ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

শেষের পাতা

রাজনৈতিক সংস্কার না হলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার অসম্ভব: সিপিডি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
৩০ জানুয়ারি ২০২৫, বৃহস্পতিবার

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) মনে করে, গত স্বৈরাচারী সরকারের সময়ও দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দুর্বল ছিল। ক্ষমতার পালাবদল হলেও গত ছয় মাসে অর্থনীতিতে তেমন চাঞ্চল্য ফেরেনি। অন্তর্বর্তী সরকার কর্মসংস্থান বাড়াতে পারেনি। তাই ভালোভাবে রাজনৈতিক সংস্কার করা না হলে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারও সম্ভব নয়। পাশাপাশি দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বন্ধ করে দিতে হবে। সিপিডি বলেছে, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতা না থাকলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা। সেটা সরকারের ঘোষিত সময়ের মধ্যেই। 

বুধবার রাজধানীর ধানমণ্ডি সিপিডি কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২৪-২৫: সংকটময় সময়ে প্রত্যাশা পূরণের চ্যালেঞ্জ’- শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এসব তথ্য তুলে ধরেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন- সিপিডি’র বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা ফেলো মুনতাসির কামাল, সৈয়দ ইউসুফ সাদাতসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। 

সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন জানান, জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর অন্তর্বর্তী সরকার কয়েকটি খাতভিত্তিক সংস্কারমূলক কর্মসূচিসহ বেশকিছু অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে জনগণের জীবনে ও ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বস্তি আনার মতো উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। চাঁদাবাজি বন্ধ করতে না পারায় নিত্যপণ্যের দাম কমাতে ব্যর্থ হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে আমদানি-রপ্তানিতে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রেমিট্যান্সের গতিতেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। তবে ইতিবাচক এই ধারা কতদিন থাকবে- তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।

কর ফাঁকি রোধ ও রাজনৈতিক সংস্কার না হলে অর্থনৈতিক সংস্কার সম্ভব নয়, জানিয়ে তিনি বলেন- সামগ্রিকভাবে কর রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের বাকি সময়ে ৪৫.১ শতাংশ রাজস্ব আহরণ করতে হবে, যা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এছাড়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সামষ্টিক অর্থনীতিক গতিধারায় উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। সিপিডি বলছে, বর্তমানে রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি ৩.৭ শতাংশ যা পূর্বের সরকারের সময় থেকে অনেক অনেক কম। রিজার্ভের অবস্থা তেমন সন্তোষজনক নয় এবং বিদেশি বিনিয়োগের প্রকল্প বাস্তবায়ন যেন অব্যাহত থাকে সে বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া দরকার।

দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বন্ধ; ব্যাংক খাত নিয়ে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া ব্যাংকের লাইসেন্স বন্ধ করতে হবে। একই ব্যক্তি যাতে একাধিক ব্যাংকের মালিক হতে না পারেন সেটা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি লাইফ সাপোর্টে থাকা ব্যাংকগুলোকে বন্ধ করে দিতে হবে। ব্যাংকিং খাত দুর্বল হওয়ার পেছনে যেসব গভর্নর দায়ী তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে দুর্বল হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে ব্যাংক খাতের অবস্থার উন্নতি করা যেতে পারে। সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সিপিডি বলছে, বিদেশি ঋণের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। অভ্যন্তরীণ উৎসে নির্ভরতা বাড়ছে, যা আগামীতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। 

এদিকে, সমপ্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে করা এলএনজি সরবরাহের চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে গ্যাসের অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান আরও দুর্বল হবে বলেও জানিয়েছে সিপিডি। এছাড়া পূর্ববর্তী সরকারের নীতিকাঠামোর জন্য বাংলাদেশের জ্বালানি খাত মারাত্মক আর্থিক সংকটে রয়েছে উল্লেখ করে সংস্থাটি জানায়, ঋণের বোঝা কমাতে অতিরিক্ত ব্যয়ে বিদ্যুৎ না কিনে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র বিশেষ করে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বাড়াতে হবে। আদানিসহ সব বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বাতিল করে ‘নো ইলেক্ট্রিসিটি নো পে’- নীতি চালু করতে হবে।

