শেষের পাতা
লকার নিয়ে আতঙ্কে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা
মারুফ কিবরিয়া
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, রবিবার
সেফ ডিপোজিট লকার নিয়ে গত কয়েকদিনে বেশ আলোচনা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরীর লকার খোলার পরপর আলোচনায় আসে অন্য কর্মকর্তাদের বিষয়টিও। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নতুন করে আরও কয়েকজনের লকার শনাক্ত করেছে। যাদের লকারে কোটি কোটি টাকা ও বৈদেশিক মূদ্রা মিলতে পারে বলে ধারণা করছে সংস্থাটি। সেই ধারাবাহিকতায় আজ রোববার দুদকের অনুসন্ধানকারী দলটি আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে কিছু লকার খুলতে যাচ্ছে।
এদিকে সেফ ডিপোজিট নিয়ে যখন চারদিক সরগরম, তখনই বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক শুরু হয়ে গেছে। জানা গেছে, দুদকের তালিকায় থাকা কর্মকর্তারাই বেশি আতঙ্কে ভুগছেন। তবে এখনও কেউ জানেন না কার কার লকার খোলা হচ্ছে আজ। তার আগেই ব্যাংক কর্মকর্তাদের একটি অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দুদকের কার্যক্রম নিয়ে নেতিবাচক পোস্ট করে যাচ্ছেন।
দুদকের একাধিক কর্মকর্তা মানবজমিনকে জানিয়েছেন, এস কে সুর চৌধুরীর লকার খোলার পর বিপুল অংকের অর্থ-সম্পদ পাওয়া গেছে। এর ধারাবাহিকতায় দুদক অনুসন্ধান দল অন্যান্য কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে লকার খোলার প্রস্তুতি নিয়েছে। কিন্তু বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের অনেকেই ভালোভাবে নিচ্ছেন না। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় দুদক নিয়ে বিষোদগার করছেন। অনেক কর্মকর্তা দুদকের অনুসন্ধান কার্যক্রমকে মিডিয়া ট্রায়াল বলেও আখ্যা দিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, লকার খোলার ইস্যুতে একাধিকবার বেশক’জন নিজেদের মধ্যে গোপনে মিটিং করেছেন বলেও দুদকের গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত হতে পেরেছে।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তালিকা আমাদের কাছে রয়েছে। যারা ইতিমধ্যেই নানা কারণে দুদকের মামলার আসামি ও অনুসন্ধানে তালিকাভুক্ত। সেই তালিকায় থাকা কর্মকর্তাদের সেফ ডিপোজিট লকার খোলার বিষয়ে অগ্রাধিকার রয়েছে আমাদের। এ ছাড়া ধাপে ধাপে আরও কয়েকজনের বিষয়ে দুদকের গোয়ন্দা অনুসন্ধান রয়েছে এমন ব্যক্তিদের লকারও খোলা হবে।
দুদক বলছে, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সেফ ডিপোজিট থাকাটা কোনো সমস্যার না। কিন্তু সেখানে কে কি রাখছেন তা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের জানা উচিত। এবং তা অবশ্যই আয়কর রিটার্নে উল্লেখ থাকতে হবে। তা না হলে একজন ব্যক্তি তার লকারে কী রাখছেন সেটা আড়ালেই রয়ে যাবে। এমনকি এ ধরনের ব্যাংকিং সুবিধায় যে কেউ অনায়াসেই তার আয়-বহির্ভূত অর্থ-সম্পদ সেখানে গোপন করে রাখতে পারেন।
সংস্থাটির কর্মকর্তাদের ভাষ্যে, একজন ব্যক্তি এই লকার সার্ভিসে টাকা বা বৈদেশিক মুদ্রা রাখলেন কিংবা সোনাদানা জমা করলেন। কিন্তু রিটার্নে উল্লেখ না থাকায় তার বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলাকালীন সময়ে আড়াল হয়ে যায়। ফলে দুদকের অনুসন্ধান এক প্রকার অসম্পূর্ণ থেকে যায়। লকার সার্ভিসের বিষয়টি খোলামেলা হলে সংস্থার অনুসন্ধান কার্যক্রমে দুর্নীতিবাজদের ধরা আরও সহজতর হবে বলেও মনে করছেন দুদক সংশ্লিষ্টরা।
