দেশ বিদেশ
বিবিসি’র রিপোর্ট
গোপন কারাগারের স্মৃতি
মানবজমিন ডেস্ক
১৭ এপ্রিল ২০২৫, বৃহস্পতিবার
তাড়াহুড়ো করে নির্মাণ করা হয়েছিল একটি দেয়াল। তদন্তকারীরা তা ভেঙে ফেললেন। তাদের সামনে বেরিয়ে এলো একটি গোপন কারাগার। এর পেছনের কাহিনীকে লুকানোর জন্য নতুন ইটে দেয়াল বানানো হয়েছিল। ভেতরে একটা সরু করিডোরের বাইরে ডানে-বামে ছোট ছোট ঘর। চারপাশটা ছিল নিদারুণ কালো। মীর আহমদ বিন কাসেম এবং অন্যদের স্মৃতি ছাড়া হয়তো তদন্তকারীরা এই গোপন কারাগারটি খুঁজে পেতেন না। এটি ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সামান্য দূরত্বে অবস্থিত। বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত নেতার সমালোচনা করার কারণে তাকে আট বছর এই বন্দিশিবিরে আটক রাখা হয়েছিল। কারাগারে বেশির ভাগ সময় চোখ বেঁধে রাখা হতো তার। এ জন্য কানে শোনা শব্দগুলোর ওপর নির্ভর করতেন। বিমান অবতরণের শব্দ তার স্পষ্ট মনে ছিল। বিমানবন্দরের কাছে সামরিক ঘাঁটিতে তদন্তকারীদের যেতে সাহায্য করেছিল এসব বিষয়। সেখানে মূল ভবনের পেছনে ইট এবং কংক্রিটের তৈরি ছোট, কড়া পাহারায় থাকা, জানালাবিহীন এই কাঠামো খুঁজে পান তারা। এখানেই বন্দিদের আটকে রাখা হতো। এটা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল, যাতে তা লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকে।
গত ৫ই আগস্ট গণবিক্ষোভের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। তারপর থেকে তদন্তকারীরা কাসেমের মতো শত শত ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছেন। অন্যদিকে কারাগারে থাকা বন্দিদের মুক্তি দেয়া হয়েছে। আরও অনেককে বিগত শাসকদের সময়ে বেআইনিভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। তদন্তকারীরা বলছেন, ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রাস্তার ঠিক উল্টোপাশে এই কারাগারটির অবস্থান। গোপন এই কারাগারগুলো পরিচালনাকারীদের বেশির ভাগই একটি অভিজাত সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিট র্যাব থেকে এসেছিলেন। তারা সরাসরি হাসিনার নির্দেশে কাজ করছিলেন। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বিবিসিকে বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন যে, সমস্ত জোরপূর্বক গুমের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন, অনুমতি বা আদেশে সম্পন্ন হয়েছে।
হাসিনার দল আওয়ামী লীগ বলেছে, কথিত অপরাধগুলো তাদের অজান্তেই করা হয়েছে। তাদের কোনো দায় নেই এবং ওই প্রতিষ্ঠান (র্যাব) একাই পরিচালিত হচ্ছে। সাত মাস পর কাসেম এবং অন্যরা হয়তো মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু তারা অপহরণকারীদের ভয়ে ভীত। কারণ, তারা এখনো নিরাপত্তা রক্ষাকারী সদস্যদের সঙ্গে মিশে আছে এবং তারা এখনো মুক্ত। কাসেম বলেন, তিনি কখনো টুপি এবং মাস্ক না পরে বাড়ি থেকে বের হন না। কোথাও বেড়াতে গেলে সবসময় আমাকে পেছনের দিকে খেয়াল রাখতে হয়।
