শরীর ও মন
সারাক্ষণ পায়ে টান ধরা সিন্ড্রোম ও প্রতিকার
ডা. মো. বখতিয়ার
১২ ডিসেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবারএটি একটি স্নায়ুবিক রোগ যার কারণে আপনার পা নাড়ানোর প্রবল ইচ্ছে হয়। চিকিৎসকরা এটিকে ঘুম সম্পর্কিত রোগ বলে মনে করেন কারণ আপনি যখন বিশ্রাম করেন, তখনই এটি ঘটে বা আরও খারাপের দিকে যায়।
এই রোগের উপসর্গগুলো যখন আপনি বসে থাকেন, বিশ্রাম করেন বা ঘুমোন, তখন সাধারণত দেখা যায়। আপনি মূলত রাতের বেলায় এটি প্রত্যক্ষ করবেন। অবিরাম পায়ে টান ধরার সিন্ড্রোম ঘুমের জন্য গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
প্রতিকার:
স্বাস্থ্যকর অভ্যাস: ঘুমোতে যাবার অনেক ঘণ্টা আগেই মদ, ক্যাফেইন এবং নিকোটিন খাওয়া আপনার এড়িয়ে যাওয়া উচিত।
ওষুধের পুনরায় পর্যালোচনা: কিছু ওষুধ যেমন অ্যান্টিহিস্থামিন, বমিবমিভাব-বিরোধী ওষুধ, অ্যান্টি সাইকোটিক ওষুধ, লিথিয়ামের ব্যবহার অথবা ট্রাইসাইক্লিক অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট আরএলএসের উপসর্গগুলোকে বাড়িয়ে দিতে পারে। আপনি কী ওষুধ খাচ্ছেন সে বিষয়ে আপনার ডাক্তারের সচেতন হওয়া উচিত। যদি আপনি লক্ষ্য করেন যে আরএলএস এর উপসর্গগুলো ক্রমশ আরও খারাপের দিকে যেতে থাকে, তবে তৎক্ষণাৎ ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
অন্তর্নিহিত কারণের চিকিৎসা: শেষ ধাপের পায়ুর রোগ, ডায়াবেটিসের কারণে স্নায়ুর ক্ষতি এবং অ্যানিমিয়ার কারণে লোহার ঘাটতির কারণে অবিরাম পায়ে টান ধরার সিনড্রোম হতে পারে। এই রোগগুলোর চিকিৎসা করলে আরএলএসের চিকিৎসাতেও উন্নতি হতে পারে। আপনার ডাক্তার আপনার স্বাস্থ্য সম্পর্কে আপনার সঙ্গে আলোচনা করবেন এবং আপনাকে সবচেয়ে কার্যকরী চিকিৎসার পরিকল্পনাটি দেবেন। তারা আপনাকে লোহার মাত্রা পরীক্ষা করা এবং বৃক্কের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য রক্ত পরীক্ষা করতে বলবেন। আরএলএস’র সঙ্গে ভিটামিন ডি’র অভাব জড়িত। আপনার ডাক্তার এই উপসর্গগুলো থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আপনাকে কিছু ভিটামিন ডি-সমৃদ্ধ বিকল্প খাদ্য দেবেন।
স্বাস্থ্যকর ঘুমের অভ্যাস: আপনার একটি নিয়মিত ঘুমের পরিকল্পনা মেনে চলা উচিত এবং দিনের বেলা ঘুমোনো উচিত না। আপনার দেহ ও মনকে শান্ত করার জন্য ঘুমোনোর জায়গাটি অন্ধকার ও শান্ত রাখা উচিত। শোবার ঘরে টিভি ও ফোনের মতো মন বিক্ষিপ্ত করার বস্তু যত সম্ভব কম রাখা উচিত। এই জীবনশৈলীর পরিবর্তনগুলো করলে অবিরাম পায়ে টান ধরার রোগটির কিছু প্রভাব থেকে আপনি আরাম পেতে পারেন।
ব্যায়াম ও যোগব্যয়াম: প্রতিদিন ব্যায়াম করুন। দিনের শুরু এবং শেষে নিজের পা টানটান করলে ও মালিশ করলে তা আপনার জন্য উপযোগী হতে পারে। অ্যারোবিক ব্যায়াম এবং নিম্নাংশের রোধ বৃদ্ধিকারী ব্যায়াম যেমন স্কোয়াট, লাঞ্জেস ইত্যাদি করলে আরএলএসে উপসর্গগুলো কমে যেতে পারে।
যোগব্যায়াম আরএলএসের উপসর্গের একটি অর্থাৎ মন খারাপ দূর করতে সাহায্য করে। এটা চাপের পরিমাণ কম করে, যাতে ঘুমে সাহায্য হয়। মালিশ করলে রক্ত সংবহন ভালো হয় এবং শরীর থেকে ডোপামিন ক্ষরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। যেসব রোগীদের অবিরাম পায়ে টান ধরার রোগ আছে, এটি তাদের জন্য নিশ্চিত উপকারী বলে প্রমাণিত হয়েছে।
ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করতে হবে: আপনার ডাক্তার রোগনির্ণয়ের ফলে আপনাকে সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত ওষুধ দেবেন। সবচেয়ে বেশি পরিচিত ওষুধগুলো হলো নিম্নলিখিত:
*ডোপামিন অ্যাগোনিস্ট, প্রামিপেক্সল, রোটিগোটিন এবং রোপিনিরোলের মতো ওষুধগুলো মস্তিষ্কের জন্য নিউরোট্রান্সমিটার ডোপামিনের ক্ষরণকে বৃদ্ধি করে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো হলো দিনের বেলায় ঝিমুনি, গা বমি বমি করা এবং হালকা মাথাব্যথা।
*ডোপামিনার্জেনিক এজেন্ট: এই জাতীয় ওষুধ মস্তিষ্কে ডোপামিনের মাত্রা বৃদ্ধি করে। এটি পায়ের অস্বস্তিজনক শিরশিরানিকে কমানোয় সাহায্য করে। ওষুধের ওভারডোজের কারণে উপসর্গগুলো আরও খারাপ হতে পারে। গা গোলানো, বমি এবং হ্যালুসিনেশনের মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে।
*বেঞ্জোডিয়াজেপিনেস: এই ধরনের ওষুধ উপশমকারী। এগুলো ঘুমের চক্র ভালো করার চেষ্টা করে।
*আফিম জাতীয়: এই ধরনের ওষুধগুলো ব্যথার উপশমকারী। যদি অন্য কোনো ওষুধ কাজ না করে তবেই আপনার ডাক্তার এটি দেবেন।
*অ্যান্টিকনভুলস্যান্টস: এই ওষুধগুলো আরএলএস উপসর্গগুলোকে কমাতে সাহায্য করে এবং স্নায়ুর ক্ষতিগ্রস্ত হবার কারণে অত্যন্ত ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
পা মোড়ানো: এই পদ্ধতিটি প্রতিরোধী হিসেবে পরিচিত। এতে আপনার পায়ের তালুতে কিছু নির্দিষ্ট অংশে চাপ অনুভূত হয়। এই শিরশিরানি মস্তিষ্কে একটি বার্তা পাঠায় যে ক্ষতিগ্রস্ত পেশিগুলোকে শিথিল করতে হবে। এই পদ্ধতিটি আরএলএসের উপসর্গগুলোর সমাধান করে। আপনি যদি চান তবে আপনার ডাক্তার আপনাকে পা মোড়ার প্রতিরোধী ওষুধ দেবেন।
নিউম্যাটিক কম্প্রেশন: এই চিকিৎসাটি হাসপাতালের মধ্যেই করতে হবে। এই পদ্ধতিতে একটি হাতার ব্যবহার করতে হবে। আক্রান্ত অঙ্গের ওপর দিয়ে এটিকে রাখা হয়। প্রথমে এটা স্ফীত হয়, তারপরে সংকুচিত হয়ে যায়। আপনার পা-কে ধীরে ধীরে ভাঁজ করুন। রক্ত সংবহনকে ভালো করার জন্য নিউম্যাটিক কম্প্রেশনের যন্ত্রটিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। এটি যেকোনো প্রকার তঞ্চনেও বাধা দেয়। নিউম্যাটিক কম্প্রেশন আরএলএসের উপসর্গ কমাতেও সাহায্য করে।
বৈদ্যুতিক উদ্দীপনা: আপনার পা এবং গোড়ালিকে উদ্দীপ্ত করতে একটি ভাইব্রেশন প্যাড ব্যবহার করা হয়। কিছু কিছু সময় আরএলএসের উপসর্গ থেকে আরাম পেতে বৈদ্যুতিক উদ্দীপনা ব্যবহার করা হয়। বিশ্রাম নেয়া বা ঘুমোনোর সময় আপনি এই প্যাডের ব্যবহার করতে পারেন। এটি বিপরীত কম্পন প্রদান করে। তারা তাদের কম্পনের তীব্রতা বাড়িয়ে রোগের উপসর্গজনিত শিরশিরানিকে মৃদ করে দেয়। তাই আপনার দুঃখদায়ক উপসর্গগুলোর বদলে আপনি ও কম্পনটি অনুভব করবেন। এই পদ্ধতিটি ঘুম ভালো করার জন্য সফল হিসেবে প্রমাণিত।
সারাক্ষণ পায়ে টান ধরা জীবনভর থাকতে পারে। জোর করে নিজের চলাফেরাকে দমন করতে চেষ্টা করবেন না। এর ফলে উপসর্গ আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।
আপনার ডাক্তার আপনাকে সঠিক চিকিৎসার পরিকল্পনা ছকে দেবে। সঠিক চিকিৎসা পেতে গেলে আপনাকে হয়তো অনেকগুলো ওষুধ খেতে হতে পারে। অবিরাম পায়ে টানের সিন্ড্রোম থাকলে তাতে আপনার প্রচণ্ড অস্বস্তি হবে এবং ঘুমের সমস্যা হবে। তাই এর চিকিৎসা ফেলে রাখা উচিত নয়।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক ও গবেষক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক
খাজা বদরুদজোদা মডার্ন হাসপাতাল, সফিপুর, কালিয়াকৈর, গাজীপুর।