দেশ বিদেশ
একটি সবুজ গ্রহ পথ দেখাচ্ছে ভারত
২৬ জানুয়ারি ২০২৫, রবিবার
জলবায়ু প্রতিশ্রুতি ও বিশ্বাসযোগ্যতা
মাথাপিছু ২ টন কার্বন নিঃসরণসহ ভারত জি২০ দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম কার্বন নিঃসরণকারী দেশ, এবং ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) ভারতকে একমাত্র জি২০ অর্থনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যা লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ করছে। ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ, যা বৈশ্বিক জনসংখ্যার প্রায় ১৮% নিয়ে গঠিত। এটি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি, যা ২০৩০ সালের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার পথে। তবুও মোট নিঃসরণে ভারতের অংশ মাত্র ৩.৪%।
ভারতের জলবায়ু প্রতিশ্রুতিসমূহ উচ্চাকাক্সক্ষী ও পরিমাপযোগ্য, যা অন্যদের জন্য অনুকরণীয় একটি মানদণ্ড তৈরি করেছে। ২০২১ সালে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত ইউএনএফসিসিসি সম্মেলনে পাঁচ দফা কর্মপরিকল্পনা বা পঞ্চামৃত ঘোষণা করেন। এগুলোর মাঝে ২০৭০ সালের মধ্যে নেট-জিরো নিঃসরণ অর্জনের প্রতিশ্রুতি, ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০০ গিগাওয়াট অ-জীবাশ্ম জ্বালানি সক্ষমতা স্থাপন ও একই বছরের মধ্যে ভারতের মোট জ্বালানি চাহিদার ৫০% নবায়নযোগ্য উৎস থেকে নিশ্চিত করার লক্ষ্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারত এই লক্ষ্যসমূহ অর্জনের পথে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। ২০০৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে, ভারত তার জিডিপি’র নির্গমন তীব্রতা ৩৬% কমিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন থেকে পৃথক করার ক্ষেত্রে একটি বিরল সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। ভারতে স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ৪৬% এরও বেশি অ-জীবাশ্ম জ্বালানি উৎস থেকে আসে, যা নবায়নযোগ্য জ্বালানি সক্ষমতা বৃহৎ জলবিদ্যুৎসহ ২০৩.২২ গিগাওয়াটে পৌঁছেছে। এখন ভারতের মোট ভূমির ২৫.১৭% জুড়ে বন ও বৃক্ষের আচ্ছাদন রয়েছে, সঙ্গে ২০০৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে আরও ২.২৯ বিলিয়ন টন বাড়তি কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সমপরিমাণ কার্বন সিঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
সফ্ট পাওয়ার ডিপ্লোম্যাসি: বৈশ্বিক জোট গঠন
ভারতের জলবায়ু নেতৃত্ব শুধু দেশীয় সাফল্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। দেশটি তার সফট্ পাওয়ার ব্যবহার করে জলবায়ুর স্থিতিস্থাপকতা, জ্বালানি রূপান্তর ও স্থায়িত্বের গুরুত্বপূর্ণ দিকসমূহের প্রতি নজর দিয়ে বৈশ্বিক সহযোগিতা গঠন ও নেতৃত্ব প্রদান করেছে। প্রায়শই আনুষ্ঠানিক ইউএনএফসিসিসি’র আলোচনার বাইরে কাজ করা এই উদ্যোগসমূহ সহযোগিতামূলক সমাধান প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে ভারতের প্রচেষ্টাকে দৃঢ় করে।
২০১৫ সালে ভারত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল সোলার অ্যালায়েন্স (আইএসএ) এই নেতৃত্বের উদাহরণ। প্রধানত গ্লোবাল সাউথ অঞ্চলের ১০৪টি সদস্য দেশ ও ১৬টি স্বাক্ষরকারী দেশকে একত্রিত করে, আইএসএ সৌর শক্তিকে টেকসই উন্নয়নের একটি মূল সমাধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানো ও প্রযুক্তির পরিবর্তনকে প্রাধান্য দেয়ার মাধ্যমে ভারত ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তরের ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা নিয়েছে। একইভাবে, ২০১৯ সালে শুরু হওয়া কোয়ালিশন ফর ডিজাস্টার রিজিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার (সিডিআরআই) অবকাঠামোর ক্ষেত্রে জলবায়ু ঝুঁকির প্রতি বাড়তে থাকা সংবেদনশীলতার ব্যাপারে দৃষ্টিপাত করে। ৪১টি সদস্য দেশ ও সাতটি সংস্থা নিয়ে এটি কার্যকরী সমাধানের মাধ্যমে স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি করে, যা এই বারংবার ও বিধ্বংসী জলবায়ু সৃষ্ট দুর্যোগের যুগে একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা।
