ঢাকা, ১২ মে ২০২৫, সোমবার, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৩ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

দেশ বিদেশ

একজন অজাতশত্রুর কথা

ড. নেহাল করিম
১২ মে ২০২৫, সোমবার
mzamin

প্রতিটি মানুষের জীবনের চলার পথে কিছু দেখা, কিছু স্মৃতি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে গেঁথে থাকে। আত্মীয়-অনাত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে এমন কেউ থাকেন, যিনি তাদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে সমস্ত সত্তা জুড়ে থাকেন। এমনি একজন যাহেদ করিম স্বপন যে আমার সমস্ত সত্তা জুড়ে আছে এবং আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থাকবে। তার জন্ম তারিখ ১৯৫৪ সনের ৯ই মে। ঢাকা সেন্ট গ্রেগোরিস হাই স্কুল থেকে এসএসসি, নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রাপ্ত হয়েছিল। পরবর্তীতে ঢাকা ল’ কলেজ থেকে এলএলবি পাস করে হাইকোর্টে নিবন্ধিত হয়।

স্বপন এমন একজন ব্যক্তি, যে ছিল অজাতশত্রু। তার পরিচিতজন বা আত্মীয়স্বজন বা বন্ধু-বান্ধব কেউ বলতে পারবে না স্বপন কারোর সঙ্গে অশালীন আচরণ বা দুর্ব্যবহার করেছে বা ঠকিয়েছে। সে শুধু আদর্শবান ছিল না, নীতি-নৈতিকতায় ছিল দৃঢ়চিত্তের অধিকারী। তার যেমন ধৈর্য ছিল, তেমনি ছিল কায়িক পরিশ্রম করার শক্তি ও আগ্রহ। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই স্বপন ছিল এমন একজন মানুষ যে অত্যন্ত সৎ, সত্যবাদী, নিরঅহঙ্কার, অমায়িক, পরোপকারী, বন্ধুবাসল্য এবং চরম  ধৈর্যশীল ও মানবিক গুণের অধিকারী এক বাস্তব উদাহরণ। 

এতক্ষণ যার কথা বললাম সে হচ্ছে আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠ এবং আমাদের অত্যন্ত স্নেহের সে এত উদার ও মহৎ প্রাণের মানুষ ছিল তা নিম্নের কয়েকটি উদাহরণ থেকে বোঝা যাবে। আমাদের বড় ভাই মাহমুদ করিম রিজভী ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনে চিকিৎসার্থে স্বপন বড়ভাইকে পর্যায়ক্রমে ৪০ লাখ টাকা দিয়েছিল। আমার স্ত্রী বেলী যখন আমেরিকাতে ছিলেন সেখানে তিনি ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হন; অসুস্থতার খবর শুনে আমাকে ২০ লাখ টাকা নিয়ে এসে বললো, এই টাকা দিয়ে তুমি ভাবীর চিকিৎসা করাও। এ ছাড়া সে আত্মীয় এবং অনাত্মীয় অনেককেই বিভিন্ন সময়ে তাদের প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্য করেছে। বাড়িতে খাওয়ার টেবিলে আমরা সবাই একসঙ্গে বসতাম; কোনো সময় আমাদের কারোর যদি কোনো তরকারি পছন্দ না হতো আমরা তা নিয়ে চেঁচামেচি করতাম, কিন্তু স্বপন কোনো সময়ে এনিয়ে উচ্চ-বাচ্য করেনি। খাওয়ার টেবিলে যা পেতো বা থাকতো তা বিনা বাক্যব্যয়ে খেয়ে নিতো। দুঃখ হয় স্বপনের মতন এমন এক মানবিকসম্পন্ন ব্যক্তির দাম্পত্য জীবন ছিল খুবই বেদনাময়। সে নিঃসন্তান ছিল। বাড়িতে স্বপনের কোনো বন্ধুদের প্রবেশাধিকার ছিল না। আমরা নিজেরা স্বপনের জন্য দুঃখ করতাম; তার মতো অমায়িক ব্যক্তির জীবনে কী দুর্ভোগ। স্বপন নিজেও আমাদের কাছে কোনোদিন ঘরের অশান্তির কথা আলোচনা করেনি। অনেক পরে তার ঘনিষ্ঠজন ও কয়েকজন বন্ধুর কাছে তার বৈবাহিক জীবনের বিড়ম্বনার কথা বলতো। মানসিক অশান্তি তাকে শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল।  স্বপন ছিল আমাদের পিতা ড. আহমদ শরীফের সমস্ত সাহিত্য ও গবেষণা কর্মের তথ্য ভাণ্ডার। যেকোনো বিষয়ে, কারও কোনো তথ্যের প্রয়োজনে স্বপনের দ্বারস্থ হতো। আমি নিজেও লেখালেখির ব্যাপারে স্বপনের উপর নির্ভরশীল ছিলাম। আমাদের পিতা প্রয়াত হওয়ার পর তার ৪৩টি প্রকাশিত প্রবন্ধের বই থেকে বিষয়ভিত্তিক বিন্যাস করে মোট ২৭টি বই প্রকাশ করেছি। বলতে দ্বিধা নেই,  এক্ষেত্রে স্বপনের সহযোগিতা ছাড়া আমি একটি বইও সংকলন বা সম্পাদনা করতে পারতাম না। 