বিস্তৃত জেল নেটওয়ার্ক: তিনি ধীরে ধীরে কংক্রিটের সিঁড়ি বেয়ে বিবিসিকে দেখান, তাকে কোথায় রাখা হয়েছিল। একটি ভারী ধাতব দরজা ঠেলে তিনি মাথা নিচু করে আরেকটি সরু দরজা দিয়ে ‘তার’ সেই সেলে প্রবেশ করেন। এটা সেই কক্ষ, যেখানে তাকে আট বছর আটকে রাখা হয়েছিল। তিনি বলেন, মনে হচ্ছিল জীবন্ত কবর দেয়া হচ্ছে। বাইরের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। প্রাকৃতিক আলোর জন্য কোনো জানালা বা দরজা ছিল না। সেখানে আটক থাকা অবস্থায় তিনি দিন বা রাতের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারতেন না। চল্লিশের কোঠায় বয়স আইনজীবী কাসেমের। এর আগেও সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি। কিন্তু এই প্রথমবারের মতো তিনি সেই ছোট্ট সেল, যেখানে বন্দি ছিলেন, সেখানকার ভেতরের বিস্তারিত তথ্য গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরলেন।
টর্চের আলোয় দেখা গেল এটি এত ছোট যে একজন সাধারণ মানুষের সোজা হয়ে দাঁড়াতে কষ্ট হয়। দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। কিছু দেয়াল ভাঙা এবং ইট ও কংক্রিটের টুকরো মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। অপরাধীরা তাদের অপরাধের প্রমাণ নষ্ট করার শেষ চেষ্টা করেছে বোঝা যায়। জেল পরিদর্শনে বিবিসি’র সঙ্গে থাকা প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, এটি একটি আটক কেন্দ্র। আমরা দেখেছি সারা দেশে ৫০০, ৬০০, ৭০০-এরও বেশি এমন কক্ষ রয়েছে। এটা বুঝিয়ে দেয় এর ব্যাপকতা এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে তা পরিচালনা করা হচ্ছিল।
মীর আহমদ বিন কাসেম তার সেলের হালকা নীল টাইলসের কথাও স্পষ্টভাবে মনে রেখেছেন। সেই সব টাইলস এখন মেঝেতে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে, যা তদন্তকারীদের এই নির্দিষ্ট ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। নিচতলার সেলগুলোর তুলনায় এটি অনেক বড়, ১০ ফুট বাই ১৪ ফুট। এর একপাশে একটি টয়লেট আছে।
এই বন্দিশিবিরে কীভাবে দিন কেটেছে সে সম্পর্কে বেদনাদায়ক বর্ণনা দিয়েছেন মীর আহমদ বিন কাসেম। তিনি ঘরটির চারপাশে ঘুরছিলেন। বন্দিদশায় তার সময় কীভাবে কেটেছে তার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। গ্রীষ্মকালে সেখানে অসহ্য গরম ছিল। তিনি তখন মেঝেতে উপুড় হয়ে থাকতেন এবং যতটা সম্ভব দরজার গোড়ার কাছে মুখ রাখতেন, যাতে কিছুটা বাতাস পান। তিনি বলেন, সে সময়টাকে মৃত্যুর চেয়েও খারাপ লাগছিল। তিনি বিশ্বাস করেন, কী করা হয়েছিল তার বা তাদের সঙ্গে তা বিশ্ববাসীর দেখা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, উচ্চপদস্থ কিছু কর্মকর্তা ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থাকে সহায়তা ও মদত দিয়েছিলেন, সহায়তা করেছিলেন, তাদের অবস্থান এখনো বহাল রয়েছে। কিন্তু এ কাহিনী আমাদের প্রকাশ করা উচিত। যারা ফিরে আসেননি তাদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য এবং যারা বেঁচে আছেন তাদের জীবনে পুনর্বাসনের জন্য সাহায্য করার জন্য আমরা যা করতে পারি তা করা উচিত।