দুদকের একটি সূত্র জানায়, আজ রোববার লকার খোলা হবে। সকাল থেকেই সংস্থাটির পরিচালক কাজী সায়েমুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি দল বাংলাদেশ ব্যাংকে সেই ডিপোজিট লকার খুলবেন।
দুদকের তালিকায় যারা:
বাংলাদেশ ব্যাংকের ২৫ জনেরও বেশিসংখ্যক কর্মকর্তার দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান করছে দুদক। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের হয়েছে। মূলত তাদেরই লকারে দুদকের নজর রয়েছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোরশেদ আলম, ড. হাবিবুর রহমান, সাবেক উপদেষ্টা আবু ফরাহ মো. নাসের ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলছে। এ ছাড়া অপর সাবেক দুই ডেপুটি গভর্নর কাজী সাইদুর রহমান ও নুরুন নাহারের লকারও সংস্থাটি খুলবে বলে জানা গেছে। গত বছর ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তারা চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন।
এ ছাড়াও তালিকায় আরও যাদের নাম রয়েছে তারা হলেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক মো. সারোয়ার হোসেন, যুগ্ম পরিচালক (চট্টগ্রাম) সুনির্বাণ বড়ুয়া, যুগ্ম পরিচালক (চট্টগ্রাম) জোবাইর হোসেন, ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগের অনিক তালুকদার, রুবেল চৌধুরী, লেলিন আজাদ পলাশ, অতিরিক্ত পরিচালক মো. আবদুর রউফ ও অতিরিক্তি মো. মঞ্জুর হোসেন খান। দুদক বলছে, ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ঋণের নামে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে। ২০২৩ সালের দুদক উপ-পরিচালক মো. ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে একটি দল অনুসন্ধান শুরু করেছে। সংস্থাটির অনুসন্ধান দল মনে করছে, তাদের লকারেও অনেক দেশি-বিদেশি মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কার থাকতে পারে। আর এসব সম্পদ অপ্রদর্শিত আয় থেকেই গড়া বলেও মনে করছেন দুদক কর্মকর্তারা।
দুদকের অনুসন্ধান তালিকায় রয়েছেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার জাকির হোসেন ও ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ইমাম সাঈদেরও। তাদের বিরুদ্ধে বিদেশে নাগরিকত্ব গ্রহণ ও মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগও রয়েছে। ২০২৩ সালের ৩০শে এপ্রিল তাদের দুদক উপ-পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল অনুসন্ধান শুরু করে।
এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান যেসব কর্মকর্তার লকারে দুদকের নজরদারি রয়েছে তারা হলেন- সাবেক নির্বাহী পরিচালক এসএম মনিরুজ্জামান, যুগ্ম পরিচালক মো. ওয়াদুদ, সাবেক উপ-পরিচালক মোফাজ্জল হোসেন, সাবেক সহকারী পরিচালক (ক্যাশ) আনোয়ার হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেইনিং একাডেমির সহকারী পরিচালক আমিরুজ্জামান মিয়া, সাবেক ডিজিএম তরুণ কান্তি ঘোষসহ প্রমুখ।
লকার খোলার বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, ব্যাংক কর্মকর্তাদের লকার খোলার বিষয়ে দুদকের একটি টিম কাজ করছে। আদালত অনুসন্ধান দলকে এরই মধ্যে অনুমতি দিয়েছেন। রোববার খোলা হবে কিনা নিশ্চিত বলতে পারবে ওই টিম। আসলে এটা অনুসন্ধান দলেরই জানার কথা।
পাঠকের মতামত
সব লকার খোলা হোক, সব দূর্নীতিবাজদের লকারে ঢোকানো হোক
দুদকের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিষয়ে অনুসন্ধান করা হয়েছে কি? তারা কি সবাই সৎ?