স্বপন আইন ব্যবসায় যতটা মনোযোগী ছিল তার থেকে বেশি উৎসাহী ছিল সমাজ রূপান্তরের ক্ষেত্রে। প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে যোগাযোগ ছিল বামধারার বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে। তার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা পরিবারের কেউ জানতো না এবং সে নিজেও কাউকে জানায়নি। বাম রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক নথিপত্র ছাড়া দলীয় বা জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক বিষয়ের উপর প্রায় সব প্রচারপত্র তার সংগ্রহে ছিল। অনেক বাম নেতা তথ্য সংগ্রহের জন্য তার সাহায্য নিতো। স্বপনের সংগ্রহে বহু মূল্যবান বই ও রাজনৈতিক দলের প্রায় ৫০ বছরের উপরে পুরনো প্রচারপত্র তার সংগ্রহে ছিল, যা অত্যন্ত অমূল্য সম্পদ এবং উচ্চতর গবেষণার জন্য অত্যন্ত সহায়ক। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রচারপত্র, গঠনতন্ত্র ও লিফলেট সংগ্রহে রাখা ছিল তার অন্যতম শখ।  বলতে কোনো দ্বিধা নেই, অনেক বামপন্থি রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাদের কাছে আমি স্বপনের ভাই হিসেবে পরিচিত ছিলাম।  সে নিজে সজ্জন ও অমায়িক ব্যক্তি ছিল বলে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ছিল। প্রত্যেকের মতন তার নিজস্ব জগৎ ছিল। বিশেষ করে তার চিন্তা-চেতনা ছিল মানবতা ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনে। স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল ছিল না, খুব অবহেলা করেছে; এমন কি পরিবার থেকেও তেমন কোনো সাহায্য- সহযোগিতা পায়নি, বহুমূত্র রোগে ভুগছিল, সঙ্গে চোখেও ছানি পড়েছিল। বহুমূত্র রোগের কারণে চোখের ছানি অপারেশন করানো যায়নি। আবার অন্যদিকে ‘কিডনি’ অকেজো  হতে থাকে  এবং  ক্রমান্বয়ে শরীর দুর্বল হতে থাকে। প্রায়শ সে শুয়ে থাকতো। ক্রমান্বয়ে বাইরে যাওয়া কমিয়ে দিতে থাকলো। কিছুকাল সে বাড়ির সামনের রাস্তায় হাঁটতো, কোনো কোনো সময় ছাদেও হাঁটাহাঁটি করতো। ডাক্তারের চেম্বারে আসা-যাওয়া করতো। তবে মে ২০২৪ থেকে ঘন ঘন হাসপাতালে ভর্তি থাকতো। অক্টোবর থেকে একনাগাড়ে তিন মাস হাসপাতালে থেকে অবশেষে ২০২৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর রাত ১০টা ২০ মিনিটের সময় সে না ফেরার দেশে চলে যায়। স্বপন চলে যাওয়ার পর আত্মীয় পরিজন, ওর পরিচিতজন সবাই একবাক্যে তার অভাব অনুভব করেছে এবং বলেছে ওর মতন সহজ সরল ও পরোপকারী মানুষ বিরল। তার প্রয়াণে তার পরিচিতজনরা বলেছেন ‘স্বপনের তিরধানে ড. আহমদ শরীফের তথ্য ভাণ্ডার চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। দুঃখ এই, স্বপন আমাদের পরে এসে, আমাদের আগে চলে গেল।
লেখক: প্রাক্তন চেয়ারম্যান, সামাজিকবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল:[email protected] 

দেশ বিদেশ থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

দেশ বিদেশ সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status