শরীর ও মন
রূপচর্চার খেসারত
মেহনাজ শাহরিন অর্থি
৩১ জানুয়ারি ২০২৫, শুক্রবার
রূপচর্চা কখনো কখনো ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনে। আজকাল ফেসবুকসহ সামাজিক নানা যোগাযোগমাধ্যমে রূপচর্চার নানা দিক তুলে ধরে। এতে অনেকে আগ্রহী হয়ে একে ফলো করে। কিন্তু হায়! বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এতে দেখা দেয় হিতে বিপরীত। রূপ সৌন্দর্যের বদলে দেখা দেয় রোগ। অনেক ক্ষেত্রে যা স্থায়ী হয়ে দাঁড়ায়।
এমনই এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন রুমি নামের এক তরুণী। রুমি বলেন, এক সময় আমার রাতে ঘুম হতো না। ভোরের দিকে ঘুমাতাম আর দুপুরে উঠতাম। এভাবে কয়েকদিনের মধ্যে আমার চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে। সেই দাগ দিন দিন বাড়ছিল। একদিন আমি ইউটিউবে একটা ভিডিওতে দেখছিলাম যে কাচা আলুর টুকরা চোখের নিচে মেসেজ করলে চোখের নিচের কালো দাগ দূর হয়ে যায়। এটা দেখে আমি প্রতিদিন কমপক্ষে তিনবার এই পদ্ধতি অবলম্বন করি। এতে আমার চোখের নিচের চামড়া উঠতে শুরু করলো এবং এক রকম গর্ত হতে লাগলো। সেটা দেখতে বেশ বিকট লাগছিল। এরপর এলাকার স্থানীয় এক ডাক্তারের পরামর্শে কিছু মলম, ওষুধ এবং তরল ওষুধ ব্যবহার করতে শুরু করি। এতে কালো দাগ অনেকটা দূর হলেও চোখের নিচের গর্ত রয়ে যায়। নিজের করা ছোট একটা ভুলের মাশুল এখন গুনতে হচ্ছে আমাকে।
মুন নামের আরেক তরুণী বলেন, আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছোটবেলা থেকে আঁচিল ছিল। কিন্তু বড় হওয়ার পর হাতে একটা আঁচিল দেখা দেয়। আর সেটা খুব অল্প সময়ের মধ্যে বড় হতে লাগলো। আমার কাছে মনে হচ্ছিল যে এটা আমার হাতের সৌন্দর্য নষ্ট করছে। এক আত্মীয়ের পরামর্শে আঁচিলে চুল পেঁচিয়ে রাখলে সাতদিনের মধ্যে ওটা পড়ে যায়। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে ওই একই জায়গায় আবার আরেকটা আঁচিল ওঠে এবং সেটাও অল্প দিনের মধ্যে বড় হতে শুরু করে। এরপর আমি আমার এক বান্ধবীর পরামর্শ মাফিক কাপড় কাচা ডিটারজেন্ট পাউডারের সঙ্গে চুন মিশিয়ে সেই আঁচিলে লাগালে ওখানে বেশ যন্ত্রণা হয়। এভাবে আমি প্রায় পাঁচদিন এই পদ্ধতি ব্যবহার করলে আঁচিল পড়ে যায়। কিন্তু হাত থেকে প্রচুর রক্তপাত হয়। কিছুদিন পর দেখি আমার হাতে কালো দাগ হয়ে আছে। তখন আমি কালো দাগ দূর করার জন্য যাত্রাবাড়ীর একটি জায়গা থেকে লেজারের একটা ছোট অপারেশন করি। কিন্তু এতে আমার হাতের দাগ তো দূর হয়নি বরং ওখানে এক রকম ঘা দেখা যায়। পরে মনোয়ারা হাসপাতাল থেকে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে নিয়মিত ওষুধ সেবনের ফলে হাতের ঘা নিরাময় হলেও দাগ রয়ে যায়। ছোট একটা বিষয়, তা নিয়ে কতো কাহিনী করলাম। তবুও সমস্যার সমাধান হলো না।
