরিত্যক্তা দুই সন্তানের জননী খায়রুন নাহার গত বছরের ১২ই ডিসেম্বর কাজী অফিসে গিয়ে দুজন গোপনে বিয়ে করেন। বিয়ের ৬ মাস পর গত জুলাই মাসে ঘটনাটি এলাকায় জানাজানি হলে বেশ আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়।
নাটোর থানার অফিসার ইনচার্জ মো. নাছিম আহমেদ বলেছেন, বিষয়টি তারা তদন্ত করছেন। তদন্ত ও লাশের ময়নাতদন্ত হলে এটা হত্যা নাকি আত্মহত্যা তা নিশ্চিত হওয়া যাবে। এ ঘটনার পর পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা, পিবিআই এর জেলা পুলিশ সুপার শরিফ উদ্দিনসহ পুলিশ ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এদিকে মেয়ের চাচাতো ভাই সাব্বির উদ্দিন জানান, তাদের ফোনে তার বোন আত্মহত্যা করেছে বলে খবর দেয় মামুন। খবর পেয়ে তারা এসে তার বোনের মরদেহ মেঝেতে শোয়া অবস্থায় পেয়েছেন। তার গলায় একাধিক দাগ আছে। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে দাবি তার। এর বিচার চান তিনি। চাচাতো ভাই সাব্বির ও সাব্বিরের স্ত্রী নূরজাহান বলেন, এই বিয়েকে স্বীকৃতি দেননি নাহারের পরিবার ও সন্তানরা।
এদিকে বিয়ের পর থেকেই আলোচনা সমালোচনার জন্ম দেয় অসম এই বিয়ে ও প্রেমের। এছাড়া পারিবারিক স্বীকৃতি না পেয়ে সন্তান ও পরিবার থেকে দূরে থাকায় মানসিক চাপে ছিলেন নাহার। এছাড়া মামুনও নেশায় আসক্ত ছিলেন বলে অনেকেই এই প্রতিবেদককে জানান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রত্যক্ষদর্শী গত শনিবার রাত আড়াইটার দিকেও শহরের স্টেশন এলাকায় ঘুরতে দেখেছেন মামুনকে। স্থানীয়দের বরাত দিয়ে তিনি বলেন , মামুন ওই এলাকায় গিয়ে মাদকসেবী ও বিক্রেতাদের সঙ্গে ঘোরাফেরা করেন। গতরাতেও সে মাদক সেবন করতেই স্টেশন এলাকায় যান বলে স্থানীয়রা জানান। আর শনিবার রাত ১১টায় বাসায় ফিরলেও পরে ২টার দিকে নৈশপ্রহরীকে ওষুধ কেনার কথা বলে বাইরে যায়। মামুন পুলিশকে জানিয়েছে, সে ঘুরে এসে ভোরে বাসায় ঢুকলে নাহারের মরদেহ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলতে দেখেন। তড়িঘড়ি করে সেই মরদেহ নামায় মামুন। গলায় পেঁচানো ওড়না কাটার কোনোকিছু না পেয়ে আগুনে ওড়না পুড়িয়ে মরদেহ নামায় সে।
এর আগে ঘটনার পর থেকেই নানা নেতিবাচক সমালোচনা ছিল মামুন হোসেনের বিরুদ্ধে। সেসব সমালোচনা আরও প্রকট আকার ধারন করলো নাহারের এই রহস্যে ঘেরা মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। মন্তব্য কখনো গন্তব্য ঠেকাতে পারে না এমন ডায়ালগে পরিচিতি পাওয়া মামুনের গন্তব্যের ভবিষ্যত কী তা জানা যাবে নাহারের ময়নাতদন্ত শেষে। পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেছেন, এই মরদেহ নামানোর মধ্যেও কোনো দুরভিসন্ধি আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ময়নাতদন্তের পর সঠিক কারণ জানা যাবে। তবে বিষয়টি মোটামুটি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ।