ঢাকা, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, শনিবার, ১১ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৪ রজব ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

বাবাকে নিয়ে হাজারো প্রশ্ন ছোট্ট শিশুটির

ফাহিমা আক্তার সুমি
১১ ডিসেম্বর ২০২৪, বুধবারmzamin

কোথায় যাবো, এই অবুঝ শিশুদের কি বলে সান্ত্বনা দিবো, কি হবে আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ? কি দোষ ছিল ওদের বাবার? আমার ছোট্ট দুই সন্তান বাবাহারা হয়ে গেল। বড় মেয়েটি বাবাকে ছাড়া খেতে চায় না। রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে বাবার জন্য। সবসময় তাদের বাবাকে খুঁজতে থাকে। বাবাকে নিয়ে হাজার প্রশ্ন করে। বারো মাসের ছোট্ট মেয়েটি সবসময় বাবা বাবা করে। কি দোষ ছিল ওদের বাবার? এভাবে কথাগুলো বলছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত ৩১ বছর বয়সী মেহেদী হাসানের স্ত্রী। তিনি গত ১৮ই জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। ছররা গুলিতে তার চোখ, মুখ, মাথাসহ পুরো শরীর ঝাঁজরা হয়ে যায়। পরে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। মেহেদী পেশায় একজন গণমাধ্যমকর্মী ছিলেন।

মেহেদীর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম পপি মানবজমিনকে বলেন, দুই সন্তানকে নিয়ে কেরানীগঞ্জের মান্দাইলে একটি ভাড়া বাসায় থাকতাম। সেই বাসা বর্তমানে ছেড়ে দিয়ে আমার বাবার কাছে থাকি। সন্তানদের নিয়ে অনেক চিন্তায় আছি। আমার বাবা অসুস্থ। ইচ্ছা ছিল বড় মেয়েকে জানুয়ারিতে স্কুলে ভর্তি করবো। আর ছোট মেয়ের বয়স ১২ মাস চলে। সন্তানদের নিয়ে মেহেদীর অনেক স্বপ্ন ছিল। মেয়েদের পড়াশোনা করাবে, তাদের খুব ভালো অবস্থানে নিয়ে যাবে। এত কষ্ট দিয়ে মারার কি দরকার ছিল? সে কি দোষ করেছিলো। বুকে কেন পাড়া দিলো? একবারের জন্যও কি মায়া হয়নি, ভাবেনি তার ঘরে ছোট ছোট দুইটা বাচ্চা আছে। তারা বাবাকে ছাড়া কীভাবে চলবে। বড় মেয়েটি ঠিক ওর মতো হয়েছে। বড় মেয়েটিকে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করাবে। তাকে ভবিষ্যতে ডাক্তার বানানোর খুব ইচ্ছা ছিল ওর। বড় মেয়েটা ওর বাবাকে ছাড়া খেতে, ঘুমাতে চায় না। মাঝে মাঝে বাবার হাতে খেতে চায়, মাঝে একদিন না খেয়ে ছিল। বাবা কখন আসবে সেই প্রশ্ন সবসময় করতে থাকে।

তিনি বলেন, আমি কখনো কল্পনা করতে পারিনি যে এমন হবে। মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ আগেও আমার সঙ্গে কথা হয়। ঘটনার দিন যখন প্রথমে তাকে কল করি তখন সে রিসিভ করেনি। পরে সে কল দিলে আমিও ব্যস্ততার কারণে রিসিভ করতে পারিনি। ওর সঙ্গে আমার ভালোবেসে বিয়ে ছিল। আমি অসুস্থ থাকায় আমাকে ছাদে যেতে নিষেধ করেছিল সেদিন ফোনে। ফোনে এটাও বলেছিল বাসায় সাবধানে থেকো মেয়েদের নিয়ে, আমি রাতে বাসায় এসে সব বলবো বাইরে কি হচ্ছে। চারিদিকে গুলির আওয়াজ শুনতে পাই মোবাইলে কথা বলার সময়। এমন গুলির আওয়াজ শুনে তাকে বাসায় বা অফিসে যেতে বললে সে আমাকে তখন ধমক দিয়ে বলে এটা আমার কাজ, আমার দায়িত্ব। আমাকে খাবারও খেয়ে নিতে বলেছিল। এগুলোই ছিল তার সঙ্গে আমার শেষ কথা, তার আধাঘণ্টা পরেই জানতে পারি গুলির ঘটনা। 

