অনলাইন
ঈদ আনন্দ ২০২৫
সাংবাদিকতায় নজরুলের অবদান ও ‘লাঙল’-এর শতবর্ষ
অঞ্জন বেরা
৩০ মার্চ ২০২৫, রবিবার
কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিভার বহুমাত্রিকতায় সাংবাদিক-সত্তার উজ্জ্বল উপস্থিতি অনস্বীকার্য। সাংবাদিকতায় তার ভূমিকা ও অবদানকে বাদ দিয়ে নজরুলের সৃজনশীলতাকে বিচার করা অসম্ভব। বিশেষত জন্মের ১২৫তম বর্ষে নজরুল ইসলাম ও তার প্রতিভার নানা দিক নিয়ে আলোচনা পুনরালোচনায় স্বভাবতই জোর পড়বে। নতুন করে আমরা দেখবো সেই অমিত প্রতিভাধরকে। কবি নজরুল ও সংগীতকার নজরুলের পাশাপাশি বাংলা সাংবাদিকতাতেও নজরুল অনন্য। নজরুল মানসের গতিপ্রকৃতি ও বিকাশ অনুসন্ধানে সাংবাদিকতায় তার আগ্রহ এবং অবদান না-বুঝলে চলবে না। সাংবাদিকতা তার জীবনে কোনো প্রক্ষিপ্ত কালপর্ব নয়। সাংবাদিকতা তার সৃষ্টির অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোকেও প্রভাবিত করেছে। প্রভাবিত করেছে এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তার কবিতা এবং সংগীতকেও।
ঘটনাক্রমে তার জন্মের ১২৫তম বর্ষ উদ্যাপনের পিঠাপিঠি উপস্থিত হয়েছে সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘লাঙল’-এর শতবর্ষও। ১৯২৫ সালের ১৬ই ডিসেম্বর (১লা পৌষ ১৩৩২) কলকাতার শিয়ালদার কাছে ৩৭ নম্বর হ্যারিসন রোডের (পরবর্তীকালে মহাত্মাগান্ধী রোড) ঠিকানা থেকে শ্রমিক প্রজা স্বরাজ দলের সাপ্তাহিক মুখপত্র হিসেবে ‘লাঙল’-এর আত্মপ্রকাশ। পত্রিকার ‘প্রধান পরিচালক’ হিসেবে ছাপা হতো নজরুল ইসলামের নাম। প্রথম সম্পাদক ছিলেন মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বেঙ্গলি রেজিমেন্টে নজরুলের সহ-সৈনিক। ‘লাঙল’ পত্রিকায় তিনি হাতে কলমে কোনো কাজই করতেন না। কার্যত নজরুলের সম্পাদনাতেই ‘লাঙল’-এর যাত্রা শুরু। পরবর্তীকালে মণিভূষণ মুখোপাধ্যায় নামেও ‘সম্পাদক’ থাকতে চাননি। তখন দায়িত্ব দেয়া হয় গঙ্গাধর বিশ্বাসকে। ‘লাঙল’-এর কর্মসচিব ছিলেন শামসুদ্দীন হুসয়ন। কমিউনিস্ট নেতা আব্দুল হালিমের বড় ভাই। ১৯২৬ সালের অক্টোবরে তিনি আকস্মিকভাবে প্রয়াত হন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সক্রিয় জীবনে নজরুল যে পত্রপত্রিকাগুলোর সঙ্গে হাতে-কলমে যুক্ত ছিলেন তার মধ্যে মাত্র একটি বাদে সবক’টিই ছিল সংবাদপত্র। মুখ্যত সংবাদভিত্তিক প্রকাশনা। ব্যতিক্রমী পত্রিকা ছিল ‘সওগাত’। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের মাসিক ‘সওগাত’ ছিল সাহিত্য পত্রিকা। ১৯১৯ সালে নজরুল যখন বেঙ্গলি রেজিমেন্টের বিশ বছর বয়সী সৈনিক তখন তার প্রথম লেখা ছাপা হয় মাসিক ‘সওগাত’-এ। তা ছিল ‘সওগাত’-র প্রথম পর্যায়। পরবর্তীকালে ‘সওগাত’ প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক হিসেবে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বেঙ্গলি রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হলে নজরুল দেশে ফিরে আসেন ১৯২০ সালের মার্চে। মুজফফর আহমদের ভাষায় ‘অসন্তুষ্ট দেশ তখন টগবগ করে ফুটছে।’ কলকাতায় এসে নজরুলের ঠিকানা হয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার অফিস- ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিট; মেডিক্যাল কলেজের উল্টোদিকে। কিছুদিনের মধ্যেই জড়িয়ে পড়েন সাংবাদিকতায়।