এর আগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, তাকে ঢাকার প্রধান গোয়েন্দা সদর দপ্তরের ভেতরে একটি কুখ্যাত আটক কেন্দ্র আয়নাঘর বা ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত- এর ভেতরে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তদন্তকারীরা এখন বিশ্বাস করেন যে, এরকম অনেক গোপন কারাগার ছিল। কাসেম বিবিসিকে বলেন, প্রথম ১৬ দিন বাদে তিনি তার পুরো আটক জীবন র্যাব ঘাঁটিতেই কাটিয়েছেন। তদন্তকারীরা এখন সন্দেহ করছেন যে, প্রথম স্থানটি ঢাকার গোয়েন্দা শাখার একটি শাখা ছিল। তিনি বিশ্বাস করেন, তার পরিবারের রাজনীতির কারণে তাকে গুম করা হয়েছিল। ২০১৬ সালে তিনি তার পিতার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগে আইনি প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। তার পিতা ছিলেন দেশের বৃহত্তম ইসলামপন্থি দল জামায়াতে ইসলামীর একজন সিনিয়র সদস্য। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তার বিচার করা হয়েছে এবং পরে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়।
ভেবেছিলাম আর কখনোই বের হতে পারবো না: বিবিসি’র সঙ্গে কথা বলা আরও পাঁচজন ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন তাদের কাহিনী। তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চোখ বেঁধে এবং হাতকড়া পরিয়ে। তারপর অন্ধকার কংক্রিটের কক্ষে রাখা হয়। সেখানে বাইরের জগতের কারও প্রবেশাধিকার ছিল না। অনেক ক্ষেত্রেই তারা বলেন, তাদেরকে মারধর করা হয়েছে। নির্যাতন করা হয়েছে। তবে বিবিসি নিরপেক্ষভাবে তাদের তথ্যগুলো যাচাই করতে পারেনি। প্রায় সকলেই বলেন যে, তারা ভীত। এ জন্য যে একদিন রাস্তায় বা বাসে কোনো অপহরণকারীর সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। ৩৫ বছর বয়সী আতিকুর রহমান রাসেল বলেন, এখন, যখনই আমি গাড়িতে উঠি অথবা বাড়িতে একা থাকি, তখনই আমি কোথায় ছিলাম তা ভেবে ভয় পাই। ভাবছি কীভাবে বেঁচে গেলাম, আমার কি সত্যিই বেঁচে থাকার কথা ছিল। তিনি বলেন, তার নাক ভেঙে গেছে এবং তার হাতে এখনো ব্যথা। তার ভাষায়, তারা আমাকে হাতকড়া পরিয়েছে এবং অনেক মারধর করেছে। রাসেল বলেন, গত জুলাই মাসে যখন সরকারবিরোধী বিক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করে, তখন পুরান ঢাকার একটি মসজিদের বাইরে একদল লোক তার কাছে আসে। তারা বলে, তারা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য এবং তাকেও তাদের সঙ্গে যেতে হবে। পরের মিনিটেই তাকে হাতকড়া, হুড পরিয়ে, চোখ বেঁধে একটি ধূসর গাড়িতে তোলে। চল্লিশ মিনিট পর তাকে গাড়ি থেকে টেনে বের করে একটি ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। একটি ঘরে রাখা হয়। তিনি বলেন, প্রায় আধ ঘণ্টা পর লোকেরা একে একে আসতে শুরু করে এবং প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে থাকে- তুমি কে? তুমি কী করো? তারপর মারধর শুরু হয়। ওই জায়গার ভেতরে থাকাটা ভয়াবহ ছিল। আমার মনে হচ্ছিল আমি আর কখনোই বের হতে পারবো না।
