প্রথম পাতা
পেহেলগাম ইস্যু
কাশ্মীরের দু’প্রান্তেই চলছে উত্তেজনা
মানবজমিন ডেস্ক
৩ মে ২০২৫, শনিবারকাশ্মীরের উভয় প্রান্তেই চলছে উত্তেজনা। নিজ নিজ জায়গা থেকে শক্তির জানান দিচ্ছে ভারত ও পাকিস্তান। বিশ্ব শক্তিও নড়েচড়ে বসেছে। সবার দৃষ্টি এখন ওইদিকেই। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সাবধান করে দিয়ে বলেছে, পেহেলগাম ইস্যুতে যেন আঞ্চলিক সংঘাত শুরু না হয়। পাকিস্তানকেও এ বিষয়ে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্সও একই বিষয়ে জোর দিয়েছেন। বলেছেন, তিনি আশা করেন ভারত বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধ এড়াতে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবেন। পাশাপাশি পাকিস্তানও এ বিষয়ে সন্ত্রাসীদের খুঁজে পেতে সহায়তা করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ভান্স। এদিকে বৃহস্পতিবার ভারতের সঙ্গে সীমান্তবর্তী লাইন অব কন্ট্রোলের কাছে পূর্ণমাত্রার সামরিক মহড়া চালিয়েছে পাকিস্তান। ওইদিন তারা ট্যাংক, কামান, গোলা নিয়ে এই মহড়া দেয়। সংবাদমাধ্যম এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের প্রতিবেদনে বলা হয়, সেনাবাহিনীর সূত্র জানিয়েছে, এই মহড়া শত্রুপক্ষের যেকোনো আগ্রাসনকে কঠোর জবাব দিতে সাজানো হয়েছে। বুধবার ভারতীয় সেনারা বিনা উস্কানিতে এলওসির কিয়ানি ও মণ্ডল সেক্টর দিয়ে ছোট অস্ত্র দিয়ে গুলি ছুড়ে। জবাবে পাক সেনারা ভারতীয় সেনাদের কয়েকটি চেকপোস্ট ধ্বংস করে দেয়। আর এই গোলাগুলি ও চেকপোস্ট ধ্বংস করার পরই সীমান্তে সামরিক মহড়ার আয়োজন করা হয়। গত ২২শে এপিল ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মিরের পেহেলগামে ২৬ জনকে গুলি করে হত্যা করে বন্দুকধারীরা। এতে পাকিস্তান পরোক্ষভাবে জড়িত এমন অভিযোগ তুলে ভারত। এরপর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। এই প্রেক্ষিতে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু নদ চুক্তি বাতিল ও সীমান্ত বন্ধসহ নানান পদক্ষেপ নেয়। জবাবে পাকিস্তানও ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ এবং সিমলা চুক্তি স্থগিত করে।
এমন পরিস্থিতি উভয়পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বৃহস্পতিবার দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে কথা ফোনে কথা বলেছেন। উভয়পক্ষকেই উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া ফক্স নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রতি আঞ্চলিক সংঘাত এড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যে কূটনৈতিক সংযম ও পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছেন ভান্স। তিনি মনে করেন, চরমপন্থা মোকাবিলায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় অপরিহার্য। পেহেলগাম হামলার সময় মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট তার পরিবারের সঙ্গে ভারত সফরে ছিলেন। ২০১৯ সালে পুলওয়ামায় হামলার পর ভারতের মাটিতে এটিই সবচেয়ে বড় প্রাণঘাতী হামলা। ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে তিনি আরও বলেন, স্পষ্টভাবে বললে, আমরা আশা করি পাকিস্তান যদি আংশিকভাবেও ওই হামলার জন্য দায়ী থাকে- তাহলে তাদের উচিত ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা করা, যাতে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে যেসব সন্ত্রাসী মাঝে-মধ্যে কার্যক্রম চালায়, তাদের খুঁজে বের করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া যায়। পেহেলগাম হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টের এই মন্তব্য রাজনৈতিকভাবে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। হামলার পরপরই এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলেন তিনি। সন্ত্রাসীরা একটি মনোরম তৃণভূমিতে আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিল যেখানে ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর জন্য হাইকিং বা পোনি পরিষেবা ব্যবহার করতে হয়। দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রধারী এই দেশ দু’টির মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সীমান্তে সংঘাতে জড়াতে পারে তারা। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এরপর দুই দেশের উত্তেজনার পারদ আরও তুঙ্গে উঠেছে। অবশ্য জাতিসংঘ এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও উভয় দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এবং সর্বোচ্চ সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন। বুধবার রুবিও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
