ঢাকা, ৩ মে ২০২৫, শনিবার, ২০ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৪ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

ডেঙ্গু বাড়ার শঙ্কা

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
৩ মে ২০২৫, শনিবার
mzamin

রাজধানীতে বর্ষা আসার আগেই বেড়েছে মশার উপদ্রব। ফলে বাড়ছে ডেঙ্গুর শঙ্কাও। নগরবাসীর অভিযোগ, কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় এমন পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন তারা। তবে সিটি করপোরেশন বলছে, এরইমধ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগ এডিশ মশা ঠেকাতে নানা উদ্যোগের কথা জানিয়েছে। বৈশাখ মাসেই হঠাৎ বৃষ্টি চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু প্রকোপের। সাধারণত জুন  থেকে ডেঙ্গু মৌসুম ধরা হলেও গত দু-এক বছরে কোনো নিয়ম মানছে না ডেঙ্গু। গত ২৪ ঘণ্টায় ২৫ জন ডেঙ্গু  রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগেই ২০ জন। চলতি বছরে গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত  হয়েছেন ২ হাজার ৬১১ জন রোগী এবং মৃতের সংখ্যা ২০ জন। আক্রান্তদের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বরিশাল বিভাগে ৭২৭ জন, চট্টগ্রামে ৪৯২ জন, ঢাকা বিভাগে (মহানগর ছাড়া) ৩৮৬ জন,  ঢাকা  দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৪৪৫ জন, উত্তর সিটিতে ২৯২ জন, খুলনা বিভাগে ১২৭ জন, ময়মনসিংহে ৬৪ জন, রাজশাহীতে ৬৪ জন, রংপুর বিভাগে ৭ জন ও সিলেটে ৭ জন রোগী রয়েছেন। জানুয়ারিতে মৃত্যু ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জন এবং এপ্রিলে ৭ জন।

এদিকে, ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে সরকার এবার বিজ্ঞানভিত্তিক ও যৌথ উদ্যোগে নতুন পরিকল্পনায় এগুচ্ছে। জানা গেছে, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে ওলবাচিয়া ও সেরোলজিক্যাল জরিপে জোর দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। গত সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত হয় ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মেরিট ইন-করপোরেশন দুটি প্রস্তাব উপস্থাপন করে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিধি ডা. কাজী জামিল প্রস্তাব দুটি তুলে ধরেন। সভা শেষে প্রস্তাব দুটি গৃহীত হয়। প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়, সেরোলজিক্যাল জরিপ পরিচালনার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডেঙ্গু রোগে সংক্রমণের হার ও অ্যান্টিবডির উপস্থিতি নিরূপণ করা হবে। রক্তের নমুনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা যাবে, কারা পূর্বে আক্রান্ত হয়েছেন এবং কোন এলাকায় ঝুঁকি বেশি। দ্বিতীয় প্রস্তাব অনুযায়ী, ‘ওলবাচিয়া’ পদ্ধতি প্রয়োগ করে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়া হবে। এই পদ্ধতিতে মশার দেহে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করানো হয়, যা ডেঙ্গু ভাইরাস বহনে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে মশা কামড়ালেও ভাইরাস ছড়ায় না। সভায় জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয় সেরোলজিক্যাল জরিপে এবং অস্ট্রেলিয়ার একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ওলবাচিয়া প্রযুক্তির প্রয়োগে কারিগরি সহায়তা দেবে। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার এ ব্যাপারে বলেন, এডিস মশার ঘনত্ব নিয়ে যে কাজটা করি, গবেষণা করি সেখানে দেখছি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকটি জেলায় এডিস মশার ঘনত্ব বেশি পাচ্ছি। নিশ্চিতভাবে বলতে পারি এসব এলাকায় এবার ডেঙ্গু বাড়বে। এখনই যদি আমরা এডিস মশার প্রজনন, নিয়ন্ত্রণ, ব্রিডিং সোর্স ম্যানেজম্যান্ট এবং ডেঙ্গু রোগী ম্যানেজম্যান্ট সঠিকভাবে শুরু করতে না পারি তাহলে এ বছর পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার ঝুঁকি আছে। তিনি আরও বলেন,  ডেঙ্গুতে মৃত রোগীর হার অনেক বেশি। মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা করলে সমস্যাগুলো শনাক্ত করা যাবে। সমাধানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার তাগিদ দেন এই বিশেষজ্ঞ। হাসপাতাল থেকে ক্রস ট্রান্সমিশন হচ্ছে। হাসপাতালে রোগী দেখতে এসে অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানান ড. কবিরুল বাশার।