রাসেল এখন তার বোনের পরিবারের সঙ্গে থাকেন। তিনিও বিশ্বাস করেন, তার আটক রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারণ তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর একজন ছাত্রনেতা ছিলেন। তার পিতা ছিলেন দলটির একজন সিনিয়র সদস্য। তার ভাই বিদেশে থাকতেন। তিনি প্রায়শই সোশ্যাল মিডিয়ায় হাসিনার সমালোচনা করে পোস্ট লিখতেন। রাসেল বলেন, তাকে কোথায় রাখা হয়েছে তা জানার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু এই বছরের শুরুতে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে তিনটি আটক কেন্দ্র পরিদর্শন করতে দেখা যায়। এরপর তিনি মনে করেন তাকে ঢাকার আগারগাঁওয়ের কোনো একটি জায়গায় রাখা হয়েছিল।
আমাকে বলা হয়েছিল গুম হয়ে যাবো: রাজনৈতিক ভিন্নমতের প্রতি হাসিনার সহনশীলতা ছিল না। এটা একটা ওপেন সিক্রেট। সাবেক বন্দি, বিরোধী এবং তদন্তকারীরা বলছেন, তার সমালোচনা করলে আপনি কোনো চিহ্ন না রেখেই ‘অদৃশ্য’ হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু নিখোঁজদের মোট সংখ্যা হয়তো কখনোই স্পষ্ট হবে না। ২০০৯ সাল থেকে জোরপূর্বক গুমের ঘটনাগুলো ট্র্যাক করে আসা একটি বাংলাদেশি এনজিও কমপক্ষে ৭০৯ জনকে জোরপূর্বক গুমের তথ্য নথিভুক্ত করেছে। তাদের মধ্যে ১৫৫ জন এখনো নিখোঁজ। সেপ্টেম্বরে জোরপূর্বক গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গঠনের পর থেকে তারা অভিযুক্ত ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে ১,৬৭৬টিরও বেশি অভিযোগ পেয়েছে এবং আরও বেশি লোক এগিয়ে আসছে।
বিভিন্ন স্থানে আটক থাকা সত্ত্বেও ভুক্তভোগীদের বর্ণনা অদ্ভুতভাবে একই রকম। হাসিনার আওয়ামী লীগ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী আরাফাত এসবে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, যদি মানুষকে জোরপূর্বক গুম করা হয়, তাহলে তা হাসিনার নির্দেশে করা হয়নি অথবা তার মন্ত্রিসভার কারও নির্দেশে করা হয়নি। তিনি বলেন, যদি এমন কোনো আটকের ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে তা জটিল অভ্যন্তরীণ সামরিক গতিশীলতার ফসল হতো। এই লোকদের গোপন আটকে রাখার মাধ্যমে আমি আওয়ামী লীগ বা সরকারের কোনো রাজনৈতিক লাভ দেখতে পাচ্ছি না।
সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন- ‘কী বোঝানো হচ্ছে সে সম্পর্কে তাদের কিছু জানা নেই’। সেনাবাহিনী স্পষ্টভাবে এই ধরনের কোনো আটক কেন্দ্র পরিচালনার কথা অস্বীকার করে।
তাজুল ইসলাম বিশ্বাস করেন, এখানে আটক থাকা সকল ব্যক্তি ভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ের ছিলেন এবং তারা কেবল পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থা, সেই সময়ের সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। সে কারণেই তাদের এখানে আনা হয়েছিল।
এখন পর্যন্ত তারা ১২২টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। কিন্তু এখনো কাউকে বিচারের আওতায় আনা হয়নি। এ কারণেই ৭১ বছর বয়সী ইকবাল চৌধুরীর মতো ভুক্তভোগীরা বিশ্বাস করেন, তাদের জীবন এখনো ঝুঁকির মধ্যে। তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে চান। ২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়ার পর বছরের পর বছর ধরে তিনি বাড়ি থেকে বের হননি। এমনকি বাজারেও যাননি। ইকবাল চৌধুরীকে তার বন্দিদের মাধ্যমে সতর্ক করা হয়েছে যে, তিনি যেন তার আটকের কথা কখনো না বলেন। তাকে বলা হয়েছিল, যদি তুমি কখনো প্রকাশ করো তুমি কোথায় ছিলে বা কী ঘটেছিল, আর