মত-মতান্তর
সময় অসময়
নাটকের বিরুদ্ধে মব জাস্টিস কীসের ইঙ্গিত?
রেজানুর রহমান
৫ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবারবাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা হচ্ছে মঞ্চ নাটক। সেই নাটক দুরাচারী কিছু ব্যক্তির উচ্ছৃঙ্খলতার কারণে শিল্পকলা একাডেমির প্রশাসনিক প্রধানের হস্তক্ষেপে বন্ধ করে দিতে হয় এরচেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে? শিল্পকলার বক্তব্য, নাটক বন্ধ না করলে ঐ উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তিরা শিল্পকলা একাডেমি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতো। এ বক্তব্য নাট্যকর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়
একই দিনে দু’টি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আক্রান্ত হলো। একটি ঘটনা ঢাকার। অন্যটি চট্টগ্রামের। ঢাকায় সেগুনবাগিচাস্থ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মূল হলে দেশের বিশিষ্ট নাট্যসংগঠন দেশ নাটকের বহুল আলোচিত মঞ্চ প্রযোজনা নিত্যপুরাণ-এর বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। মঞ্চে নাটকের অভিনয় চলছে। বাইরে একটু যেন জটলা বিক্ষোভে রূপ নেয়। সংখ্যায় ২০/২৫ জনের একটি গ্রুপ নিত্য পুরাণ-এর প্রদর্শনী বন্ধ করার দাবি তোলে। বাইরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ স্বয়ং নাটকের মঞ্চে ঢুকে পড়েন। মঞ্চে নাটক চলা অবস্থায় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বাইরে অন্য কেউ মঞ্চে ঢুকে পড়া রীতিবিরুদ্ধ কাজ। জামিল আহমেদ শুধুমাত্র বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নন, তিনি দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাট্যকর্মীর শিক্ষকও বটে। তিনিই শিখিয়েছেন যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিরই সৃষ্টি হোক না কেন ‘শো মাস্ট গো অন’। অর্থাৎ নাটক থেমে থাকবে না। নাটক মঞ্চস্থ হবেই। অথচ তিনিই অকস্মাৎ নাটকের মঞ্চে ঢুকে চলমান নাটক থামিয়ে দিয়ে বললেন, নাটকের শো বন্ধ করতে হবে। তাঁর কথা শুনে নাটকের অভিনেতা, অভিনেত্রীরা অবাক এবং বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। দর্শক সারী থেকে প্রশ্ন আসে হঠাৎ কেন নাটক বন্ধ করতে হবে। মহাপরিচালক স্বয়ং অসহায় কণ্ঠে বলেন, বাইরে কিছু লোক বিক্ষোভ করছে। আমরা যদি নাটক বন্ধ না করি তাহলে তারা হয়তো শিল্পকলা পুড়িয়ে দিবে। মহাপরিচালকের নির্দেশে দেশ নাটকের নিত্যপুরাণ-এর বাকি মঞ্চায়ন থেমে যায়। পরে জানা যায়, দেশ নাটকের একজন কর্মকর্তা সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র ও গণআন্দোলন চলাকালে আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেছেন। তারই প্রতিক্রিয়াস্বরূপ শনিবার শিল্পকলায় দেশ নাটককে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে মঞ্চে চলমান নাটক বন্ধ করে দেয়া হয়। দেশে ইতিপূর্বে এমন অপ্রীতিকর ঘটনা আর ঘটেনি।
একই দিনে চট্টগ্রামে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের শোরুম উদ্বোধনের কথা ছিল নন্দিত অভিনয়শিল্পী মেহজাবিন চৌধুরীর। এজন্য তিনি চট্টগ্রামে গেলেও শোরুম উদ্বোধন করতে পারেননি। একটি পক্ষ মেহজাবিনকে উপেক্ষা করে তড়িঘড়ি মিলাদ মাহফিলের মাধ্যমে শোরুমটির উদ্বোধন ঘোষণা করেন। মিলাদ মাহফিলের মাধ্যমে শোরুম উদ্বোধন হতেই পারে। কিন্তু মেহজাবিনকে আমন্ত্রণ জানিয়েও কেন তাকে উপেক্ষা করা হলো এই নিয়েই মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। একই দিনে ঢাকায় শিল্পকলার মঞ্চে চলমান নাটকের প্রদর্শনী বন্ধ করা এবং চট্টগ্রামে মেহজাবিনকে দিয়ে শোরুম উদ্বোধন না করার ঘটনায় দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক ধরনের অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
আগেই বলেছি- সৈয়দ জামিল আহমেদ শুধুমাত্র বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নন। তিনি দেশের শত শত নাট্যকর্মীর প্রিয় শিক্ষকও বটে। অথচ তিনিই শিল্পকলার মঞ্চে চলমান নাটকের প্রদর্শনী বন্ধ করে দেয়ায় নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। যদিও সৈয়দ জামিল আহমেদ এব্যাপারে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। গত রোববার এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, দর্শকের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে নাটকের প্রদর্শনী মাঝপথে বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। পরিস্থিতি দেখে তার শঙ্কা হচ্ছিলো শিল্পকলা একাডেমিও আক্রান্ত হতে পারে। সৈয়দ জামিল আহমেদ আরও বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ২২ জায়গায় শিল্পকলা একাডেমিতে হামলা হয়েছে। সে সব মাথায় ছিল তার। তিনি বলেছেন, দর্শকদের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমরা নাটকের প্রদর্শনী বন্ধ করি। আমি ভেতরে গিয়ে দর্শকদের কাছে ক্ষমা চেয়েছি।
সম্মানিত মহাপরিচালকের এই বক্তব্যকে ঘিরেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে দেশ নাটকের একজন কর্মকর্তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের সময় বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেছেন এবং এখনো করছেন, এই অভিযোগ যদি সত্যও হয় তার জন্য কী গোটা সংগঠনকে দায়ী করা যায়? মহাপরিচালক স্বয়ং বলেছেন, দেশ নাটকের জনাবিশেক সদস্য জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ভাবে অংশ নিয়েছেন। তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধও কয়েকজন আছেন। এই যদি হয় বাস্তবতা তাহলে সংগঠন হিসেবে দেশ নাটকের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদমুখর হয়েছেন তাদের যুক্তি কী? আমরা মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলছি। এই কী তার নমুনা?
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার বলেছে, বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা হচ্ছে মঞ্চ নাটক। সেই নাটক দুরাচারী কিছু ব্যক্তির উচ্ছৃঙ্খলতার কারণে শিল্পকলা একাডেমির প্রশাসনিক প্রধানের হস্তক্ষেপে বন্ধ করে দিতে হয় এরচেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে? শিল্পকলার বক্তব্য, নাটক বন্ধ না করলে ঐ উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তিরা শিল্পকলা একাডেমি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতো। এ বক্তব্য নাট্যকর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
দেশ নাটক-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ‘২রা নভেম্বর শিল্পকলা একাডেমির মূল হলে আমাদের নাটক নিত্যপুরাণ-এর ১২৭তম প্রদর্শনী চলাকালে একদল লোকের মারমুখী অবস্থান ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নাটকটির প্রদর্শনী মাঝপথে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। দেশ নাটকের একজন সদস্যের ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে তৈরি ওই মব প্রথমে জাতীয় নাট্যশালার মূল গেটে ব্যানার টাঙ্গিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দর্শকদের হলে প্রবেশে বাধা দিতে থাকে। এক পর্যায়ে নাট্যাঙ্গনের কয়েকজন সিনিয়র সদস্য সহ স্বয়ং মহাপরিচালক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের সঙ্গে কথা বলেন।
এরপর পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলে মহাপরিচালক মঞ্চে নাটক শুরুর পরামর্শ দেন। নাটক যখন প্রায় শেষার্ধে তখন জানা যায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীরা পুনরায় শিল্পকলার সামনে বিক্ষোভ শুরু করেছে এবং শিল্পকলার গেট ভাঙার চেষ্টা করছে। এই ঘটনায় আমরা দেশ নাটক-এর সদস্যরা অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে প্রদর্শনী বন্ধ করতে বাধ্য হই’।
মঞ্চে চলমান নাটক বন্ধ করে দেয়ার প্রতিবাদে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ঘটনার প্রকৃত কারণ সরকারকে জানানোর জন্য শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালককে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ঘটনার প্রতিবাদে ৮ই নভেম্বর বিকালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সামনে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের উদ্যোগে এক নাট্যকর্মী সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। নাট্যজন মামুনুর রশীদ বলেছেন, যারা মঞ্চে নাটক বন্ধ করে দেয়ার সাহস দেখায় তারা দেশের ভালো চায় না। এই মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ জরুরি।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।
স্বাধীনতার পর থেকে শিল্পকলার নামে সবসময় দাড়ি ও টুপী পরিহিতদের ভিলেন হিসেবে দেখানো এসব শয়তানিকলা বন্ধ করে ছাত্র-জনতা ঠিকই করেছে l
"দেশ নাটকের একজন কর্মকর্তা সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র ও গণআন্দোলন চলাকালে আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেছেন।" এ বিষয়ে মি রেজানুর রহমানের বক্তব্য কী?
রেজানুর রহমান, ইঙ্গিত হলো আপনার মত ফ্যাসিস্ট দোসর চিনতে ছাত্র জনতা ভুল করেনি। আপনাদের বস জীবন নিয়ে পালিয়ে বাঁচলেন আর আপনাদের মত খুনি হাসিনার দোসররা কেমন "ফুটফুটে সুন্দর" হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন!! চামে পাইলে জনগণ কাপড় খুলে নেবে আপনাদের। সাবধান!!