দেশ বিদেশ
সংস্কারক ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় রয়টার্সের দুই সাংবাদিক
সিরাজুল ইসলাম কাদির
১২ মে ২০২৫, সোমবার
২০১৩ সালের ১০ই ডিসেম্বর রয়টার্স কর্তৃপক্ষ লন্ডন থেকে মাইক কালেট হোয়াইট (Mike Collet-White)-কে ঢাকায় পাঠান আমাদের সহযোগিতা করার জন্যে। তিনি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের অন্যতম প্রধান বার্তা সম্পাদক। হালকা-পাতলা গড়নের এই ব্রিটিশ নাগরিক অত্যন্ত সাদাসিধে স্বভাবের একজন মানুষ। বন্ধুপরায়ণ, সদালাপী এবং কোমল স্বভাবের। অত্যন্ত উঁচুমাপের এই সম্পাদক অনায়াসেই আমাদের মনোযোগ কেড়ে নিয়ে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি এসেই জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম প্রভাবশালী নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশনে আমাদের সঙ্গে হাত মেলান।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যেসব মানুষ যুদ্ধাপরাধ করেন তাদের বিচার করার জন্যে বাংলাদেশ সরকার একুশ শতকে পা রেখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ((International Crimes Tribunal) গঠন করে। ২০১১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এই আদালতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়। তার বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন দুষ্কর্মে সহায়তা করার অভিযোগ আনা হয়। আরও অভিযোগ ছিল অপ্রাপ্ত বয়স্কসহ বিভিন্ন নারী ধর্ষণ এবং ঢাকার উপকণ্ঠে মিরপুরে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করা।
আব্দুল কাদের মোল্লার রায় নিয়ে এক ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে আইসিটি-র আইনজীবীর মধ্যেকার কথাবার্তা এবং যে ই-মেইল চালাচালি হয় তা The Economist প্রকাশ করে। এর ফলে বাংলাদেশ সরকার দ্রুত রায় প্রদানের জন্যে আইসিটি-র ওপর যে চাপ প্রয়োগ করেছিল সেই তথ্য বেরিয়ে আসে। এই তথ্য প্রকাশের পর বিচারক নিজামুল হক পদত্যাগ করেন। এই রায় মানবাধিকারের লংঘন- এই মর্মে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক এবং অস্ট্রেলিয়া উদ্বেগের কথা জানায়। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের বিশেষজ্ঞরা এই মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করার আহ্বান জানান এই বলে যে আব্দুল কাদের মোল্লা সঠিক বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
১১ই ডিসেম্বর আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাকা হয়। কারা মহাপরিচালক মঈন উদ্দীন খন্দকার তখন সাংবাদিকদের জানান, ফাঁসির মাধ্যমে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। মোল্লার পরিবারকে শেষ বারের মতো সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হয়। মোল্লা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে অস্বীকার করেন-যদিও কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে তাকে তিনবার প্রস্তাব দেন।
মোল্লার আইনজীবীরা এই দণ্ডাদেশ বন্ধ করে তাকে আদালতে আবেদন করার অনুমতি দেয়ার জন্যে সুপ্রিম কোর্টের প্রতি নিবেদন জানান। এই নিবেদনে আইনজীবীরা যুক্তি দেখিয়ে বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান সকল মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে এ ধরনের আবেদন করার অধিকার দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার জজ সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এসব যুক্তি আমলে নিয়ে মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করে মোল্লাকে ২০১৩ সালের ১১ই ডিসেম্বর আবেদন করার অনুমতি দেন। আর এই অনুমতিপত্র মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন ও চূড়ান্ত হওয়ার মাত্র ৯০ মিনিট আগে প্রদান করা হয়। দুই ঘণ্টাব্যাপী শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি মুজাম্মেল হোসেন পরের দিন পর্যন্ত শুনানি স্থগিত করেন। বিবাদী আত্মপক্ষ সমর্থন করে যেসব যুক্তি দেখান তার মধ্যে অন্যতম ছিল যে, রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় সকল আইনগত পদ্ধতি সম্পন্ন না করে এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বিবাদীর আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। বিবাদী মৃত্যুদণ্ডের রায় পর্যালোচনার জন্যে আবেদন জানিয়েছিলেন। এ সময় রাষ্ট্রের প্রধান কৌঁসুলি মাহবুবে আলম রয়টার্সকে বলেন, “কাদের মোল্লার রায় কার্যকর করার ক্ষেত্রে আর কোনো অন্তরায় নেই। আর এর মধ্যে কোনো সংশয় নেই।” অন্যদিকে বিবাদীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন এ প্রসঙ্গে রয়টার্সকে বলেন: “আমার মক্কেল ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তবে যেহেতু সর্বোচ্চ আদালত এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাই আমাদের নতুন করে আর কিছু বলার নেই।”
