প্রথম পাতা
হেফাজতের সমাবেশ থেকে ১২ দফা দাবি
স্টাফ রিপোর্টার
৪ মে ২০২৫, রবিবারনারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিলসহ চার দফা দাবিতে গতকাল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করেছে হেফাজতে
ইসলাম। হেফাজতের আমীর মাওলানা শাহ্ মুহিব্বুল্লাহ্ বাবুনগরীর সভাপতিত্বে সমাবেশে নারী কমিশনের প্রতিবেদন বাতিল, ধর্মীয় সংস্কৃতি সংরক্ষণ, সংবিধানে আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস বহাল এবং স্বাধীনতা ও ইসলামবিরোধীদের বিচার এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করাসহ ১২ দফা দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
সমাবেশে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী। তিনি বলেন, সম্প্রতি নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন কোরআনবিরোধী প্রতিবেদন দাখিল করেছে। সাম্রাজ্যবাদের ফান্ডখোর কুখ্যাত নারীবাদীরা এদেশের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, বিধি-বিধান, ঐতিহ্য ও পরিবারকাঠামো ধ্বংস করার প্রাশ্চাত্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে হুঁশিয়ার করে তিনি বলেন, এনজিওবাদী গোষ্ঠীর প্ররোচনায় এমন কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিবেন না, যা কোরআন-সুন্নাহ্র বিরুদ্ধে যায়। এক্ষেত্রে আমরা কোনো ছাড় দেবো না। এই বিতর্কিত কমিশন ও কোরআনবিরোধী প্রতিবেদন অবিলম্বে বাতিল করে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম অংশীদার আলেম-ওলামার পরামর্শ নিয়ে নতুন কমিশন গঠন করুন।
এদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মহাসমাবেশে হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে নারী সংস্কার কমিশন বাতিল, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক করিডোরের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ১২ দফা ঘোষণাপত্র দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন সংগঠনের মহাসচিব সাজেদুর রহমান। তিনি বলেন, দেশের চলমান ক্রান্তিকালে কিছু জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমরা আজকের এই মহাসমাবেশে হাজির হয়েছি। এই মহাসমাবেশ থেকে হেফাজতের ঘোষণা পেশ করছি। দাবিগুলো হলো-
১. নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন ও তাদের কোরআনবিরোধী প্রতিবেদন অবিলম্বে বাতিলপূর্বক আলেম-ওলামার পরামর্শক্রমে ধর্মপ্রাণ বৃহত্তর নারীসমাজের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে নতুন কমিশন গঠন করতে হবে। নারীর সামাজিক উন্নয়নে পশ্চিমা মূল্যবোধ নয়, বরং আমাদের নিজস্ব সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের আলোকেই বাস্তবমুখী সংস্কারের দিকে যেতে হবে।
২. সংবিধানে ‘আল্লাহ্র ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন করতে হবে এবং ধর্মপ্রাণ গণমানুষের ঈমান-আমল রক্ষার্থে ‘বহুত্ববাদী’ নামক আত্মঘাতী ধারণা থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। এ ছাড়া ‘লিঙ্গ পরিচয়’, ‘লিঙ্গ বৈচিত্র্য’, ‘লিঙ্গ সমতা’, ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ (বা থার্ড জেন্ডার), ‘অন্যান্য লিঙ্গ’ ইত্যাদি শব্দের মারপ্যাঁচে, ‘কাউকে বাদ দিয়ে নয়’ এমন ধোঁয়াশাপূর্ণ স্লোগানের অন্তরালে এবং অসংজ্ঞায়িত ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ (ইনক্লুসিভ) ইত্যাদি শব্দের আড়ালে এলজিবিটি ও ট্রান্সজেন্ডারবাদের স্বীকৃতি ও অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সমাজবিধ্বংসী ও ধর্মবিরুদ্ধ সমকামী-বান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠার পাঁয়তারা বন্ধ করতে হবে।
৩. শাপলা ও জুলাই গণহত্যার বিচারে গতি আনতে ট্রাইব্যুনালের সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগেই ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার চিহ্নিত দোসরদের বিচার সম্পন্ন করতে হবে।
৪. গণহত্যাকারী ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে ঘোষণাপূর্বক বিচার নিশ্চিত করতে হবে। দলটির বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাদের সবধরনের কার্যক্রম ও তৎপরতা নিষিদ্ধ করতে হবে।
৫. আল্লাহ্ ও তার রাসুল (সা.)-এর নামে কটূক্তি ও বিষোদ্গার বন্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির আইন করতে হবে। এ ছাড়া গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে ধর্ম অবমাননার শাস্তি সংক্রান্ত আইনি ধারাগুলো বাতিলের সুপারিশ বাদ দিতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয়া হবে না।
৬. চট্টগ্রামে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে শহীদ সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার উস্কানিদাতা চিন্ময় দাসের জামিন প্রত্যাহারপূর্বক তার দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে হবে।
৭. ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে সারা দেশে প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও ইসলামমনা তরুণদের বিরুদ্ধে হওয়া মিথ্যা ও বানোয়াট মামলাগুলো অতিসত্বর প্রত্যাহার বা নিষ্পত্তি করতে হবে গণ-অভ্যুত্থানের সরকারকে। সেইসঙ্গে ‘জঙ্গি নাটক’ বা ‘জঙ্গি কার্ড’ খেলে বাংলাদেশের ইসলামপন্থি ও আলেম-ওলামার ওপর যারা গত ১৫ বছর নির্যাতন ও গুম-খুন চালিয়েছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
