মত-মতান্তর
সাংবাদিকতা নিয়ে মতিউর রহমান চৌধুরীর ভাবনার প্রাসঙ্গিকতা
ড. মাহফুজ পারভেজ
(৪ সপ্তাহ আগে) ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, শনিবার, ১:২০ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:১১ পূর্বাহ্ন

লেখক
জীবনব্যাপী লব্ধ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নির্মোহ বিশ্লেষণে সমকালীন বাংলাদেশের সাংবাদিকতা নিয়ে চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেছেন এই পেশার বর্ষীয়ান ব্যক্তিত্ব মতিউর রহমান চৌধুরী। সাংবাদিকতার ‘চ্যালেঞ্জ’, ‘আস্থা হারানো’ ও ‘অস্তিত্বের সংকট’ নিয়ে সাহসিক উচ্চারণ করেছেন সম্পাদক-সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী তাঁর ‘কেন সাংবাদিকতা এখন অস্তিত্ব সংকটে’ (মানবজমিন, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫) শিরোনামের বহুল আলোচিত ও চর্চিত লেখায়, যার প্রতিক্রিয়া হয়েছে ব্যাপক ও গভীর তাত্ত্বিক পরিসরে (ড. সিরাজুল আই. ভূঁইয়া, মতিউর রহমান চৌধুরীর ভাবনার প্রতিক্রিয়া: কেন সাংবাদিকতা এখন অস্তিত্ব সংকটে–একটি গ্রামশিয়ান দৃষ্টিকোণ, মানবজমিন, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫)।
মূল লেখার পর্যালোচনা ও প্রাসঙ্গিকতার বিষয়ে যাওয়ার আগে মতিউর রহমান চৌধুরীর ক্ষেত্রে ‘সম্পাদক-সাংবাদিক’ আখ্যা দেয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করা দরকার। কারণ, বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় বিরাজমান নানামুখী সংকট, সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের মতোই সাংবাদিকতায় জড়িতদের নিয়ে প্রশ্ন কম নেই। এখানে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে বিন্দুমাত্র সংশ্রব ও অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক যোগাযোগ ও কালো টাকার জোরে সম্পাদক হওয়ার নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত রয়েছে। সাংবাদিকতার নামে দলীয় পাণ্ডা হয়েছেন অনেকেই। সাংবাদিক পরিচয়কে ইউনিয়নবাজি ও তদবির করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রকৃত সাংবাদিক ও নামধারী সাংবাদিকের স্পষ্ট পার্থক্য চিহ্নিত হয়নি। এতে পেশাদার সাংবাদিকতা কলঙ্কিত হয়েছে এবং প্রকৃত সাংবাদিকগণ বিব্রত হয়েছেন। কতিপয়ের দুষ্কর্মের দায় বিশুদ্ধ সাংবাদিকতা ও প্রকৃত সাংবাদিকদের কষ্ট দিয়েছে।
পেশার বাইরে ও ভেতরের লোকজনের কাছে এসব সমস্যা বা আপদের কথা অজানা ছিল না। অনেক সম্পাদক, সাংবাদিক থাকার পরেও সেসব নিয়ে প্রতিবাদ বা আত্মসমালোচনা খুব একটা চোখে পড়েনি। এর কারণ দুটি-
১) পরিবেশ-পরিস্থিতি এমন ছিল যে, প্রতিবাদ করা সম্ভব ছিল না। গণতন্ত্র ও সুশাসনের অভাবের কারণে মুক্ত সাংবাদিকতা ছিল রুদ্ধ। ক্ষমতাসীনদের মতো ক্ষমতার কাছাকাছি অবস্থানকারী পেশাজীবী-সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্য ছিল চরম পর্যায়ে। ফলে অনেকেই মুখ বুজে ছিলেন।
২) অনেক সম্পাদক ও সাংবাদিক থাকলেও সর্বসাম্প্রতিককালে ‘সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব’ তৈরি হয়েছেন কমই। যারা মহীরুহের মতো সামনে এসে লেখা ও কর্তব্যকর্মের মাধ্যমে প্রতিবাদ ও আত্মসমালোচনার শাণিত প্রচেষ্টায় পেশার মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করে অবক্ষয় ও আস্থাহীনতাকে ঠেকাতে পারতেন। অতীতে মানিক মিয়া, আবদুস সালাম, জহুর হোসেন চৌধুরী সাংবাদিক বা সম্পাদক থেকে যে দ্রোহ ও আপোসহীনতার পথে নিজেদেরকে ‘সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব’-এর ঐতিহাসিক মর্যাদায় উত্তীর্ণ করেছিলেন, হাল আমলে তেমন ব্যক্তিত্ব মুষ্টিমেয়। ফলে সাংবাদিকতার সংকটের বিরুদ্ধে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দাঁড়িয়েছেন খুব কম জনই।
