ঢাকা, ২০ জানুয়ারি ২০২৫, সোমবার, ৬ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯ রজব ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

ইকোনমিস্টের রিপোর্ট

কূটনীতি হলো ক্রিকেটের মতো

মানবজমিন ডেস্ক
১০ জানুয়ারি ২০২৫, শুক্রবার

কূটনীতি হলো ক্রিকেটের মতো। এতে অনেকজন খেলোয়াড় থাকেন। মুহূর্তে মুহূর্তে পরিস্থিতি বদলায়। থাকে তীব্র প্রতিযোগিতা। সবসময় অন্যপক্ষকে নিয়ে ভাবতে হয়। নভেম্বরে এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন কূটনীতি হলো ক্রিকেটের মতো। রূপক অর্থে হয়তো তিনি এ কথা বলেছেন। কিন্তু বাস্তব অর্থে বা আক্ষরিক অর্থে ভারতের কূটনৈতিক নীতির স্থানটি নিয়ে নিচ্ছে ক্রিকেট। তাদের সবচেয়ে বড় আবেগের জায়গা একটি সক্রিয় কূটনৈতিক হাতিয়ার, বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে। চ্যাম্পিয়নস ট্রফি নিয়ে গত এক মাস ধরে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে অনেক কথাকাটাকাটি হয়েছে। চ্যাম্পিয়নস ট্রফি হলো একটি আন্তর্জাতিক বড় আকারের টুর্নামেন্ট। এ বছর আগামী ফেব্রুয়ারিতে এর আয়োজক পাকিস্তান। কিন্তু এই টুর্নামেন্টে নিজেদের দল পাকিস্তানে পাঠাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ভারত সরকার। এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েছে পাকিস্তান। ফলে প্রতিবেশীকে উত্তেজিত করতে এই ট্রফিকে নিজেদের দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্যুর করানোর কথা বলেছে পাকিস্তান। এর মধ্যে আছে কাশ্মীরের বিভিন্ন অংশ। এতে ভারত ক্ষুব্ধ হয়েছে। কারণ, ভারতের দৃষ্টিতে কাশ্মীরকে অবৈধভাবে দখল করে আছে পাকিস্তান। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টির পর এতে হস্তক্ষেপ করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)। ফলে পাকিস্তান তার পূর্ব ঘোষণা থেকে সরে আসে। ক্রিকেটের বৈশ্বিক পরিচালনা পরিষদ আইসিসি এখন এই টুর্নামেন্ট হাইব্রিড মডেলে পরিচালনার পরিকল্পনা করছে। ফলে অন্য টিমগুলো পাকিস্তানের মাটিতে খেললেও ভারত খেলবে নিরপেক্ষ কোনো ভেন্যুতে। ভারতের এই কঠোর অবস্থান কমই বিস্ময়কর। কারণ, ২০০৮ সাল থেকে ভারতীয় টিম পাকিস্তান সফর প্রত্যাখ্যান করে আসছে। কারণ, ওই বছর মুম্বইয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হয়। ভারতীয় কর্মকর্তাদের বিশ্বাস এতে পাকিস্তানের হাত আছে। অন্যদিকে এ ঘটনার পর থেকে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগে (আইপিএল) পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়। এতে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের কতো ব্যাপক অবনতি ঘটেছে তা প্রতিফলিত হয়। এ খবর দিয়েছে অনলাইন দ্য ইকোনমিস্ট। 

অন্যদিকে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। তখন থেকেই কাশ্মীর ইস্যুতে অধিক পেশিশক্তি প্রদর্শন করতে থাকে তারা। এতে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও তিক্ত হতে থাকে। ওই অঞ্চলে বেশ কিছু সন্ত্রাসী হামলার পর দুই দেশের সম্পর্কের আরও অবনতি হয়। ভারতের অভিযোগ, এসব হামলার মূল হোতা পাকিস্তান। এরপর ২০১৯ সালে দুই দেশের সম্পর্ক ভেস্তে যায়। ওই বছর জম্মু-কাশ্মীরের কয়েক দশকের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বা স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে দেয় ভারত। একেবারে একতরফাভাবে ওই বছরের ১৫ই আগস্ট এই কাজ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শাসিত পার্লামেন্ট। ফলে ভারতশাসিত কাশ্মীরের ওপর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বৃহত্তর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে। এ কারণে ভয়াবহভাবে ক্ষুব্ধ হয় পাকিস্তান। তখন থেকে বন্ধ হয়ে যায় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য। ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে, তারা এই প্রতিবেশীর কাছ থেকে কিছুই আমদানি করেনি। তবে রপ্তানি করেছে ২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার, যা তার মোট রপ্তানির শতকরা ০.১ ভাগ। 