৮. গাজার মুসলমানদের ওপর অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের চলমান গণহত্যা ও ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমাদের গণ-অভ্যুত্থানের সরকারকে কূটনৈতিকভাবে আরও উচ্চকণ্ঠ হতে হবে এবং দেশের সর্বস্তরে জনতাকে ইসরাইলি ও ভারতীয় পণ্য বয়কট করতে হবে।
৯. শিক্ষার সর্বস্তরে ইসলামী শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
১০. রাখাইনকে ‘মানবিক করিডোর’ প্রদানে সরকারের সম্মত হওয়া সম্পূর্ণরূপে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। আমাদের ভৌগোলিক নিরাপত্তার স্বার্থে এ অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে ফিরে আসতে হবে।
১১. চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ভিনদেশি মিশনারীদের অপতৎপরতা ও দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সেখানে নিরাপত্তা সংকট কমাতে আলেম সমাজের দাওয়াতি কার্যক্রমকে আরও নিরাপদ ও সুযোগ করে দিতে হবে। সেখানে সামরিক নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও বৃদ্ধি করা ছাড়াও পাহাড়ি বাঙালি ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক সমঝোতা ও স্থিতি নির্মাণে রাষ্ট্রীয় তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে।
১২. কাদিয়ানীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে এবং সাধারণ মুসলমানদের ঈমান-আকিদা রক্ষার্থে এদের অপতৎপরতা বন্ধ করতে হবে।
সকাল নয়টায় সমাবেশ শুরু হলেও ভোর থেকেই সংগঠনের নেতাকর্মীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসতে থাকেন। সমাবেশ শুরুর আগেই উদ্যানের আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে জনস্রোত। শুরুতে সারা দেশ থেকে আসা নেতারা সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। দুপুরে ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। তার আগে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহও সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।
দাবি আদায় না হলে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করার হুঁশিয়ারি দিয়ে হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীর ও খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের বলেন, যদি দাবি মানা না হয় তাহলে আমরা পরবর্তী সময় আরও কঠিন কর্মসূচি ঘোষণা করবো। তিনি বলেন, আপনাদের বিরুদ্ধে আমাদের নামার ব্যবস্থা করবেন না। যদি জাতি নেমে যায়, হেফাজত নেমে যায় তাহলে কোনো উপদেষ্টা এদেশে থাকতে পারবে না।
তাহরিকে খতমে নবুওয়াত বাংলাদেশের আমীর ড. মাওলানা এনায়েত উল্লাহ আব্বাসী বলেন, বাক-স্বাধীনতার নামে যেই ইসলামের বিরোধিতা করবে তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। জঙ্গি তকমা দিয়ে আমার দেশের আলেম-ওলামাদের কারাগারে রাখা হয়েছে।
মাওলানা এনায়েত উল্লাহ আব্বাসী বলেন, একদিকে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন করে আমাদের অনুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে, অন্যদিকে মানবিক করিডোর দিয়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ওপর আঘাত দেয়া হচ্ছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাহেব অবস্থান পরিষ্কার করুন, মানবিক করিডোরের নামে বাংলাদেশকে ইন্দোপ্যাসেফিক অঞ্চলে যুদ্ধে ঠেলে দেবেন না।
আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, শাপলা চত্বরে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আমি এখানে এসেছি। ২০১৩ সালের পর এই প্রথম আমরা দ্বিতীয় স্বাধীন বাংলাদেশে সমাবেশ করতে পেরেছি। আমি বিস্মিত হেফাজতের পক্ষ থেকে এখনো খুনি হাসিনার বিরুদ্ধে কেন মামলা করা হয়নি। তিনি গাজায় চলমান মানবতাবিরোধী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ার আহ্বান জানান।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, নারী কমিশনের মতো অপ্রয়োজনীয় ইস্যু নিয়ে সময় নষ্ট না করে রাষ্ট্রের প্রকৃত সমস্যা সমাধানে মনোযোগী হতে হবে। মানুষ জীবন দিয়েছে স্বৈরাচার ও ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, নারী কমিশনের জন্য নয়। হেফাজতের নেতাদের প্রতি অনুরোধ নারী ইস্যুতে সীমাবদ্ধ না থেকে বৃহত্তর আন্দোলনে অটল থাকুন। আমাদের প্রধান লড়াই ভারতের আধিপত্যের বিরুদ্ধে।
ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব সাখাওয়াত হোসেন রাজী বলেন, আমরা সংস্কারের পক্ষে, কিন্তু কোনো কোরআনবিরোধী সংস্কার গ্রহণযোগ্য নয়। নারী কমিশনের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করতে হবে। সংবিধান থেকে বহুত্ববাদ বাদ দিয়ে ‘আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনর্বহাল করতে হবে। তিনি বলেন, যদি আমাদের দাবি মানা না হয়, তাহলে আলেম সমাজ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নিবে। তখন জনগণের সমর্থনও থাকবে না, আর তার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। ফ্যাসিবাদী গণহত্যাকারীদের বিচার যেন দৃশ্যমান হয়, সেটিই আমাদের অন্যতম দাবি।
সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন দলটির ঢাকা মহানগরীর সভাপতি জুনায়েদ আল হাবিব, মুফতি হারুন ইজহার, যুগ্ম-মহাসচিব জালালুদ্দিন আহমদ, আহমদ আলী কাসেমী, নাসির উদ্দিন মনির, নায়েবে আমীর খালিদ সাইফুল্লাহ এবং সহকারী মহাসচিব আব্দুল বাসেদ খান প্রমুখ।