ঢাকা, ৯ মে ২০২৫, শুক্রবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

বাংলারজমিন

সাবেক মন্ত্রী ফরহাদের সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে বিএডিসি, ডিলাররা অসহায়

এ. জে. সুজন, কুষ্টিয়া থেকে
১৭ মার্চ ২০২৫, সোমবার
mzamin

আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের সিন্ডিকেট এখনো নিয়ন্ত্রণ করছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। আওয়ামী লীগের ওই সিন্ডিকেটের কাছে অনেকটা অসহায় বিএডিসি’র ডিলাররা। অভিযোগ উঠেছে- ফরহাদের সিন্ডিকেটকে বর্তমানে নিয়ন্ত্রণ করছেন বিএডিসির আওয়ামীপন্থি কয়েকজন কর্মকর্তা। ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও ঢাকা কৃষি ভবনের বড় বড় চেয়ারে বসে আছেন আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তারা। তারাই নানা কৌশলে ওই সিন্ডিকেটকে সক্রিয় করে রেখেছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন বিএডিসির ডিলাররা। বর্তমানে ওই সিন্ডিকেট আরও বেপরোয়া হয়ে ডিলারদের জিম্মি করে ফেলেছেন। ওই সিন্ডিকেটের বাইরে গুদাম থেকে কোনো ডিলার ধান বীজ উত্তোলন করতে পারছেন না। চলতি বোরো মৌসুমে বিএডিসির পুনঃনির্ধারিত দরের ধান বীজ ডিলারদের মধ্যে বরাদ্দ দেয় বিএডিসি। কিন্তু সারা দেশের ওই বীজের নিয়ন্ত্রণ নেন ফরহাদ হোসেনের সিন্ডিকেট। বিএডিসির আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রায় দুই হাজার টন পুনঃনির্ধারিত দরের বোরো ধান বীজ ওই সিন্ডিকেট উত্তোলন করে কালোবাজারে বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
কুষ্টিয়া জেলা বিএডিসির বীজ ও সার ডিলার এসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক মোস্তফা জামান সাঈদী সাগর বলেন, বর্তমানে ডিলাররা চুয়াডাঙ্গা গুদাম থেকে কোনো বীজ উত্তোলন করতে পারছেন না। বিএডিসি’র কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রীর লোকজন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ডিলারদের হাজার হাজার টন ধান বীজ বিএডিসির কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশে সাবেক মন্ত্রীর লোকজন উত্তোলন করে নিয়েছেন। ৫ই আগস্টের পরে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের ম্যানেজ করে বিএডিসিতে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করেছে ওই সিন্ডিকেট।
সূত্রে জানা যায়, দেশের সর্ববৃহৎ বীজ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত। অন্যদিকে বিএডিসির মুজিবনগর সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের শত শত কোটি টাকার কাজ এ অঞ্চলে চলমান রয়েছে। এ ছাড়াও বিএডিসির একাধিক প্রকল্প রয়েছে বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলায়। ফরহাদ হোসেনের স্ত্রী সৈয়দা মোনালিসা ও ভাই সরফরাজ হোসেন মৃদুলের সিন্ডিকেট পুরো বিএডিসিকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। আর ওই সিন্ডিকেটের মূল হোতা ছিলেন বিএডিসির এক সময়ের লেবার ঠিকাদার চুয়াডাঙ্গা জেলার সালাউদ্দিন মিয়ার ছেলে শামসুর রশিদ দিপু।  বর্তমানে সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ফরহাদ হোসেনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ লোক বলে পরিচিত শামসুর রশিদ দীপু।  
বিএডিসি’র একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন, আওয়ামী লীগপন্থি বিএডিসির কৃষিবিদ সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির ২০২২-২৩ মেয়াদে নির্বাহী সদস্য ছিলেন বর্তমানে ঢাকা কৃষি ভবনের মহাব্যবস্থাপক (বীজ) আবীর হোসেন ও একই কমিটির নির্বাহী সদস্য বর্তমানে অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক (বীজ বিতরণ)  সেলিম হায়দার। এই দুই কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেনের সিন্ডিকেটকে নানা কৌশলে সহযোগিতা করে সক্রিয় করে রেখেছেন বলে অভিযোগ করেছেন বিএডিসির ডিলাররা। অভিযোগের বিষয়ে কৃষি ভবনের অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক (বীজ বিতরণ)  সেলিম দায়দার বলেন, আমি মিটিংয়ে আছি। এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে পরে কথা বলবো।