মশার বিস্তার রোধে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। আক্রান্ত হলেও মৃত্যুর হার কমানোর দিকে বিশেষ নজর দেয়ার পরামর্শ তাদের। জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, মশার উপদ্রব বন্ধ করার জন্য একটা কাজ হচ্ছে চিকিৎসার কাজ বিকেন্দ্রীকরণ। গতানুগতিক কাজ করলে মশার উৎপাদন কমবে না। 

এদিকে, ঢাকায় ডেঙ্গু রোগের জীবাণুবাহী এইডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী কাজ করবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। ২২শে এপ্রিল ডিএনসিসি নগর ভবনে আসন্ন বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রস্তুতি ও করণীয় সম্পর্কে বিভিন্ন হাসপাতালের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন ডিএনসিসি প্রশাসক। ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখতে নাগরিকদের সচেতন করতে ডিএনসিসি কার্যক্রম চালাবে তুলে ধরে ডিএনসিসি প্রশাসক বলেন, বাড়িঘর পরিষ্কার না পেলে বাড়ি মালিকদের জরিমানা করা হবে। তিনি বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসায় ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোয় ডেঙ্গু কর্নার করা হবে। তিনি আরও বলেন, ডিএনসিসি এলাকায় মশার ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম ঠিকাদারকে দিয়ে করানো হচ্ছে। সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে ডিএনসিসি। এখন থেকে সেনাবাহিনী মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করবে। যে থার্ড পার্টি দিয়ে আমরা মশার ওষুধ ছিটাতাম, সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাদের দিয়ে এই কাজ আমরা আর করাবো না। এইবার আমরা বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিকে দিয়ে এই কাজটি করাবো। বাধ্য হয়ে আমাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। কারণ পাবলিক হেলথ নিয়ে আমরা কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চাই না, কোনো ধরনের ত্রুটি চাই না। ডিএনসিসি প্রশাসক এজাজ বলে, বৃষ্টির মৌসুম শুরু হওয়ায় ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়ার আশঙ্কা আছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা নিয়ন্ত্রণ জরুরি, কিন্তু বাড়িঘরে মশা নিধন কঠিন। আমরা ঘুরলে ৯০ শতাংশ বাড়ির পাশে ময়লা পাওয়া যাবে, বাড়ি মালিকরা ঠিকমতো পরিষ্কার করেন না। লার্ভা মারার জন্য যে ওষুধ দিতে হচ্ছে, নিরাপত্তার কথা বলে আমাদের লোকজনকে ঢুকতে দেন না। বাড়িঘর পরিচ্ছন্ন রাখতে ভাড়াটিয়ারা বাড়ি মালিকের ওপর চাপ তৈরি করবেন। তিনি বলেন, ডিএনসিসি প্রতিটি হাসপাতালে একটি করে ডেঙ্গু কর্নার করতে চায়। এ বিষয়ে প্রয়োজনে ডিএনসিসি সব ধরনের সহায়তা করবে। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর সঙ্গে ২০০০ সাল থেকে লড়ছে বাংলাদেশ। ২০১৯ ও ২০২৩ সাল ছিল এ লড়াইয়ের টার্নিং পয়েন্ট। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর রেকর্ডে ২০২৩ সাল ছিল মশার বিরুদ্ধ পরাজয়ের বড় মাইলফলক। ২০২৪ সালে এসে সংক্রমণ ও মৃত্যু তুলনামূলক কমলেও তা ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ২০১৯ সালে এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন, ২০২০ সালে এক হাজার ৪০৫ জন, ২০২১ সালে ২৮ হাজার ৪২৯ জন এবং ২০২২ সালে ৬২ হাজার ৩৮২ জন এবং ২০২৩ সালে মোট তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ২০২৪ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন। এর মধ্যে ৬৩ দশমিক ১০ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৬ দশমিক ৯০ শতাংশ নারী।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status