মতিউর রহমান চৌধুরী বার বার দাঁড়িয়েছেন, এটা তাঁর সমালোচকরাও স্বীকার করবেন। ‘সাদাকে সাদা বলার’ বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করতে গিয়ে তিনি একাধিক্রমে এরশাদ, খালেদা জিয়া ও হাসিনা শাসনামলে নিগৃহীত হয়েছেন। তারও আগে, স্বাধীনতা-পরবর্তীতে সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ করা হলেও তিনি সুযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রবাসী হওয়ার বা পেশা পরিবর্তনের কথা ভাবেননি। বেকার সাংবাদিক হয়ে ক্রান্তিকাল পাড়ি দিয়ে তিনি সাংবাদিকতার সুদিন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন।

জুলাই-২৪ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর সংগ্রাম ও সংকল্পের ধারাবাহিকতায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এখন নানা চ্যালেঞ্জের মুখে। জনমানুষ আস্থা হারিয়েছে অনেক আগেই। এখন বলতে গেলে অস্তিত্ব সংকটে।’ তাঁর বর্তমান লেখা এবং অতীতের অনেকগুলো লেখার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ ও প্রফেশনাল সাংবাদিকতার ‘অসমাপ্ত স্বপ্নের’ ছায়াপাত ঘটেছে। গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী-সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সাংবাদিকতাকে ঘিরে অসমাপ্ত স্বপ্নের সফল সমাপ্তি প্রয়োজন। আর এ কারণেই মতিউর রহমান চৌধুরীর বক্তব্য খুবই জরুরি আর প্রাসঙ্গিক।
তথ্যনিষ্ঠতার প্রয়োজনে উল্লেখ্য করা প্রয়োজন, চৌধুরীর সমান্তরালে সাংবাদিকতার উত্তরণ ও পেশাদারিত্ব নিশ্চিতের জন্য লিখেছেন তাঁরই এককালের সহকর্মী আলমগীর হোসেন (পেশাদারিত্বের আবর্তে মুক্ত গণমাধ্যমের আকাঙ্ক্ষা, সমকাল, ৪ মে ২০২৪)। বলেছেন, ‘আমাদের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা নিয়ে অনুচ্চারিত কিছু প্রসঙ্গের অবতারণা করাও প্রয়োজন, তা না হলে প্রকৃত সংকট দূর করতে ব্যর্থ হবো আমরা।’
আরও কেউ কেউ হয়ত থাকতে পারেন, যারা সাংবাদিকতার উন্নয়ন ও অবক্ষয় রোধে লেখালেখি করছেন, যা আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। আশা করা যায়, তারাও এক্ষেত্রে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন। তবে, চৌধুরী ও হোসেনের বক্তব্যগুলো দীর্ঘকাল ধরে অনুসরণ করে কিছু প্রবণতা আমার সামনে স্পষ্ট হয়েছে।
যার মধ্যে নিহিত রয়েছে-
১) পেশাদারিত্ব পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় দলীয় বৃত্ত থেকে সাংবাদিকতাকে মুক্ত করার অভীপ্সা এবং নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা নিশ্চিত করার আকুতি;
২) আস্থা হারিয়ে অস্তিত্বের সংকটে নিপতিত সাংবাদিকতার মুক্তির বীজমন্ত্র খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা;
এবং ৩) বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, বহুত্ববাদী সুশাসন এবং বাক-ব্যক্তি ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখার সংগ্রামে সাংবাদিকতার যথাযথ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের পরিসর তৈরি করার আকাঙ্ক্ষা। যা তাদেরকে দলীয় বা গোত্রবদ্ধ লেবেলের বাইরে কেবলই সাংবাদিক-সম্পাদক পরিচয়ে ঋদ্ধ করেছে এবং বাংলাদেশে প্রকৃত সাংবাদিক-ব্যক্তিত্বে শূন্যতা পূরণের পথে এগিয়ে দিয়েছে।