বিশের দশকের গোড়ায় নজরুল যখন সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়ছেন তখন গণরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নতুন পর্বে পা দিয়েছে আমাদের ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলন। শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত ছাত্র যুব মহিলা সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এতে জড়িয়ে পড়ে। ১৯২০ সালে অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা। ১৯১৯ সালে লেনিনের নেতৃত্বে মস্কোতে প্রতিষ্ঠিত তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক উপনিবেশগুলোর মুক্তি আন্দোলনকে সংহত করার আহ্বান জানান। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের উৎসাহে প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীরা তাশখণ্ডে গঠন করেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। দেশের মধ্যে কমিউনিজমের প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৯২১ সালে (২৭-২৮শে ডিসেম্বর) আহমেদাবাদে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের ৩৬-তম অধিবেশন উপলক্ষে প্রচারিত হয় মানবেন্দ্রনাথ রায় এবং অবনী মুখার্জি স্বাক্ষরিত ইশতেহার। শুধু ইশতেহার প্রচার নয়, আহমেদাবাদ অধিবেশনে মৌলানা হসরত মোহানী এবং স্বামী কুমারানন্দ উত্থাপন করেন পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব। সে প্রস্তাব আহমেদাবাদে তখন গৃহীত হয়নি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে ‘স্বরাজ’ অর্জন তখনও ছিল জাতীয় কংগ্রেসের সর্বোচ্চ লক্ষ্য। ১৯২৯ সালে কংগ্রেস প্রথম ‘পূর্ণ স্বরাজ’ প্রস্তাব গ্রহণ করে।

১৯২৪ সালে কানপুর বলশেভিক ‘ষড়যন্ত্র’ মামলায় মুজফফর আহমদ, এস এ ডাঙ্গে, শওকত ওসমানী প্রমুখ সাজা পান। ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে কানপুরে আয়োজিত হয় কমিউনিস্ট সম্মেলন। সম্মেলন থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সর্বভারতীয় কমিটি গঠিত হয়।
কলকাতায় ফেরার পর নজরুলের জীবনে যার সাহচর্য্য ছিল সেই সময় সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ সেই মুজফফর আহমদ মার্কসবাদ-লেনিনবাদে আকৃষ্ট হন ১৯২১ সালের শেষ দিকে। কানপুর জেল থেকে মুক্তির পর মুজফফর আহমদ ১৯২৫ সালের কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলায় যোগ দেন এবং সর্বভারতীয় কমিটিতে নির্বাচিত হন। বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ১৯২৬ সালের জানুয়ারির গোড়ায় মুজফফর আহমদ কলকাতায় ফেরেন। এসে উঠেন ‘লাঙল’-এর দপ্তরে।
নজরুলের সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি ১৯২০ সালে। তৎকালীন খিলাফত নেতা এ কে ফজলুল হকের মালিকানায় ১৯২০ সালের ১২ই জুলাই কলকাতা থেকে সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’ প্রকাশিত হয় এবং সেই সংবাদপত্রের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন মুজফফর আহমদ এবং নজরুল ইসলাম। উল্লেখ না করলেই নয় যে ‘নবযুগ’ ছিল সংবাদসংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অফ ইন্ডিয়ার গ্রাহক।
