শেষের পাতা
যুদ্ধে গিয়ে প্রাণ গেল আকরামের
পোল্যান্ডের কথা বলে রাশিয়ায় পাঠায় দালালরা
ইসহাক সুমন, আশুগঞ্জ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) থেকে
২০ এপ্রিল ২০২৫, রবিবার
রাশিয়ায় যুদ্ধে গিয়ে নিহত আকরামের স্বজনদের মাতম -ছবি নিজস্ব প্রতিনিধি
১১ মাস আগে পোল্যান্ডের কথা বলে আকরামকে রাশিয়ায় পাঠায় দালালরা। সেখানে কাজ নেয় চায়নার একটি কোম্পানিতে। আড়াই মাস আগে ফের দালালের খপ্পরে পড়ে আকরাম। দেয় মোটা অঙ্কের টাকার প্রলোভন। পরিবারের সচ্ছলতার কথা ভেবে সেই প্রলোভনে পড়ে আকরাম। চুক্তিভিত্তিক যোগ দেয় রুশ সামরিক বাহিনীতে। তারা শর্ত দেয়- রুশ বাহিনীর হয়ে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে অংশ নিতে হবে। কিন্তু প্রলোভনই কাল হলো তার। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে অংশ নিয়ে প্রাণ হারান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের যুবক মোহাম্মদ আকরাম হোসেন। বৃহস্পতিবার এক সহযোদ্ধার ফোনে পরিবারের কাছে আকরামের নিহত হওয়ার খবর পৌঁছলে তার বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে আসে।
সূত্রমতে, ওয়েল্ডারের কাজ শিখে সংসারের সচ্ছলতা আর নিজের ভবিষ্যতের আশায় রাশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন উপজেলার লালপুর হোসেনপুর গ্রামের মোরশেদ মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ আকরাম (২৫)। তিন ভাই ও দুই বোনসহ পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে আকরাম সবার বড়। আকরামদের সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী দিনমজুর পিতা মোরশেদ মিয়া স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা নিয়ে কোনোরকমে দিনাতিপাত করছিলেন। এরইমধ্যে আকরামের একজন বোনের বিয়ে দিতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন আকরামের বাবা মোরশেদ। এ অবস্থায় ওয়েল্ডারের কাজ শিখিয়ে আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ও গরু বিক্রি করে সাড়ে ৯ লাখ টাকা দিয়ে বিগত প্রায় এগারো মাস আগে আকরামকে রাশিয়া পাঠানো হয়। রাশিয়ায় যাওয়ার পর বিগত আট মাস আগে সেখানকার একটি চায়না কোম্পানিতে ওয়েল্ডার হিসেবে চাকরি করে আকরাম। বেতন খুব বেশি না পেলেও তার উপার্জনে পরিবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে। ফলে মোরশেদ মিয়ার অসচ্ছল পরিবারটি সচ্ছলতার স্বপ্ন বুনতে থাকে রাশিয়ায় প্রবাসী আকরামকে নিয়ে। কিন্তু বিগত আড়াই মাস আগে আকরাম দালালের প্রলোভনে পড়ে রুশ সেনাবাহিনীতে চুক্তিভিত্তিক যোদ্ধা হিসেবে যুক্ত হয়ে অংশ নেন ইউক্রেন যুদ্ধে। রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নেয়ার ছবিও নিজের ফেসবুকে আপলোড করেছিলেন তিনি। কিন্তু ইউক্রেনের মিসাইল হামলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তার স্বপ্নের যাত্রা। মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে আসে পুরো এলাকা জুড়ে।
আকরামের বাবা মোরশেদ মিয়া জানান, দালাল বলেছিল- তাকে পোল্যান্ড পাঠাবে। এই কথা বলে আমার কাছ থেকে সাড়ে ৯ লাখ টাকা নিয়ে যায়। কিছুদিন পর বলে পোল্যান্ড না পাঠিয়ে রাশিয়ায় পাঠান। যাওয়ার পর কিছুদিন ওয়েল্ডিং এর কাজ করে।