চেতনার শুদ্ধতম আগুনে জারিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের সারথি চৌধুরী ও হোসেন সাংবাদিকতা শুরু করেন সত্তর দশকে। দুজনেই মুক্তিযোদ্ধা। সাংবাদিকতা করেছেন সংবাদ, ইত্তেফাকে, যা বাংলাদেশে গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা, পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠার প্লাটফরম ছিল। সেসব পত্রিকা স্বকীয় ঐতিহ্য ধরে রাখতে না পারলেও চৌধুরী ও হোসেন সাংবাদিকতার ধ্রুপদী কাঠামোর বাইরে পা ফেলেননি। মতিউর রহমান চৌধুরী অনেকগুলো পত্রিকা সৃজন করেছেন এবং অবশেষে মানবজমিনের মতো একটি ট্যাবলয়েড পত্রিকাকে মর্যাদা ও পাঠকপ্রিয়তার স্থানে নিয়ে এসেছেন। বিশ্বব্যাপী ট্যাবলয়েড পত্রিকা সাধারণত চটুল-গুঞ্জনকে প্রাধান্য দেওয়া সেক্স ও ভায়োলেন্সের কাগজ হিসেবে পরিচিত হলেও চৌধুরী বাংলাদেশে ট্যাবলয়েডের গতানুগতিক সংজ্ঞা ও অবয়ব বদলে দিয়ে মানবজমিনকে চিন্তা ও নীতি পরিগঠনের অগ্রণী মুখপত্রে পরিণত করেছেন। হোসেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় অনলাইন মিডিয়ার জন্ম দিয়ে মানুষকে প্রযুক্তি ও সংবাদের সমান্তরালে আবাহনের পথ উন্মোচিত করেছেন। উভয়েই দীক্ষাগুরু হয়ে শত শত তরুণ সাংবাদিকের জন্ম দিয়েছেন, ক্লাব বা ইউনিয়নের ভোটার তৈরি করেননি। বাংলাদেশের পেশাগত সাংবাদিকতা এই সত্য বিস্মৃত হতে পারবে না।
সাদাকে সাদা বলতে গিয়ে এবং সত্যের সপক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে নির্ভীক সাংবাদিকতার ঐতিহ্যে মতিউর রহমান চৌধুরী সর্বদাই এবং স্বেচ্ছায়, অবস্থান করেছেন সরকারি পদ, পদবি ও এস্টাবলিস্টমেন্টের বাইরে। আঘাত সয়েছেন ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে। প্রতিপক্ষের অসঙ্গতি নিয়ে যেমন কথা বলেছেন, সোচ্চার হয়েছেন নিজের ক্ষেত্র তথা সাংবাদিকতার সংকট ও সমস্যা নিয়ে। সাংবাদিকতা নিয়ে জীবনব্যাপী সাধনার জন্য তিনি রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা পাবেন না পক্ষহীন/নিরপেক্ষ থাকার কারণে। এদেশে পুরস্কৃত হওয়া সহজ পন্থা হলো- কোনো না কোনো দলের পক্ষে থেকে লেজুড় হওয়া, অবিরাম তৈলমর্দন করা এবং কাজ না করে বড় বড় কথা বলা। এই তথাকথিত গুণগুলোর একটিও তাঁর নেই। বরং তিনি হলেন: ১) ক্ষমতা ও আধিপত্যকে নিত্য প্রশ্ন ও সমালোচনা করা সিভিক ভয়েস। ২) সত্যান্বেষণে আকণ্ঠ নিমজ্জিত সার্বক্ষণিক সাংবাদিক (প্রবীণ বয়সেও হারিছ চৌধুরীকে শনাক্তকরণে যে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার উদাহরণ তিনি রেখেছেন, তা নজিরবিহীন)। ৩) দায়িত্বশীল সম্পাদক এবং ৪) সামগ্রিক পরিচয়ে একজন সাংবাদিক-ব্যক্তিত্ব। অতএব, তিনি একুশে বা স্বাধীনতার পুরস্কার পাবেন কিনা সন্দেহ এবং পেলেও গ্রহণ করবেন কিনা, আমি নিশ্চিত নই।
নোবেল থেকে শুরু করে পাশের ভারতেও পদ্ম চিহ্নিত রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাননি বহু কৃতবিদ ব্যক্তিত্ব এবং পেলেও গ্রহণ না করে প্রত্যাখ্যান করেছেন বহুজন। এতে তাদের সম্মান আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। পুরস্কার পাওয়ার চেয়ে প্রত্যাখ্যান করাই যখন সম্মানের বিষয় তখন সেসব তথাকথিত সম্মান ফিরিয়ে দেয়াই শ্রেয়। আর তা যদি হয় ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচারের পক্ষে দেয়া তকমা, তা হলে সেটা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। কিন্তু জনগণের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা মিশে আছে যে রাষ্ট্রীয় ও নাগরিক পুরস্কারে, তা মাথায় তুলে রাখার বিষয়। জাতীয় সংকটে ও পেশাগত অস্তিত্বের চ্যালেঞ্জে সাহসিক পদক্ষেপ ও উচ্চারণের মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে তেমন সম্মান ও ভালোবাসা তিনি বার বার পেয়েছেন। এটিই সবচেয়ে বড় সম্মাননা। বাংলাদেশকে নিয়ে, গণতন্ত্র ও স্বাধীন সাংবাদিকতা নিয়ে সারা জীবন তিনি যে স্বপ্ন দেখেছেন, তা সফল হলেই তিনি তাঁর স্বভাব সুলভ হাসিতে খুশির ঝিলিক ছড়িয়ে দেবেন সবার মধ্যে।
লেখক: প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।
পাঠকের মতামত
আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মনে হয় আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আমাদের কথা কেউ ভাবে না। ভ্যাট- ট্যাক্স বসিয়ে এই সরকার আসলে কি করতে চাচ্ছে তা কেউ পরিস্কার করে বলছে না।