একসময় দুই দেশের মধ্যে পুনর্জাগরণ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতো ক্রিকেট। ১৯৮৭ সালে এবং ১৯৯৬ সালে ভারত ও পাকিস্তানের কর্মকর্তারা বিশ্বকাপ ক্রিকেট একসঙ্গে যৌথভাবে আয়োজনে কাজ করেন। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তান দল ভারত সফর করে। ২০০৪ সালে ভারত এর প্রতিদান দেয়। অর্থাৎ তারা পাকিস্তান সফরে যায়। এই ট্যুরের সময় মাঠের বাইরে দ্বিপক্ষীয় সামিটও হয়। স্টেডিয়ামে দুই দেশের ভক্তরা বিরোধীদেরকে উষ্ণতায় গ্রহণ করে নেন। ওই সময় কেউ কেউ আশা করতে থাকেন যে, সফল ‘পিং-পং কূটনীতির’ পরিবর্তে আসতে পারে ‘ক্রিকেট কূটনীতি’। যেমনটি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে। দুই দেশের মধ্যে ধারাবাহিক টেবিল টেনিস গেম অচল সম্পর্ককে ১৯৭০-এর দশকে জোড়া লাগিয়েছিল। 

কিন্তু তা এখন দৃশ্যত অচিন্তনীয়। ভারতে অনেক বেশি জাতীয়তাবাদ এবং ক্রিকেট অধিক পরিমাণে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিজেপি’র অটল বিহারি বাজপেয়ী। তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে জড়িত হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের প্রতিবাদ বিক্ষোভকে বানচাল করে দিয়েছিলেন। তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অধিক পরিমাণ যুদ্ধং দেহী অবস্থান নিয়েছেন। তার দল ভারতের ক্রিকেটের ওপর অধিক পরিমাণ ক্ষমতা উপভোগ করছে। গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্টেডিয়াম হলো নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম। তারা এবং ভারতের বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট (বিসিসিআই)-এর বেশ কিছু সদস্যের যোগসূত্র রয়েছে বিজেপি’র সঙ্গে। নভেম্বর পর্যন্ত বিসিসিআই পরিচালনা করেছেন জয় শাহ। তিনি ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী মোদির ডানহাত বলে পরিচিত অমিত শাহের ছেলে। 

সম্প্রতি আইসিসিতে খেলা আয়োজনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জয় শাহ’কে। ভারতীয় নন এমন বহু ক্রিকেট ভক্তের আতঙ্ক হলো যে, নতুন দায়িত্ব ব্যবহার করে ভারতের স্বার্থকে আরও বেশি প্রাধান্য দেবেন জয় শাহ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চ্যাম্পিয়নস ট্রফিকে ‘হাইব্রিড মডেলে’ আয়োজন করা হবে। তার অধীনে বিসিসিআই পাকিস্তানের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব দেখাবে। তাতে প্রতিফলিত হবে ভারত সরকারের অবস্থান। বিপরীতে, ভারত সরকারের মতো, বিসিসিআই আফগানিস্তানের প্রতি অধিক সদয় হতে পারে। তারা আফগানিস্তানে খেলার উন্নয়নে অর্থায়ন করেছে। আইপিএলে আফগানিস্তানের খেলোয়াড়দেরকে খেলার সুযোগ দেয়া হয়েছে। 
এই ধারায় পলিসি এগিয়ে গেলে প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত সম্পর্ক কি পর্যায়ে নিয়ে যাবে তা স্পষ্ট নয়। সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে হলে তাদেরকে দ্বিপক্ষীয় সংলাপে বসতে হবে। সীমান্তে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। কিন্তু এখন অবধি তারা সেটা করেনি। কিন্তু বিদেশি নীতির বাইরেও ভারতীয় ক্রিকেটের অবস্থান হতে পারে অভ্যন্তরীণ নীতির ফলে অধিক পরিমাণে প্রভাবিত। বিজেপি যে আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করেছে তাতে বহু ভারতীয় উদ্বুদ্ধ। পিউ রিসার্সের এক জরিপ অনুযায়ী, ২০২৩ সালে শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ ভারতীয় বলেছেন- পাকিস্তানের বিষয়ে প্রতিকূল মনোভাব পোষণ করেন।

 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status