নিত্যপণ্যের দাম কমেনি: নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে চাঁদাবাজি বন্ধ ও মজুতদারি বা অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের মতো অনিয়ম মোকাবিলা করতে পারেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাই নিত্যপণ্যের দাম কমাতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ শৃঙ্খলে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে সাহসী ও জরুরি পদক্ষেপ না নিলে মূল্যস্ফীতির হার কমানো কঠিন হবে।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ফাহমিদা বলেন, সিপিডি’র পর্যবেক্ষণে পিয়াজ, আলু, বেগুন, ডিম, রুই মাছ, হলুদ, গম, মসুর ডাল, চিনি, গরুর মাংস, রসুন, আদা, সয়াবিন তেল এবং পাম তেলসহ ১৪টি বিভিন্ন প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খল বিশ্লেষণে দামের ওঠানামা এবং অদক্ষতার জন্য বেশ কিছু বাধা দেখা দিয়েছে। বেশির ভাগ কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে, প্রাথমিক বাধাগুলোর মধ্যে রয়েছে মজুতদারি, কমিশন এজেন্ট বা গুদাম পরিচালনাকারীদের আধিপত্য। অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, চাল সরবরাহ ব্যবস্থায় অসংখ্য বাজার এজেন্ট রয়েছে। বাজার মূল্যের ওপর গুদাম মালিকদের বা অটোরাইস মিলারদের উল্লেখযোগ্য আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়। ফলস্বরূপ ধানচাষিরা প্রায়শই সঠিক দাম পান না। কিন্তু ভোক্তারা অযৌক্তিকভাবে উচ্চমূল্যের সম্মুখীন হন, যার ফলে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়।

খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রসঙ্গে সিপিডি বলছে, বাংলাদেশে পূর্ববর্তী কর্তৃত্ববাদী সরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতির মাধ্যমে একটি অকার্যকর অর্থনীতি রেখে গেছে, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ঠিক করতে হবে। বেশ কিছু খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ শৃঙ্খলের বিশ্লেষণে মধ্যস্থতাকারীদের একটি জটিল নেটওয়ার্কের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। তবে দুঃখের বিষয় হলো- অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খলে চাঁদাবাজি, মজুতদারি বা অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের মতো অনিয়ম মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলো এখনও পর্যন্ত বাজারে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম কমাতে ব্যর্থ হয়েছে।

সংস্থাটি আরও বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার যদি প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ শৃঙ্খলে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে সাহসী এবং জরুরি পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে মূল্যস্ফীতির হার কমানো কঠিন হবে।

ঘোষিত সময়ের মধ্যেই নির্বাচন: ফাহমিদা খাতুন বলেন, জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া কোনো সরকার বেশি দিন থাকতে পারে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতিমধ্যে জানিয়েছে, আগামী ডিসেম্বর অথবা ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমরা চাই, সরকার ঘোষিত রোডম্যাপের মধ্যেই নির্বাচন হোক। যত দ্রুত সম্ভব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেতে হবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া অর্থনৈতিক সংস্কার সম্ভব নয়। ক্ষমতার পালাবদল হলেও অর্থনৈতিক গতিধারার উন্নতি নেই। 
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, খেলাপি ঋণ ব্যাংকের সম্পদের মান ও তারল্য পরিস্থিতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ২০০৯ থেকে খেলাপি ঋণের যে ঊর্ধ্বমুখী ধারা ছিল তা ক্রমবর্ধমান রয়েছে। সেপ্টেম্বর ২০২৪ অনুযায়ী মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা দেশের মোট অপরিশোধিত ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ। এতো বিপুল খেলাপি ঋণের কারণে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ কমে যাচ্ছে।

দেশের ব্যাংকিং খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে তাৎক্ষণিক, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সময়ে বাস্তবায়ন করার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর শক্তিশালীকরণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন রক্ষা, আইন ও বিচারিক পরিবেশ উন্নয়ন, সঠিক ও সময়মতো তথ্য নিশ্চিত করতে হবে।

বিশেষত বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন রক্ষার স্বার্থে এফআইডি বন্ধ করা জরুরি। এর পাশাপাশি প্রাক্তন গভর্নরদের জবাবদিহি, সাইবার হ্যাকিংয়ের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ, যা এরই মধ্যে ৮০ বার পিছিয়েছে। নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স ইস্যু বন্ধ করার মতো তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে হবে।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকার এমন সময়ে ভ্যাট বাড়াচ্ছে, যে সময়ে সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট। মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতি দ্বিগুণ। অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সুযোগ এসেছিল, প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো। কিন্তু সরকার সে পথে হাঁটেনি। তারা পরোক্ষ করের ওপর বেশি জোর দিচ্ছে।

দুষ্টচক্রে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত
সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক বলেন, জ্বালানি নিয়ে অনেক অনিয়ম হয়েছে। সরকারি অর্থ অপচয় হয়েছে। এজন্য আগের চুক্তি বাতিল করে ‘বিদ্যুৎ নেই, টাকা নেই’- নীতিতে যেতে হবে। পাশাপাশি গ্যাস-জ্বালানির নতুন উৎস বের করতে হবে। কূপ খননে জোরদার পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাংলাদেশের জ্বালানি খাত মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়েছে, যার জন্য মূলত পূর্ববর্তী সরকারের নীতিকাঠামো দায়ী। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এক ধরনের ঋণের দুষ্টচক্রে আটকে পড়েছে।

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status