যদি তোমাকে আবার ধরে নিয়ে যায়, তাহলে কেউ তোমাকে আর খুঁজে পাবে না বা দেখতে পাবে না। তুমি এই পৃথিবী থেকে উধাও হয়ে যাবে। ভারত এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করার অভিযোগে অভিযুক্ত ইকবাল চৌধুরী বলেন- এ কারণেই তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমাকে মারধরের পাশাপাশি বৈদ্যুতিক শক দিয়ে শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। বৈদ্যুতিক শকে আমার একটি আঙ্গুল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পায়ের শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। শারীরিক শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। তিনি অন্যদের শারীরিক নির্যাতনের শব্দ, প্রাপ্তবয়স্কদের যন্ত্রণায় চিৎকার এবং কান্নার শব্দ মনে রেখেছেন।
মৃত্যু পর্যন্ত ভয় থাকবে: ২৩ বছর বয়সী রহমতুল্লাহও আতঙ্কিত। তিনি বলেন, ওরা আমার জীবনের দেড়টি বছর কেড়ে নিয়েছে। সেই সময়গুলো আর কখনো ফিরে আসবে না। ওরা আমাকে এমন জায়গায় ঘুম পাড়িয়েছে যেখানে একজন মানুষের থাকাও উচিত নয়। ২০২৩ সালের ২৯শে আগস্ট মধ্যরাতে তাকে তার বাসা থেকে র্যাব অফিসাররা ধরে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে কয়েকজন পোশাক পরা এবং অন্যরা সাধারণ পোশাকে ছিলেন। তিনি ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় রাঁধুনি হিসেবে কাজ করছিলেন। বারবার জিজ্ঞাসাবাদের পর রহমতুল্লাহর কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভারত ও ইসলামবিরোধী পোস্টের জন্য জোরপূর্বক আটক করা হচ্ছে। একটি কলম এবং কাগজ ব্যবহার করে, তিনি তার সেলের নকশা আঁকেন। ওই সেলের মধ্যেই তিনি মলত্যাগের জন্য খোলা ড্রেন ব্যবহার করতেন। বলেন, ঢাকার ওই জায়গার কথা ভাবলেও আমার খুব খারাপ লাগে। ঠিকমতো শোয়ার জায়গা ছিল না। তাই আমাকে কুঁজো হয়ে শুয়ে ঘুমাতে হতো। শুয়ে পা ছাড়াতে পারতাম না।
গোপন কারাগার সম্পর্কে আরও কিছু জানতে এবং ভেতরে তাদের সঙ্গে কী ঘটেছিল তা নিশ্চিত হতে বিবিসি আরও দুই সাবেক বন্দি- মাইকেল চাকমা এবং মাসরুর আনোয়ারের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। কিছু ভুক্তভোগী তাদের আটকের শারীরিক ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন। বছরের পর বছর ধরে স্বৈরাচারী শাসনের পর পুনর্গঠনের চেষ্টার সময় বাংলাদেশ তার ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে রয়েছে। গণতন্ত্রের দিকে দেশটির অগ্রগতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হবে এই অপরাধের অপরাধীদের ন্যায্য বিচারের ব্যবস্থা করার ক্ষমতা। নিজের কংক্রিটের সেলের অবশিষ্টাংশে দাঁড়িয়ে কাসেম বলেন, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি বন্ধ করতে হবে। আমাদের ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ন্যায়বিচার করতে হবে। তারা অনেক কষ্ট পেয়েছেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি বিচার হওয়া উচিত। যাতে দেশ এই অধ্যায়টি বন্ধ করতে পারে।
তবে রহমতুল্লাহর জন্য ব্যাপারটা এত সহজ নয়। তিনি বলেন, ভয় এখনো চলে যায়নি। আমার মৃত্যু পর্যন্ত ভয় থাকবে।