দালালরা বিগত আড়াই মাস আগে চুক্তিভিত্তিক যোদ্ধা হিসেবে আকরামকে যোগ দান করান রুশ সেনাবাহিনীতে। শর্ত ছিল, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সম্মুখসারিতে থাকার। এতে পরিবারের পক্ষ থেকে নিষেধ করা হলে আকরাম জানিয়েছেন- তার আর ফিরে আসার উপায় নেই। এরইমধ্যে আকরাম বাবাকে জানিয়েছিলেন- তার রাশিয়ার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৪ লাখ টাকা জমা হয়েছে। আমি আমার ছেলের মরদেহটি দেশে আনতে চাই। এজন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি।
আকরামের মা মোবিনা বেগম জানান, যুদ্ধে যেতে আমি বারণ করেছিলাম। কিন্তু দালালের খপ্পরে পড়ে যুদ্ধে চলে যায় আমার ছেলে। যুদ্ধে যাওয়ার পর গত কয়েক মাস যাবৎ আমার ছেলেকে ঠিকমতো খাবার ও গোসল করতে দেইনি তারা। প্রতিনিয়ত ৪০ কেজি একটি অস্ত্রের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে চলাচল করতে হতো। যুদ্ধ চলাকালে ছেলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। এরমধ্যে কয়েকদিন আগে একবার টানা ৫ দিন বাঙ্কারে নিখোঁজ ছিল সে। পরে রুশ সেনারা তাকে উদ্ধার করে। সে প্রতিনিয়তই বলতো দেশে চলে আসার কথা। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে চেষ্টা করলে তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে এই ভয়ে সে পালাতে পারছিল না। তাছাড়া তার পাসপোর্টও নিয়ে গিয়েছিল রুস সেনারা। তাই বলতো একমাত্র যুদ্ধ বন্ধ হলেই দেশে ফিরতে পারবে সে। সর্বশেষ গত ১৩ই এপ্রিল তার সঙ্গে কথা হয়েছিল। এরপর থেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আকরামের। পরে রাশিয়ায় অবস্থানরত পরিচিতজনরাও তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। গত বৃহস্পতিবার রাতে তার এক সহযোদ্ধা ফোন করে জানান, যুদ্ধে গিয়ে ইউক্রেন সেনাবাহিনীর মিসাইল হামলায় আকরাম নিহত হয়েছেন। ফোনে জানানো হয়, আকরামের ইউনিটের কয়েকজন যোদ্ধা ইউক্রেন বাহিনীর মিসাইল হামলায় মারা গেছেন। এরপর থেকে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
এদিকে আকরামের মৃত্যুর খবরে তার বাড়ি আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুর হোসেনপুর গ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে। ছেলের ছবি নিয়ে মা মোবিনা বেগম বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। শোকে হতবিহবল পরিবারের অন্য সদস্যরা। তারা বলেন, সংসারে দাদা-দাদি, বাবা-মা ভাইবোন মিলে ৯ জন সদস্য। আকরামের উপার্জিত টাকা দিয়েই চলতো এই সংসারের ভরণপোষণ। এখনো পাঁচ লাখের অধিক টাকা ঋণ রয়েছে। তার মৃত্যুতে ঋণ এবং পরিবার কীভাবে চলবে দিশাহারা তার বাবা-মা। নিহতের লাশ দেশে আনতে ও ক্ষতিপূরণ পেতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা কামনা করছেন পরিবারের সদস্যরা। আশুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাফে মোহাম্মদ ছড়া জানান, স্থানীয়দের মাধ্যমে বিষয়টি জেনে মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছি। সেখান থেকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে, পরিবার প্রথমে মরদেহটি কোথায় আছে সেটি শনাক্ত করতে হয়। সেই অনুযায়ী কাগজপত্র সংগ্রহ করে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আবেদনের পর উনারা ব্যবস্থা নিবেন।