‘নবযুগ’ পত্রিকায় শুধু নজরুল নয়, মুজফফর আহমদেরও সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। মুজফফর আহমদ তখনও মার্কসবাদ-লেনিনবাদে দীক্ষিত হননি। তবে ‘নবযুগ’ই প্রথম বাংলা সংবাদপত্র যেখানে শ্রমিক ও কৃষকদের সমস্যা অগ্রাধিকার দিয়ে প্রকাশিত হতে থাকে। ‘নবযুগ’ প্রকৃতই বাংলাভাষায় নবযুগের বার্তাবহ হয়ে উঠতে শুরু করে। ফলে অবশ্যম্ভাবীভাবে ব্রিটিশ সরকার পত্রিকাটির জামানত বাজেয়াপ্ত করে। কাগজের কর্ণধার হক সাহেবের সঙ্গে মতপার্থক্যের জেরে ১৯২০ সালের শেষ নাগাদ নজরুল এবং মুজফফর আহমদ দু’জনেই ‘নবযুগ’ ছেড়ে দেন। ‘নবযুগ’ তারপর বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য প্রায় দু’দশক পর ১৯৪১ সালে সম্ভবত অক্টোবরের দ্বিতীয়ার্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফজলুল হক নতুন করে প্রকাশ করেন প্রভাতী দৈনিক ‘নবযুগ’। প্রধান সম্পাদক নজরুল ইসলাম।
মুসলিম লীগের সঙ্গে বিবাদের জেরে লীগ থেকে হক সাহেব থেকে পদত্যাগ করেন ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বরে এবং একটি লীগবিরোধী কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠনের চেষ্টা শুরু করেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি এবং কংগ্রেস নেতা শরৎ বসুর সঙ্গে মিলে। সেই প্রেক্ষাপটেই আত্মপ্রকাশ করে প্রভাতী দৈনিক ‘নবযুগ’। শেষ পর্যন্ত হক সাহেব ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে মন্ত্রিসভা থেকেও পদত্যাগ করেন এবং কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার সমর্থন নিয়ে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন (হক-শ্যামা মন্ত্রিসভা)। পরের বছরের মাঝামাঝি নজরুল গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতার কারণে কার্যত তার স্বাভাবিক কর্মজীবনেরও অবসান ঘটে। যদিও কবির জীবনাবসান হয় ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট।
‘লাঙল’-র প্রেক্ষাপট
সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’ ছাড়ার কয়েক মাস পর ১৯২১ সালের জুলাই নাগাদ নজরুল ও মুজফফর আহমদ একটি বাংলা দৈনিক প্রকাশের উদ্যোগ নেন। এজন্য একটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি খোলারও উদ্যোগ নেয়া হয়। যদিও সে চেষ্টা ফলবতী হয়নি।
১৯২২ সালের মাঝামাঝি নজরুল যোগ দেন মোহম্মদ আক্রম খাঁ’র দৈনিক ‘সেবক’ ও ‘মোহম্মদী’ সংবাদপত্রে। সে সময় লীগ ও কংগ্রেস নেতা আক্রম খাঁ পরবরতীকালে দৈনিক ‘আজাদ’-র (১৯৩৬ সালের ৩১শে অক্টোবরে আত্মপ্রকাশ) সম্পাদক হিসেবে অবিভক্ত বাংলার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। দেশভাগের পর ‘আজাদ’ কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। নজরুল কখনও দৈনিক ‘আজাদ’-র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।