এ বিষয়ে নর্দান ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হসপিটালের চর্ম ও ভেনারোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও নান্দনিক চর্মবিদ্যার পরামর্শদাতা ডা. তাসনিম খান বলেন, বহুদিন ধরেই আমি কসমেটিক সার্জারি করি। তবে এখনকার সমাজের নারীরা অনেক বেশি উদ্বিগ্ন তাদের চুল, ত্বক কিংবা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের সমস্যাগুলো নিয়ে। আর এই মাত্রাতিরিক্ত উদ্বিগ্নতার ফলে তারা না বুঝেই অনেক সময় ভুল চিকিৎসা করে নিজেদের ক্ষতি নিজেরা করে। কিন্তু তারা প্রথমেই যদি কসমেটিক সার্জারি করানোর জন্য সঠিক জায়গায় যায়, তাহলে সঠিক চিকিৎসাই পায়। ভুল জায়গায় ভুল চিকিৎসা করার ফলে তারা তাদের শারীরিক ক্ষতির সঙ্গে মানসিক ক্ষতিও করে। ভুয়া জায়গায় সাধারণত প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় ভুল পদ্ধতিতে সার্জারি করে জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়। আবার বেশিরভাগ ভুয়া ক্লিনিকগুলোতে সার্জারির জন্য স্যানিটাইজড পরিবেশ না থাকায় ইনফেকশনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। অপরিষ্কার যন্ত্রপাতি বা অপ্রশিক্ষিত হাতের কারণে শরীরে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে মারাত্মক ইনফেকশন এমনকি সেসপিস হতে পারে। অনেক সময় এটি রোগীর মৃত্যুর কারণও হতে পারে। আবার অপেক্ষিত ফলাফল না পাওয়ায় অনেক রোগী মানসিক চাপে ভোগেন। এটি অনেক সময় তার আত্মবিশ্বাসকে কমিয়ে দেয়। কম খরচের লোভ দেখিয়ে ভুয়া জায়গায় সার্জারি করানোর পর তা ঠিক করতে আরও বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়।
সূত্র মতে, চোখের নিচে গর্ত, ডার্ক সার্কেল, কুচকানো, ফোলা বা ঝুলে যাওয়া চোখের পাতায় কসমেটিক সার্জারি করতে বা ব্ল্যাফারোপ্লাস্টি, ফ্যাট ট্রান্সফার, লিপ ফিলার, কেমিকেল পিলিং, লেজার, মাইক্রোনিডলিং এগুলো বেশ ব্যয়বহুল চিকিৎসা। এ ছাড়া চেহারায় বয়সের ছাপ কমিয়ে নিখুঁত গঠন আনতে মিনি-ভি-শেপ ট্রিটমেন্ট ছাড়াও বোটক্স, নোস শেপিং, লিপ শেডিং, ফেস লিফটিং, স্কিন ব্রাইটিং ট্রিটমেন্ট, বায়ো ফিলার ট্রিটমেন্ট বা ত্বককে মসৃণ এবং উজ্জ্বল করতে, চুল পড়া রোধ করতে পি.আর.পি ট্রিটমেন্ট, এক্সোসোম থেরাপি আবার মুখের ত্বকের ঢিলেঢালা ভাব দূর করতে সেই সঙ্গে মুখের অতিরিক্ত চর্বি কমাতে এন্ডোলিপ্ট ফেস লিফটিং ট্রিটমেন্ট বা ট্যাটু রিমুভাল ট্রিটমেন্ট করতে প্রচুর টাকা ব্যয় করতে হয়। সর্বনিম্ন চার হাজার থেকে এক লাখের ওপরে খরচ এমন চিকিৎসাও আছে। ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারের চেহারা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন মানসিকতার তরুণীরা অল্প খরচের লোভে ভুয়া চিকিৎসা করে নিজেদের ক্ষতি নিজেরাই করে ফেলে।