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর শাহবাগে ইতিপূর্বে সমবেত হওয়া হাজার হাজার বিক্ষোভকারী তাদের সন্তোষ ও আনন্দ প্রকাশ করেন। ২০১৩ সালের পাঁচ ফেব্রুয়ারি থেকে এসব লোক কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড দেয়ার দাবি করে বিক্ষোভ করে আসছিল। মৃত্যুদণ্ডের রায় এবং এই রায় কার্যকর করার পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বিক্ষোভ করে এবং দলটি ২০১৩ সালের ১১, ১২ এবং ১৫ই ডিসেম্বর সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। এই বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ চলাকালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অন্তত ২৫ ব্যক্তি নিহত এবং বহু লোক আহত হয়। জামায়াত কর্মীরা সরকার সমর্থক লোকজনের ঘরবাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন ধরিয়ে দেন। এ ছাড়া তারা বিভিন্ন রেলস্টেশনে বোমা নিক্ষেপ এবং সড়কসমূহে অবরোধ করে। দলটি এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করাকে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বলে অভিহিত করে এবং মোল্লার রক্তের বিপরীতে প্রতিবিন্দু রক্তের প্রতিশোধ নেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দু’জন কর্মীকে কলারোয়ায় হত্যা করা হয়। এ ছাড়া পুলিশ ও জামায়াত সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে আরেক ব্যক্তি নিহত হন নোয়াখালীতে। একজন গাড়িচালকও জামায়াতের প্রতিবাদ চলাকালে সংঘর্ষে প্রাণ হারান। এ ধরনের সহিংসতা এবং ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সহিংস সংঘর্ষ অব্যাহত থাকার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সহিংসতা স্তব্ধ করে দেয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। নির্বাচনের আগে চলমান সহিংসতা এবং বিরোধী দলের সড়ক অবরোধের ফলে দেশের অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতির সৃষ্টি হয়। এই সংঘর্ষ আরও ছড়িয়ে পড়ারও আশঙ্কা সৃষ্টি হয়।
মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর এ সংক্রান্ত সংবাদ রয়টার্স, এএফপি এবং বিবিসিসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা প্রচার করে। তবে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে এই সংবাদ ততটা গুরুত্বসহকারে স্থান পায়নি। বিভিন্ন দেশের সরকারের পক্ষ থেকেও সেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়নি। চীন যদিও মৃত্যুদণ্ড হরহামেশা কার্যকর করে। দেশটি কোনো পর্যায়েই আনুষ্ঠানিক বা সরকারি বিবৃতি দেয়নি। বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রতিবেশী দেশ এবং গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য শরিকদার ভারত সরকারও এ ব্যাপারে নীরব ছিল। তবে ভারতের সংবাদ মাধ্যম মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার খবর ব্যাপকভাবে প্রচার করে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিরুদ্ধে লন্ডন এবং পাকিস্তানে প্রতিবাদ হয়।
আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর মাইক জামায়াতে ইসলামীর সহকারী মহাসচিব ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এবং ডা. আব্দুল আলীম চৌধুরীর কন্যা নুজহাত চৌধুরীর পৃথক পৃথক সাক্ষাৎকার নেন রয়টার্সের জন্যে। ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী ছিলেন বিশিষ্ট চক্ষু চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকবাহিনীর পতনের আগ মুহূর্তে ১৪ই ডিসেম্বর দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। তিনিও তখন শহীদ হন।
১১ই ডিসেম্বর রাতে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ নির্ধারিত ছিল। আমরা সেভাবে ধানমণ্ডিতে তার বাসভবনে যাই। আমাদের ধারণা ছিল তার এপার্টমেন্টে প্রবেশের সময় ভবন রক্ষীদের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু বাস্তবে কোনো প্রশ্ন বা বাধা ছাড়াই আমরা তার গৃহে প্রবেশ করি। প্রায় আধা ঘণ্টার এই সাক্ষাৎকারে তিনি মাইককে এক রকম নিশ্চিত করে বলেন যে, আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কোনোভাবেই রহিত করা যাবে না। তিনি নিজেও মোল্লার অন্যতম আইনজীবী হিসেবে আদালতে লড়াই করেন। মাইক আগামীদিনে জামায়াতের রাজনৈতিক পথরেখা এবং পরিণতি কী হবে জানতে চাইলে রাজ্জাক বলেন, ‘বর্তমান নেতৃত্ব নিয়ে নতুন প্রজন্ম কোনো আশা দেখে না। তাদের বক্তব্য হচ্ছে নতুন নেতৃত্ব যাতে জামায়াতকে তার আদর্শের পথে পরিচালিত করতে পারে সরকারের উচিত সেই সুযোগ তৈরি করে দেয়া। কারণ এই নবীন প্রজন্ম কোনোভাবেই ৭১-এর প্রেক্ষাপটের সঙ্গে যুক্ত নয় এবং তারা মনেপ্রাণে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গ্রহণ করেছেন। তারা নিজেদের এই দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন এবং সম্মানিত বোধ করেন।’ ব্যারিস্টার রাজ্জাকের আলাপচারিতায় মনে হলো তিনি জামায়াতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে দলের নেতৃত্বে বদল এবং সংস্কারের পক্ষে। তিনি উদারপন্থি রাজনৈতিক আদর্শের ভাবধারায় বিশ্বাসী।
[সিরাজুল ইসলাম কাদির রচিত এবং ইউপিএল থেকে প্রকাশিত
“রয়টার্সের দিনগুলো: বাংলাদেশ ডায়েরি ১৯৯৬-২০১৯” গ্রন্থ থেকে সংকলিত]