নজরুলের সাংবাদিকতা জীবনে নতুন পর্বের সূত্রপাত ঘটে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশকে কেন্দ্র করে। ১৯২২ সালের ১১ই আগস্ট কলকাতা থেকে নজরুলের সম্পাদনায় (যদিও লেখা হতো, ‘ধূমকেতু’র ‘সারথি’ হিসেবে) প্রকাশিত হয় ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা।‘ধূমকেতু’ ছিল অর্ধসাপ্তাহিক। ‘ধূমকেতু’ শুরু হয় এমন এক সময়ে যখন গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহৃত হয়েছে। খিলাফত আন্দোলনেও ঝিমিয়ে পড়ার মুখে। সেই সময় আত্মরক্ষামূলক সময়েই ‘জাগিয়ে দে রে চমক মেরে/ আছে যারা অর্ধচেতন’ রবীন্দ্রনাথের এই আশীর্বাণীকে শিরোধার্য করে নজরুল ‘ধূমকেতু’র সওয়ারি হলেন। ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’র দাবি তুলে ‘ধূমকেতু’ ব্রিটিশ শাসকের ঘুম কেড়ে নেয়। ‘ধূমকেতু’ তুরস্কে কামাল পাশার জয়কে সহর্ষে স্বাগত জানায়। স্বভাবতই ‘ধূমকেতু’র দীর্ঘ ও মসৃণ জীবন ঔপনিবেশিক জামানার পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না। ১৯২২ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর সংখ্যায় মুদ্রিত লীলা মিত্রের প্রবন্ধ ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ৎ’ এবং নজরুলের কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’র জন্য সংখ্যাটি বাজেয়াপ্ত হয়।
শুধু তাই নয়, ‘ধূমকেতু’র কারণেই নজরুল গ্রেপ্তার হন ১৯২২ সালের ২৩শে নভেম্বর কুমিল্লা থেকে। ১৯২৩ সালের প্রায় পুরো সময়টাই তিনি কারাবন্দি ছিলেন। ‘ধূমকেতু’র মোট ২১টি সংখ্যা নজরুল সম্পাদনা করেন। তার গ্রেপ্তারির পরেও অল্প কিছু দিন ‘ধূমকেতু’ প্রকাশিত হয়। ১৯২৩ সালের ২৭শে জানুয়ারি প্রকাশিত হয় সর্বশেষ সংখ্যা। ১৯২৩ সালের ১৫ই ডিসেম্বর নজরুল জেল থেকে ছাড়া পান।
নজরুল কারাগারে থাকার সময়ই কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলায় মুজফফর আহমদকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ১৯২৩ সালের ১৭ই মে। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে কানপুর কমিউনিস্ট সম্মেলনে (২৬-২৮শে ডিসেম্বর ১৯২৫) যোগ দিয়ে মুজফফর আহমদ কলকাতায় ‘লাঙল’ পত্রিকার অফিসে পৌঁছান ১৯২৬ সালের জানুয়ারির গোড়ায়। সম্ভবত ২ জানুয়ারি। ততদিনে ‘লাঙল’ পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। যে ‘লাঙল’ ছিল ‘ধূমকেতু’র পর নজরুলের সাংবাদিকতা জীবনের দিকচিহ্ন। প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা গঙ্গাধর অধিকারী ‘লাঙল’কে বলেছেন ‘ধূমকেতু’র উত্তরসূরি।
লেবার স্বরাজ দলের মুখপত্র
সাপ্তাহিক ‘লাঙল’ আত্মপ্রকাশ করে ১৯২৫ সালের ১৬ই ডিসেম্বর এবং তা ছিল ‘লেবার স্বরাজ পার্টি অফ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ শ্রমিক প্রজা স্বরাজ দলের মুখপত্র।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর (১৬ই জুন ১৯২৫) পর প্রদেশ কংগ্রেস ও স্বরাজ্য দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রবল হয়ে উঠলে নজরুল, হেমন্ত সরকার, কুতুবুদ্দীন আহমদ প্রমুখ ‘লেবার স্বরাজ পার্টি অফ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ গঠন করেন। নজরুলই ছিলেন নতুন দলের সাধারণ সম্পাদক। নজরুল স্বাক্ষরিত দলের ইশতেহারে (১লা নভেম্বর ১৯২৫ প্রকাশিত) ঘোষণা করা হয়: ‘নারী পুরুষ নির্বিশেষে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা সূচক স্বরাজ্য লাভই এই দলের উদ্দেশ্য।’