২০২৩ সালে, জি২০ সভাপতিত্ব চলাকালে, ভারত বৈশ্বিকভাবে জৈব জ্বালানির গ্রহণযোগ্যতা ত্বরান্বিত করতে গ্লোবাল বায়োফুয়েলস অ্যালায়েন্স (জিবিএ) প্রতিষ্ঠা করে। ২৪টি সদস্য দেশ ও ১২টি আন্তর্জাতিক সংস্থা নিয়ে গঠিত জিবিএ এমন বিকল্প টেকসই জ্বালানির প্রচার করে, যা নিঃসরণ কমায় ও জ্বালানি নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে সহায়ক।
২০১৯ সালে সহ-প্রতিষ্ঠিত লিডারশিপ গ্রুপ ফর ইন্ডাস্ট্রি ট্রানজিশন (লিডআইটি) হলো আরেকটি উদ্যোগ, যা ভারী শিল্প খাতসমূহের কার্বন নির্গমন কমানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠানসহ এর ৩৭টি সদস্য ২০৫০ সালের মধ্যে ইস্পাত ও সিমেন্টের মতো শিল্পে নেট-জিরো নিঃসরণ অর্জনের জন্য একযোগে কাজ করে।
ভারতের মিশন লাইফ (লাইফস্টাইল ফর এনভায়রনমেন্ট) ব্যক্তিগত ও সম্প্রদায় উভয় পর্যায়ে আচরণগত পরিবর্তন ঘটানোর প্রতিশ্রুতি আরও জোরালোভাবে তুলে ধরে। টেকসই ব্যবহার ও উৎপাদন প্রক্রিয়াকে অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে ভারত শুধু নিঃসরণ মোকাবিলা করছে না, বরং পরিবেশগত তত্ত্বাবধানের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক মনোভাবের পরিবর্তনও ঘটাচ্ছে। ভারতের জি২০ সভাপতিত্ব চলাকালে ৩৯টি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সংস্থার একটি উদ্যোগ, রিসোর্স এফিশিয়েন্সি সার্কুলার ইকোনমি ইন্ডাস্ট্রি কোয়ালিশন- এর সূচনা হয়, যা সম্পদ নিষ্কাশন ও বর্জ্য হ্রাসের দিকে মনোনিবেশ করে। সার্কুলার অর্থনীতিকেন্দ্রিক এই প্রচেষ্টাসমূহের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ উদ্যোগ যেমন গ্রিন ক্রেডিট প্রোগ্রাম, রাইট-টু-রিপেয়ার উদ্যোগ ও আপডেটেড ইকো-মার্ক বিধিমালা যুক্ত হয়েছে।
গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্বের একটি পরিকল্পনা
ভারত অন্যান্য দেশগুলোকে অভিন্ন লক্ষ্যসমূহকে ঘিরে একত্রিত করে বাস্তব বিশ্বের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা করার জন্য কার্যকরী কাঠামো প্রদান করে। অন্তর্ভুক্তিমূলক জোট গঠন করে, ভারত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বৈশ্বিক জলবায়ু সংলাপে সমান অংশীদার হিসেবে অংশগ্রহণ করার সক্ষমতা প্রদান করে।
যদিও গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো বিশ্বব্যাপী নিঃসরণে সামান্য অবদান রেখেও জলবায়ু প্রভাবের ভার বহন করছে, ভারতের প্রচেষ্টা এটিও প্রদর্শন করে যে, জলবায়ু বিষয়ক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব ধন-সম্পত্তির দ্বারা নির্ধারিত হয় না, বরং এটি দূরদৃষ্টি ও সংকল্প কর্তৃক নির্ধারিত হয়।
এমন এক পৃথিবীতে, যেখানে বহুপাক্ষিকতার ওপর আস্থা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, সেখানে নানা অংশীজনকে একত্রিত করার ব্যাপারে ভারতের সক্ষমতা একটি সহযোগিতামূলক, ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে আদর্শ উপস্থাপন করে। বৈশ্বিক জলবায়ু কার্যক্রমের নতুন অধ্যায়ের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারত পথ দেখাচ্ছে। ভারত শুধু বৈশ্বিক জলবায়ু সংলাপের অংশগ্রহণকারীই নয়, ভারত এর পথ চলার গতি নির্ধারণ করছে। এটি হলো অনুপ্রেরণার মাধ্যমে নেতৃত্ব।
* রাষ্ট্রদূত মঞ্জীব সিংহ পুরী (ইইউ-তে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত এবং ইউএনএফসিসিসি-তে প্রধান আলোচক; বিশিষ্ট ফেলো, দ্য এনার্জি অ্যান্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট, নয়াদিল্লি)
* শৈলি কেদিয়া (সিনিয়র ফেলো ও সহযোগী পরিচালক, দ্য এনার্জি অ্যান্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট, নয়াদিল্লি)