বিএডিসি’র চুয়াডাঙ্গা অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে চুয়াডাঙ্গা বিএডিসির প্রসেসিং সেন্টারে প্রায় এক হাজার ৯ শত টন ও অধিক বীজ উৎপাদন কেন্দ্রে (বীউ) প্রায় ৯ শত টন বোরো ধান বীজ মজুত ছিল। মজুতকৃত বীজের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল খুলনা অঞ্চলের ডিলারদের জন্য বরাদ্দ। প্রসেসিং সেন্টার ও অধিক বীজের গুদামে শুধু খুলনা জেলার ডিলারদের বীজ ছিল প্রায় এক হাজার তিন শত টন। বাকি বীজ ছিল কুষ্টিয়া, ঢাকা, জয়পুরহাট, ফরিদপুর, রাজশাহী, যশোর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, বগুড়া, কুমিল্লা ও পাবনা জেলাসহ ২২ জেলার। গত ২রা মার্চ ঢাকা কৃষি ভবনের মহাব্যবস্থাপক (বীজ) আবীর হোসেন স্বাক্ষরিত পত্রে মজুতকৃত বীজের দাম কমিয়ে নতুন দর নির্ধারণ করেন। ওই পত্রের সঙ্গে একটি সংযুক্তি পত্রে পুনঃনির্ধারিত দরে বোরো ধান বীজ বিক্রির সময়াবদ্ধ ও কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। 
বিএডিসির ডিলারদের অভিযোগ, মাঠ পর্যায়ে ওই পত্রের কোনো কার্যকারিতা ছিল না। ঢাকার আওয়ামীপন্থি বিএডিসির কর্মকর্তারা অঞ্চলের কর্মকর্তাদের নিকট চিঠি প্রেরণ করে মৌখিকভাবে আওয়ামী সিন্ডিকেটকে বীজ দেয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। যার কারণে কয়েকজন ডিলার ছাড়া কোনো ডিলার বীজ উত্তোলন করতে পারেননি। ঢাকা কৃষি ভবনের আওয়ামীপন্থি দুই কর্মকর্তা আবীর হোসেন ও সেলিম হায়দারের মৌখিক নির্দেশে সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের সিন্ডিকেট বিপুল পরিমাণ ধান বীজ উত্তোলন করে কালোবাজারে বিক্রি করেছেন বলে জানান ডিলাররা।
কুষ্টিয়া জেলা বিএডিসির বীজ ডিলার এসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, পুরো বিএডিসিকে জিম্মি করে ফেলা হয়েছে। কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে একটি সিন্ডিকেট বিএডিসি নিয়ন্ত্রণ করছেন। এখানে ডিলাররা অসহায় হয়ে পড়েছে। এটা ভালো কোনো লক্ষণ নয়। এতে কৃষি সেক্টরে বড় প্রভাব পড়বে।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে পরিচিত খুলনা বিএডিসির ডিএডি আনোয়ার হোসেন। আওয়ামী লীগের আমলে নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করে তিনি একই কর্মস্থলে প্রায় ৭ বছর চাকরি করছেন। ঢাকার আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তাদের মৌখিক নির্দেশে খুলনা বিএডিসির কর্মকর্তারা ওই অঞ্চলের স্থানীয় ডিলারদের নামে মেমো কেটে প্রায় এক হাজার দুইশ’ টন বীজ আওয়ামী সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দিয়েছেন। খুলনা অঞ্চলের অধিকাংশ ডিলার পুনঃনির্ধারিত দরের বোরো ধান বীজ উত্তোলন করেননি বলে জানান। অথচ নির্ধারিত ১০ই মার্চের মধ্যে সমুদয় বীজ ডিলাররা উত্তোলন করেছেন বলে দাবি করেন বিএডিসির খুলনা অঞ্চলের উপ-পরিচালক দীপঙ্কর। তিনি বলেন, আমরা ডিলারদের মেমো কেটে দিয়েছি। ডিলাররা কোথায় বা কার কাছে বিক্রি করছে তা আমাদের জানা নেই। যদি অফিস থেকে কোনো অনিয়ম হয়, সেটি আমি দেখবো। খুলনা বিএডিসির বীজ ও সার ডিলার এসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল হাই বলেন, আমি কোনো বীজ পাইনি। তবে আমাকে অফিস থেকে অল্প কিছু টাকা দিয়েছে। মেহেরপুর জেলার প্রবীণ বীজ ডিলার আরমান আলী বলেন, চুয়াডাঙ্গা গুদাম থেকে ডিলাররা কোনো ধান বীজ উত্তোলন করতে পারছেন না। আমি নিজে বীজ উত্তোলন করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েছি। একটি চক্র সব ধান উত্তোলন করছেন। কিন্তু ডিলাররা গেলেই হুমকি-ধামকি দেয়া হচ্ছে। এখানে সাধারণ ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করার কোনো পরিবেশ নেই। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আওয়ামী সিন্ডিকেটের হোতা শামসুর রশিদ দিপু বলেন, আমরা ব্যবসা করি। সবার সঙ্গেই আমার সম্পর্ক আছে। আমি ডিলারদের মাল বিক্রি করি। অফিসে খোঁজ নিয়ে দেখেন সব জানতে পারবেন। চুয়াডাঙ্গা বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রের (বীপ্রকে) যুগ্ম পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, বাইরে কী হচ্ছে আমি জানি না। আঞ্চলিক বীজ বিপণন দপ্তর থেকে যারা মেমো নিয়ে আসছেন, তাদেরকেই বীজ দেয়া হচ্ছে।

পাঠকের মতামত

প্রতিটি প্রতিষ্ঠান থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের অপসারণ করতে হবে। অন্যথায়, সরকার ভালো ফলাফল অর্জন করতে পারবে না।

Md. Amir Hossain
১৭ মার্চ ২০২৫, সোমবার, ৫:২১ অপরাহ্ন

বাংলারজমিন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

বাংলারজমিন সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status