অমিত শাহের হুঁশিয়ারি: গত বৃহস্পতিবার পেহেলগাম ইস্যুতে প্রথম হুঁশিয়ারি বাক্য উচ্চরণ করেছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তিনি দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন- হামলাকারীদের প্রতিজনকে খুঁজে বের করবে ভারত। তিনি হামলাকারীদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ভয়াবহতা এখনো আসেনি। পেহেলগামে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা যারা করেছে তাদের কোনো রক্ষা নেই। আমরা তাদের প্রতিজন এবং তাদের প্রতিটি মদতদাতাকে খুঁজে বের করবো। মনে করবেন না যে, ২৬ জনকে হত্যা করে আপনারা জিতে গেছেন। আপনাদের প্রত্যেককে জবাব দিতে হবে। আসামের বোরো সম্প্রদায়ের নেতা উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্ম’র একটি মূর্তি উন্মোচনকালে তিনি এসব কথা বলেন।
পেহেলগামের ঘটনা ফের আন্তর্জাতিকভাবে তদন্তের আহ্বান: পেহেলগামে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলায় ভারতের প্রতি ফের আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে পাকিস্তান। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ ওই হামলার বিষয়ে নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্তের জন্য পাকিস্তানের আগের দাবিই পুনর্ব্যক্ত করেছেন। একটি বেসরকারি টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় আসিফ বলেন, যেকোনো নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য পাকিস্তান উন্মুক্ত। সেটি জাতিসংঘের কমিশন হোক কিংবা ভারত ও পাকিস্তানের যৌথ তদন্ত দলই হোক। আসিফ বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্তের প্রস্তাব এখনো বহাল আছে। তিনি বলেন, এটি জাতিসংঘের নেতৃত্বে হোক বা প্রাসঙ্গিক দক্ষতা সম্পন্ন অন্য যেকোনো পক্ষের দ্বারা, আমরা প্রস্তুত। ভারত যদি কিছু গোপন না করে, তবে তারা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত বলেও জোর দেন আসিফ। তিনি অভিযোগ করেন, ভারতের স্বাধীন তদন্তে অনুমতি না দেয়ার পেছনে উদ্বেগের কারণ হলো, এর মাধ্যমে তাদের জন্য অস্বস্তিকর তথ্য উঠে আসতে পারে। আসিফ আরও বলেন, ভারতের দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে তাদের নিজ দেশে সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে। কোনো আন্তর্জাতিক ফোরাম তাদের বক্তব্য সমর্থন করেনি, বরং তারাও পাল্টা প্রশ্ন তুলছে। পাকিস্তান-ভারত সীমান্ত উত্তেজনা সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরে আসিফ বলেন, নয়াদিল্লি স্পষ্টভাবে হতাশা প্রকাশ করছে। তিনি দাবি করেন, মোদির কর্মকাণ্ড পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, যা হিন্দুত্ববাদী আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত। যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি গুরুতর হুমকি।
পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরের বাসিন্দাদের খাদ্য মজুতের নির্দেশ: ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার নিয়ন্ত্রণরেখার নিকটবর্তী পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরের বাসিন্দাদের খাদ্য মজুত করার নির্দেশ দিয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। শুক্রবার এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দাবি, ইতিমধ্যে নিয়ন্ত্রণরেখায় দুই পক্ষের মধ্যে টানা অষ্টম রাতের মতো গোলাগুলি হয়েছে। উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে পাল্টাপাল্টি কূটনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে দুই দেশ। স্থানীয় প্রাদেশিক পরিষদে পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী আনোয়ার উল হক বলেন, নিয়ন্ত্রণরেখা-সংলগ্ন ১৩টি নির্বাচনী এলাকার জন্য দুই মাসের খাদ্য সরবরাহ মজুত করার নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আঞ্চলিক সরকার ওই ১৩টি নির্বাচনী এলাকার জন্য খাদ্য, ওষুধ এবং অন্য মৌলিক চাহিদাগুলোর সরবরাহ নিশ্চিত করতে ১০০ কোটি রুপির (৩৫ লাখ মার্কিন ডলার) একটি জরুরি তহবিল গঠন করেছে। নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর এলাকাগুলোর সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারি ও বেসরকারি মালিকানাধীন যন্ত্রপাতিও মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানান আনোয়ার উল হক। ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে হামলার পর যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে।