শেষের পাতা
সিলেটে প্রশাসনের কার্যক্রমে স্থবিরতা
ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, মঙ্গলবারঅনেক কিছুই সামলাতে পারছে না সিলেটের প্রশাসন। চাপ নিতেও পারছেন না শীর্ষে বসা কর্মকর্তারাও। অস্থির সময়ে তাদের মধ্যে বিরাজ করছে অস্থিরতা। এই অবস্থার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কার্যক্রমে নেমে এসেছে স্থবিরতাও। যদিও প্রশাসনের কর্মকর্তারা সেটি মানতে নারাজ। ৫ই আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সিলেটের প্রশাসনে বড় ধরনের রদবদল করা হয়। এই রদবদলের আওতায় জেলা প্রশাসন সহ সব ক্ষেত্রেই নতুন কর্মকর্তারা পদে আসীন হয়েছেন। কবে তাদের মেয়াদও ছয় মাস হয়ে গেছে। কিন্তু প্রশাসনে এখনো পুরোপুরি গতি ফিরে আসেনি। প্রশাসন পুরোপুরি সক্রিয় না হওয়ার কারণে সিলেটের অনেক ক্ষতিই হয়ে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাটে। সিলেটে রয়েছে ১০-১২টি বালু ও পাথর কোয়ারি। অভ্যুত্থানের পর থেকে বিশেষ করে তিনটি পাথর কোয়ারি থেকে হাজার কোটি টাকার পাথর লুট হয়ে গেছে। এখনো সেই লুটপাটের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না সিলেটের প্রশাসন। নতুন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহমুদ মুরাদ প্রায় পাঁচ মাস ধরে সিলেটে রয়েছেন। এক্ষেত্রে তার গাফিলতিকেই দায়ী করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ৫ই আগস্টের পর বালু ও পাথর লুটপাটের ক্ষতি নির্ণয় করতে আগের জেলা প্রশাসকের তরফ থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সেই কমিটির সমীক্ষায় দেখা গেছে, মাত্র ২০ থেকে ২৫ দিনে জাফলং, ভোলাগঞ্জ ও বিছনাকান্দি কোয়ারি থেকে দেড়শ’ কোটি টাকার পাথর লুটপাট হয়েছে। এরপর নতুন জেলা প্রশাসক এলেও ওই লুটপাট বন্ধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পারেননি। ব্যবসায়ীদের মতে, ছয় মাসের লুটপাটে ক্ষয়ক্ষতি দাঁড়াবে হাজার কোটি টাকা। পাথর ও বালু লুটপাটে সীমান্তবর্তী এলাকার কোয়ারিগুলোর মানচিত্রই বদলে যাচ্ছে। ঢাকা-সিলেট ৬ লেন মহাসড়কের কাজের বিলম্বের ক্ষেত্রে সবসময়ই ভূমি অধিগ্রহণের দেরির কথা বলে আসছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও। এখনো তারা সিলেট থেকে শেরপুর অংশের সব ভূমি বুঝে পাননি। আগের সরকারের মন্ত্রী, এমপিরা কাজ বিলম্ব হওয়ার জন্য প্রশাসনকে দায়ী করেছিলেন। বর্তমানেও চলছে একই পরিস্থিতি। এখনো নানা জটিলতায় অধিগ্রহণ করা সব ভূমি প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের কাছে বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি। আগের যে ধীরগতি ছিল তার চেয়ে এখন আরও গতি কমেছে বলে জানিয়েছেন অধিগ্রহণ করা ভূমির মালিকরা। দিনের পর দিন প্রশাসনে ঘুরলেও ভূমি অধিগ্রহণের কাজে গতি আসছে না। গতিহীনতার কারণে এখনো জেলা প্রশাসন থেকে নতুন কারাগার ও মেরিন একাডেমির ভূমির মালিকরা টাকা পাচ্ছেন না। সিলেটের জেলা প্রশাসনের সেবাভোগী অনেকের সঙ্গেই কথা বলে জানা গেছে, অভ্যুত্থানের পর থেকে প্রশাসনে ফাইল নড়ে না। এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ফাইল যেতে ১০-১২ দিনও সময় লেগে যায়। এরপর নির্দেশ আসে নতুন করে ‘রিভাইস’ করে দেয়ার জন্য। এটি এখন সিলেট জেলা প্রশাসনের নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রশাসনের গতিহীনতার বিষয় নিয়ে কথা বলেন। তারা জানান, অভ্যুত্থানের পর প্রশাসনের নাগরিক সুবিধা অনেক কমে গেছে।
এ কারণে সেবাভোগী মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। এর মধ্যে অন্যতম একটি ডিজিটাল সেন্টার। এই সেন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই চিত্র ফুটে ওঠে। সহযোগিতা না করে নানা অজুহাতে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে মানুষজনকে। গতকাল সেবা নিতে আসা লোকজন জানান, ডিজিটালে সেবা দ্রুত পাওয়ার কথা। কিন্তু ম্যানুয়ালের চেয়ে আরও বেশি গতিহীন ডিজিটাল সেবা। কর্মকর্তা, কর্মচারীরা জানান, বর্তমান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের সঙ্গে টিমওয়ার্ক গড়েছেন স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক সুবর্ণা সরকার। নতুন জেলা প্রশাসক সিলেটে আসার আগে তিনি ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সিলেটে চাকরির ক্ষেত্রে পুরাতন হওয়ায় জেলা প্রশাসক তার পরামর্শের ওপর বেশি নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে দেখা গেছে, অনেক পরামর্শই জেলা প্রশাসক এককভাবে নিতে পারেন না। প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বদলি করা হয়েছিল। অদৃশ্য কারণে তাদের অনেকেই আবার আগের স্থানে ফিরে এসেছেন। এ ছাড়া উপজেলায় ছয় মাস বদলির মেয়াদ পূর্ণ হয়নি এরকম অনেককেই ফের বদলি করা হয়েছে। এ নিয়ে অসন্তোষও বিরাজ করছে ভেতরে। স্থানীয় সরকার বিভাগে নাগরিক সেবার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- জন্ম মৃত্যু ও ওয়ারিশান সনদ প্রদান করা। সেটি স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে তাদের কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু দিনের পর দিন কেটে গেলেও ওই দপ্তর থেকে আসে না জন্ম-মৃত্যুর সনদ। নানা কারণে সেগুলো আটকে রাখা হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুর নিয়েও সিলেটের পরিস্থিতি ঘোলাটে করার জন্য দায়ী করা হচ্ছে জেলা প্রশাসককে। তার তরফ থেকে দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে বাইরে থেকে তৌহিদী জনতা, কোটা বিরোধী আন্দোলনের নেতাকর্মী গিয়ে দফায় দফায় ভাঙচুর করে। পরে সেটি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। ওই সময় জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন সংশ্লিষ্টরা। ডিসি সম্মেলনে ঢাকায় থাকায় কথা হয় সিলেট জেলা প্রশাসকের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক সুর্বণা সরকারের সঙ্গে। তিনি মানবজমিনকে জানান, বালু পাথর লুট বন্ধ করতে প্রতিদিনই অভিযান চালানো হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান, মামলা ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রশাসনের কোনো গাফিলতি নেই।
ঢাকা-সিলেট রুটে ভূ১মি অধিগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখনো কিছু কাজ বাকি আছে। তবে সিংহভাগ কাজই শেষ করা হয়েছে। বাকিটুকুও খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাবে বলে জানান তিনি। এদিকে, প্রশাসনের ভেতরে কাজের এই গতিহীনতার জন্য আস্থাহীনতাকে দায়ী করেছেন সিলেটে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, অভ্যুত্থানের পর প্রশাসনের কর্মকর্তারা এখনো আস্থাহীনতায় রয়েছেন। তারা নার্ভাস। তাদের মধ্যেও যে ভয় কাজ করছে সেটি কাটাতে হবে। এজন্য সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে কাজ করতে হবে। সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির একাধিক বারের সাবেক সভাপতি এডভোকেট ইইউ শহীদুল ইসলাম শাহীনের মতে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বালু পাথর লুট বন্ধ সহ সবক্ষেত্রে প্রশাসনকে গতি ফেরাতে কাজ করতে হবে। এজন্য স্বচ্ছতার ভিত্তিতে বদলি ও পদায়ন করলে আস্থার জায়গা ফিরে আসবে বলে মনে করেন তিনি।