ষোলো পাতার ‘লাঙল’ ছাপা হতো কলকাতায় ১৫ নং নয়ান চাঁদ দত্ত স্ট্রিটের মেটকাফ প্রেস থেকে। প্রথম সংখ্যায় দেখা যাচ্ছে, ‘লাঙল’-এর প্রতি সংখ্যার দাম ছিল এক আনা। বার্ষিক চাঁদা তিন টাকা। ‘ধূমকেতু’-র মতো ‘লাঙল’কেও আশীর্বাণী পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ- ‘জাগো জাগো বলরাম ধরো তব মরুভাঙ্গা হল,/ প্রাণ দাও, শক্তি দাও, স্তব্ধ করো ব্যর্থ কোলাহল।’
‘লাঙল’-র প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদেই ছাপার অক্ষরে বলে দেয়া হয়, ‘বিদ্রোহী’ কবি নজরুলের কবিতা ছাপা হবে প্রতি সংখ্যায়। প্রথম সংখ্যায় ছাপা হয় নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘সাম্যবাদী’। দ্বিতীয় সংখ্যায় (২৩শে ডিসেম্বর ১৯২৫) প্রকাশিত হয় নজরুলের আরও একটি কবিতা ‘কৃষকের গান’। তৃতীয় সংখ্যায় (৭ই জানুয়ারি ১৯২৬) প্রকাশিত ‘সব্যসাচী’ কবিতা। তৃতীয় সংখ্যায় নজরুলের একটি প্রবন্ধও ছাপা হয়, শিরোনাম ‘পোলিটিক্যাল তুবড়িবাজি’। তাতে কানপুরে কংগ্রেস অধিবেশনের পাশাপাশি কমিউনিস্ট সম্মেলনের প্রসঙ্গও নজরুল উল্লেখ করেন। প্রসঙ্গত, জানুয়ারি থেকে নজরুল অসুস্থতার জন্য কলকাতা ছেড়ে মুখ্যত কৃষ্ণনগরেই থাকতেন। ১৯২৬ সালের ২২-২৩শে মে কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলন।
কানপুর কমিউনিস্ট সম্মেলন থেকে কলকাতায় ফিরে এবং ৩৭ নম্বর হ্যারিসন রোডের ঠিকানায় থেকে শ্রমিক প্রজা স্বরাজ দলের নীতি ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মুজফফর আহমদ অবহিত হন। তবে ‘লাঙল’র পঞ্চম সংখ্যাতেই (২১শে জানুয়ারি ১৯২৬) মুজফফর আহমদ একটি ‘আবেদন’ প্রকাশ করেন কানপুর সম্মেলনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক গোটা দেশের সঙ্গে বাংলা প্রদেশেও কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের জন্য সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে। কানপুর সম্মেলনের বিস্তারিত সংবাদও ওই সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ‘লাঙল’-র সেই সংখ্যাটি ছিল ‘সুভাষচন্দ্র বসু’ বিশেষ সংখ্যা। সুভাষচন্দ্র তখন বার্মায় বন্দি ছিলেন।
‘লাঙল’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা থেকেই ছাপা শুরু হয় কার্ল মার্কসের জীবনী এবং গোর্কির মা উপন্যাসের অনুবাদ। মার্কসের জীবনী লিখতেন দেবব্রত বসু। ‘মা’-র অনুবাদ করতেন নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ ‘ধূমকেতু’তেও লিখতেন; তবে ‘ত্রিশূল’ ছদ্মনামে।
তবে এই আবেদন প্রকাশের আগেই ‘লাঙল’-এর চতুর্থ সংখ্যায় (১৪ই জানুয়ারি ১৯২৬) প্রকাশিত হয় মুজফফর আহমদের প্রথম প্রবন্ধ ‘ভারত কেন স্বাধীন নয়?’ কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলাভাষায় জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের রাজনৈতিক স্তরকে ব্যাখ্যা করার প্রথম চেষ্টা ছিল সেই প্রবন্ধটিই।
মুজফফর আহমদ শ্রমিক প্রজা স্বরাজ পার্টি এবং ‘লাঙল’-র সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে।
১৯২৬ সালের ৬-৭ই ফেব্রুয়ারি কৃষ্ণনগরে শ্রমিক প্রজা স্বরাজ পার্টির দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে দলের নামকরণ হয় ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দল’। নতুন নামকরণ শুধু নয়, আগের মতো জাতীয় কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত দল হিসাবে তা আর থাকলো না। যদিও এই দলের সদস্যরা জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে যে কাজ করতেন নয়। কৃষ্ণনগর সম্মেলনে সাহিত্যিক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত নতুন দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। হেমন্তকুমার সরকার সম্পাদক। নজরুল ইসলাম, মুজফফর আহমদ, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ নির্বাচিত হন দলের কার্যকরী কমিটিতে। নজরুলের লেখা ‘শ্রমিকের গান’ গেয়ে কৃষ্ণনগরে সম্মেলনের উদ্বোধন হয়। কৃষ্ণনগর সম্মেলনের পর ‘লাঙল’ পরিণত হয় ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দল’-র মুখপত্রে।
কৃষ্ণনগর সম্মেলনের পরের মাসে ‘লাঙল’-এর সম্পাদক বদল হয়। প্রথম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যায় (২৫শে মার্চ ১৯২৬; ১১ই চৈত্র ১৩৩২) দেখা যাচ্ছে, মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের জায়গায় নতুন সম্পাদক হয়েছেন গঙ্গাধর বিশ্বাস।
‘লাঙল’ প্রকাশিত হয় মাত্র ষোলোটি সংখ্যা। মাত্র চার মাসে। ১৯২৫ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে ১৯২৬ সালের ১৫ই এপ্রিল। ‘লাঙল’ বন্ধ হয়ে যায় মূলত আর্থিক সমস্যার কারণে। তার সঙ্গে ছিল কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। ১৯২৬ সালের কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা চলেছিল ২রা এপ্রিল থেকে ৯ই মে। মাঝে ১৩ এপ্রিল থেকে ২১শে এপ্রিল। দাঙ্গায় ১১০ জন নিহত হন; আহতের সংখ্যা ৯৭৫। দাঙ্গা তারপরও থেমে যায়নি। বছর জুড়েই কমবেশি চলে দেশের নানা এলাকায়। দাঙ্গার কারণে ‘লাঙল’-র মতো একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ সংবাদপত্রের পক্ষে টিকে থাকা শক্ত হয়ে ওঠে।
দাঙ্গার প্রকোপ কলকাতায় একটু কমার পর বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দল নতুন একটি মুখপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেন।
১৯২৬ সালের ১২ই আগস্ট প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘গণ-বাণী’। ‘গণ-বাণী’র ডিক্লারেশন নেয়া হয় মুজফফর আহমদের নামে। নজরুল ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা ‘গণ-বাণী’তে প্রকাশিত হয়। ১৯২৬-র ২৬শে আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত হয় নজরুলের বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘মন্দির ও মসজিদ’। ২রা সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয় নজরুলের প্রবন্ধ ‘হিন্দু-মুসলমান’। ‘গণ-বাণী’তেই প্রকাশিত হয় নজরুলের অনূদিত ইন্টারন্যাশনাল সংগীত। তবে ‘গণ-বাণী’ও নিয়মিত প্রকাশ করা ছিল শক্ত। বারবার তার প্রকাশনায় ছেদ ঘটে। ‘গণ-বাণী’ শেষপর্যন্ত প্রকাশিত হয় যতদূর সম্ভব ১৯২৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত।
