ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

মোমেনের ‘ফতোয়ায়’ তোলপাড়

স্টাফ রিপোর্টার
১৪ আগস্ট ২০২২, রবিবার
mzamin

এমনিতেই নিত্যপণ্যের দাম ছিল চড়া। জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি চড়া বাজারে নতুন আগুন ছড়িয়েছে। নিত্যপণ্যের চড়া দামে নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ  মানুষের। এমন অবস্থার মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের ‘বেহেশত’ ফতোয়ায় তোলপাড় দেশজুড়ে। শুক্রবার সিলেটের এক অনুষ্ঠানে তিনি অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করে বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে। মন্ত্রীর এই বক্তব্য প্রচারের পর নিত্যপণ্যের দামে পিষ্ট মানুষের পক্ষ থেকে নানামুখী প্রতিক্রিয়া এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাসছে নেতিবাচক ট্রলের। বিরোধী রাজনৈতিক নেতারাও মন্ত্রী মোমেনের বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছেন। মন্ত্রীর এমন বক্তব্যে বিব্রত দলের অনেক নেতাকর্মীও। 

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয় উল্লেখ না করলেও গতকাল আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলের নেতাকর্মীদের কথাবার্তায় আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, তার এ বক্তব্য জনগণের সঙ্গে উপহাস।

বিজ্ঞাপন
জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের উপনেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, দেশের মানুষ কষ্টে আছে। বেহেশতে আছেন কেবল সরকারের মন্ত্রী এবং এমপিরা। 

ব্যাপক সমালোচনার মুখে মন্ত্রী মোমেন অবশ্য গতকাল তার বক্তব্যের একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করতে গিয়ে তিনি বেহেশতের উদাহরণ দিয়েছেন। তার মতে প্রতিবেশী অনেক দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের চাইতে বাংলাদেশের মানুষ ভালো আছে। 

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য প্রচারের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বেশি প্রতিক্রিয়া এসেছে। অনেকে মুসলিম শরীফের ২৯৫৬ নম্বর হাদিসটি সামনে এনেছেন যা অন্যান্য হাদিস গ্রন্থেও রয়েছে। এই হাদিসটি পোস্ট করে তারা মন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে ট্রল করেছেন। ‘বেহেশতে থেকেও কেন একজন মা, তার সন্তানকে বিক্রি করে দিতে চান? অনাহার আর অভাব অনটনের কারণে। এটা কেমন বেহেশত? সরকার ও রাষ্ট্রপক্ষের প্রতি জাতির জিজ্ঞাসা।’ 

মন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত করে নিজের ফেসবুকে এমনটাই লিখেছেন ইলিয়াস ভুঁইয়া নামে একজন ব্যবহারকারী। সোহানুর রহমান শাওন হাওলাদার লেখেন, ‘বেহেশতে ব্রয়লার মুরগির কেজি ২১০ টাকা, ডিমের হালি ৬০ টাকা। বেহেশত নিয়ে ফাইজলামি করবেন না। কারণ জান্নাতের তুলনা জান্নাত। আল্লাহ মাফ করুন। জান্নাতের তুলনা কোনো কিছুর সঙ্গে দিবেন না।’

 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল তার ফেরিফাইড ফেসবুকে লেখেন, বৈশ্বিক মন্দার এই সময়ে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। এই বেহেশতে অচিরেই আপনার থাকার সুযোগ হোক, এই দোয়া করলাম।’ আবার একাধিক ব্যক্তি লিখেছেন বেহেশতের বিভিন্ন এলাকা থেকে বলছি। সেইসঙ্গে বিভিন্ন দ্রব্যমূল্যের দাম উল্লেখ করে দিয়েছেন পোস্ট। আবার লোডশেডিংকে সামনে এনেও করেছেন হাস্যরস। 

চা শ্রমিকদের প্রসঙ্গ তুলে আলিম উদ্দিন লেখেন, ‘বেহেশতে চা শ্রমিকরা দৈনিক ৩০০ টাকার দাবিতে আন্দোলন করেন। আহারে বেহেশতো। যে বেহেশত একজন শ্রমিককে দৈনিক ৩০০ টাকাও দেয় না।’ রিয়াদ হোসেন নামে একজন লেখেন, ‘বেহেশতে ডিম, ডাল, করলা ভাজি দিয়া ভাত খাইলাম ৮৮ টাকা দিয়া।’  