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে পপি বলেন, তার সঙ্গে আমার শেষ কথা হয় বিকাল ৪টার দিকে। গুলি লাগে সন্ধ্যার আগে। আমি যখন জানতে পারি ঘটনাটি তখন কোনো ভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। হানিফ ফ্লাইওভারের ঢালে গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সেখানে থাকা তার সহকর্মীরা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার দেবরকে খবরটি জানাই। সে তখনই গাজীপুর থেকে রওনা দেয়। আমিও ঢাকা মেডিকেলে ছুটে যাই। তাকে নিয়ে যাওয়ার পাঁচ মিনিট পর গিয়ে দেখি সে জরুরি বিভাগের আইসিইউ’তে। এই দৃশ্য মনে পড়লে এখনো ঘুমাতে পারি না। পরে তাকে ইসিজি রুমে নিয়ে যায় সেখানে থাকা চিকিৎসক জানায় সে স্পটেই মারা গেছে। ছররা গুলির সঙ্গে বুলেটও ছিল তার শরীরে। মুখে, চোখে, গলায়, ঘাড়ে, মাথাসহ পুরো শরীরে কোথাও বাকি ছিল না। মুখে কোনো দাঁত ছিল না। মেহেদীর বুকের ভেতরে জুতার ছাপ পাওয়া গেছে। অনেক কষ্ট দিয়ে তাকে মারা হয়েছে। মারা যাওয়ার পরে বুকের মধ্যে পাড়া দিয়ে হয়তো মৃত্যু নিশ্চিত করেছে আমার এমন মনে হচ্ছে। হঠাৎ এক-দুইটা গুলি লাগতে পারে কিন্তু এত বেশি গুলি ছিল ওর শরীরে। সেদিন রাতে তার মরদেহ মর্গে রাখা হয়। পরের দিন দুপুরে ময়নাতদন্ত শেষে তার মরদেহ হস্তান্তর করে। চারদিকে রাস্তার অবস্থা খুব ভয়াবহ ছিল। এই অবস্থার মধ্যে তার মরদেহ নিয়ে আমরা পটুয়াখালীর বাউফলে যাই, সেখানে তার নিজ বাড়িতে দাফন হয়।

তিনি আরও বলেন, আমি বেশি দূর পড়তে পারিনি। যখন এইচএসসি পরীক্ষার টেস্ট দিয়েছিলাম তখন বিয়ে হয়। আমার মেয়েদের জন্য আমার কিছু একটা করতে হবে। ওর বাবার মতো হয়তো যত্ন নিতে পারবো না কিন্তু মেয়েদের তো বড় করতে হবে। ওর বাবার দেখা স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। আমি এখন নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছি না, ভাবছি আমার মেয়েদের কি হবে? কোথায় যাবো আমি ওদের নিয়ে। আমার যোগ্যতা অনুযায়ী একটা চাকরির ব্যবস্থা যদি হয় মেয়েদের জন্য হলেও সেটি করতে চাই। আমি একটা অন্ধকার জীবনের মধ্যে আছি। বাবাকে নিয়ে সন্তানদের হাজার প্রশ্নের জবাব কীভাবে দিবো? 

মেহেদীর মা মাহমুদা বেগম মানবজমিনকে বলেন, আমি আমার সন্তানকে ছাড়া ভালো নেই। আজ কতো মাস হলো সন্তানের মুখটা দেখতে পারি না। আমাকে মা বলে আর ডাকে না। আমার তিন ছেলের মধ্যে মেহেদী ছিল সবার বড়। সেই আমাদের সংসার চালিয়েছে। সবসময় আমাদের চিকিৎসা খরচ দিয়েছে। আমিও অসুস্থ আর বাবাও অসুস্থ। আমরা বাড়িতে থাকি পটুয়াখালীতে। ১৮ই জুলাই ঘটনার দিন দুপুরে মেহেদী আমাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য টাকাও পাঠিয়েছিল। ওর কবরের কাছে গেলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। মায়ের মন কি আর ঠিক থাকে। ওর বাবা সারাদিন মন খারাপ করে থাকে। সে স্ট্রোকের রোগী। হার্টের চারটি ব্লক ধরা পড়েছে। আমার ছোট ছেলেটার বয়স মাত্র বারো বছর, সে মাদ্রাসায় পড়ে পরীক্ষা দিচ্ছে। এখন কীভাবে চলবো। অসহায় হয়ে পড়েছি। আমার সন্তান কি দোষ করেছিল? কেন আমার সন্তানকে এভাবে মারলো? 
 

পাঠকের মতামত

উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাহেব আইন ও বিচার মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে থাকলে এ সব শহীদ পরিবার বিচার পাবেন কিনা সন্দেহ আছে। কারন ইতিমধ্যে সামাজিক মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে যে সকল স্বজনপ্রীতি ও নৈতিক স্খলনের তথ্য চাউর হয়েছে তাতে মনে হয় তিনি নিজ থেকে একটা সিদ্ধান্ত নিলে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তার ব্যপারে অনেকেই আশাহত।

মোহাম্মদ হারুন আল রশ
১১ ডিসেম্বর ২০২৪, বুধবার, ১:৩২ পূর্বাহ্ন

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

Hamdard

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status