তবে ১৯২৭-২৮ সালে নজরুল সাপ্তাহিক ‘সওগাত’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯২৯ সালের মার্চের পর রাজনৈতিক কার্যকলাপে নজরুল সেভাবে যুক্ত ছিলেন না। রাজনৈতিক সাংবাদিকতাতেও সেভাবে যুক্ত থাকা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ১৯২৯ সালের ২০শে মার্চ মুজফফর আহমদসহ অনেকে মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে যান। মুজফফর আহমদ ছাড়া পান ১৯৩৬ সালে। তখনও কমিউনিস্ট পার্টি ছিল নিষিদ্ধ।
সাংবাদিকতার সঙ্গে নজরুলের সর্বশেষ সংযোগ প্রভাতী দৈনিক ‘নবযুগ’-র সঙ্গে; যার কথা আগেই বলা হয়েছে। সুস্থ অবস্থায় মাস আস্টেক নজরুল প্রভাতী ‘নবযুগ’-এ যুক্ত থাকতে পেরেছিলেন।
নজরুল তার স্বভাবোচিত স্বাধীনতা নিয়ে সংবাদপত্র সম্পাদনা ও পরিচালনায় যুক্ত থাকতে পেরেছিলেন সাপ্তাহিক ‘লাঙল’ পত্রিকাতেই।
‘লাঙল’-র অবদান
‘লাঙল’ই বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র যা সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা বাংলাভাষী পাঠকের কাছে তুলে ধরে। ‘লাঙল’-র মাধ্যমেই শ্রমজীবী মানুষের রাজনৈতিক ভূমিকা বাংলা সাংবাদিকতায় উচ্চারিত হয়।
বাংলা সাংবাদিকতায় ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে আপসহীন দৃঢ়তার সঙ্গে তুলে ধরার জন্যও ‘লাঙল’ এবং ‘গণ-বাণী’র নাম স্মরণীয়। বিশেষত তথাকথিত জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রগুলোর অনেকে যখন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের পথ বেছে নেয়।
‘লাঙল’ পত্রিকাই প্রথম বাংলার কৃষক সমাজের সংগঠিত রাজনৈতিক ভূমিকার ওপর স্পষ্টভাবে আলোকপাত করে। নজরুলকে প্রধান পরিচালক করে ‘লাঙল’ নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশের রাজনৈতিক গুরুত্ব ১৯২০-র দশকের মধ্যভাগে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে বাস্তবেও ‘লাঙল’ শুধু কৃষক সমাজ নয়, শ্রমিক কৃষকসহ শ্রমজীবী মানুষের কথা তুলে ধরতো। ‘লাঙল’-র ‘গণ-বাণী’তে রূপান্তর তাই যথার্থই ছিল।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ‘লাঙল’ তো বটেই, এমনকি সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’-র সময় থেকেই নজরুলের সাংবাদিকতা জীবনের সূত্রপাত হয় এমন এক সময়ে যখন বাংলা তথা দেশীয় ভাষায় দৈনিক সংবাদপত্রের যুগ আত্মপ্রকাশ করেছে। দৈনিক সংবাদপত্রের যুগ মানেই গণপাঠকের জন্য সংবাদ পরিবেশন। মতামত নয়, সংবাদ এবং তথ্যই যেখানে মূল উপজীব্য। তার উপযোগী এক ভাষারীতিরও উদ্ভব ঘটতে থাকে বিশের দশকের বাংলা সাংবাদিকতায়। সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’, ‘ধূমকেতু’ এবং ‘লাঙল’ /‘গণ-বাণী’তে সাংবাদিকতার এই নতুন পর্বের অভিঘাত নানা মাত্রায় স্পষ্ট। এনিয়ে বিশেষ চর্চার সুযোগ রয়েছে। যত স্বল্প সময়ের জন্য হোক না কেন বাংলা সাংবাদিকতায় নজরুলের অবদান সুনির্দিষ্ট এবং অনন্য বললে ভুল হবে না। ‘লাঙল’-র শতবর্ষ উদ্যাপন আজকের প্রজন্মের বিশেষ দায়িত্ব।