আরিফ আর হোসেন লেখেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন ‘বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে। কিন্তু বেহেশত আবার তার চলার জন্য লোন চাচ্ছে আইএমএফের কাছে। ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেল না স্যার?  অঙ্ক ক্লাসে ধর্ম নিয়ে এসেছেন, এখন আপনিই উত্তরটা মিলায়ে দেন।’

 ইমরান আলী তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘বেহেশতের ঢাকা ব্রাঞ্চের অধীনে পরিচালিত মিরপুর উপশাখা থেকে বলছি। আপনি বেহেশতের কোন ব্রাঞ্চে আছেন ভাই? সরি শুনতে পাচ্ছি না কোন ব্রাঞ্চ? ওহো, আপনার ওখানে বোধহয় নেটওয়ার্ক প্রবলেম। না ভাই, নেটওয়ার্ক প্রবলেম না, কারেন্ট চলে গেছে তো বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছি।  আপনাদের ওখানেও কারেন্ট যায়, বলেন কি? তা ভাই বেহেশতের ব্রাঞ্চ বদল করেন না কেন? আমাদের ব্রাঞ্চে আসেন...’  

ব্যাখ্যা দিলেন মোমেন: ‘আমরা সুখে আছি, বেহেশতে আছি’ মন্তব্যের পর আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। সাংবাদিকরা বিষয়টি নিয়ে ‘টুইস্ট করার চেষ্টা’ করেছেন এবং ‘এক্কেবারে উল্টা’ লিখেছেন- এমন অভিযোগ করেন তিনি। গতকাল দুপুরে সিলেটে একটি অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তখন সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করতে গেলে তিনি ‘বেহেশতে আছি’ প্রসঙ্গটির অবতারণা করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বেহেশতের কথা আমি বলেছি, কম্পারেটিভ টু আদার কান্ট্রি (অন্য দেশের তুলনায়)...আর আপনারা সব জায়গায় বেহেশত বলেছেন...মানে টুইস্ট করার চেষ্টা...বলেন নাই যে, আমাদের মূল্যস্ফীতি অন্য দেশের তুলনায় কম।  তখন উপস্থিত সাংবাদিকরা বলেন, আপনি গতকাল যা বলেছেন, তাই অন-এয়ার হয়েছে।  এরপর মোমেন বলেন, মুদ্রাস্ফীতি ইংল্যান্ডে ১২ ভাগ, টার্কিতে ৬৭ ভাগ, পাকিস্তানে ৩৭ ভাগ, শ্রীলঙ্কায় ১৫০ ভাগ আর আমরা সাত ভাগ...সেই দিক দিয়ে আমরা ভালো আছি।  আমি বলেছি, অন্য দেশের তুলনায় আমরা অনেক ভালো আছি। এবং তাদের তুলনায় আমরা বেহেশতে আছি, এই কথা বলেছিলাম। কিন্তু আপনারা এক্কেবারে উল্টা! যাই হোক।  

মন্ত্রী বচন:এর আগে গত বুধবার জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়া সাময়িক মন্তব্য করে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, গ্রামগঞ্জের কোনো মানুষ না খেয়ে নেই। প্রত্যেকটি মানুষ খেতে পারছে। প্রত্যেক মানুষের গায়ে জামাকাপড় আছে। গ্রামের প্রায় সব রাস্তাঘাট পাকা হয়ে গেছে। প্রত্যেক গ্রামে প্রাইমারি স্কুল করা হয়েছে, ঘর না থাকলে ঘর করে দেয়া হচ্ছে (বিডিনিউজ, ১০ই আগস্ট)। একইদিন সুনামগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, বাংলাদেশকে গোলামি থেকে মুক্ত করে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। কিছু মানুষ আছে, আমাদের পছন্দ করে না। তারা বলছে, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, মানুষ মরে যাবে। তবে আমরা অস্বীকার করবো না। জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বেড়েছে- এটা সত্য। 

কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বাড়ার ফলে এখনো কেউ মারা যায়নি, আশা করি মরবেও না (ঢাকা পোস্ট, ১০ই আগস্ট ২০২২)। এর আগে দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নিয়ে মন্তব্য করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। গত জুনে নিজ মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, দেশের সাড়ে চার থেকে পাঁচ কোটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ইউরোপের দেশগুলোর মতো (প্রথম আলো, ২রা জুন ২০২২)। বাণিজ্যমন্ত্রীর এ বক্তব্যের তিন দিন আগে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম বলেছেন, দেশের মানুষ এখন চাইলে তিন বেলা মাংস খেতে পারে। দেশের বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে (প্রথম আলো, ২৮শে মে, ২০২২)।    

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status