ঢাকা, ২২ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবার, ৯ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২২ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

দেশ বিদেশ

বাংলাদেশের নদী ভাগ্য ও ইলিশ কূটনীতি

মুস্তাইন জহির

(৬ মাস আগে) ৪ অক্টোবর ২০২৪, শুক্রবার, ৩:৩৯ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৫:০১ অপরাহ্ন

mzamin

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালকে বাংলাদেশে একটি সূক্ষ্ম অপারেশন তদারকি করতে হয়েছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন আসন্ন ছিল। গণভবনে গণমিছিল পোঁছানোর আগে হাতে মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময় ছিল। ভারত বেশ বুঝতে পারছিলো  বাংলাদেশে হাসিনার ১৫ বছরের শাসনকালের  অবসান হতে চলেছে। তাই তাঁর জন্য একটি নিরাপদ প্রস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যাতে তিনি  ভারতে পালিয়ে যেতে পারেন। প্রতিবেশী দেশের  সবথেকে বিশ্বস্ত বন্ধুকে ত্যাগ না করার সিদ্ধান্তটি পরবর্তী পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে এবং বাংলাদেশে জনগণের মনে ভারতবিরোধী ক্ষোভকে উস্কে দিয়েছে। ভারতের একজন কর্তৃত্ববাদী শাসককে রক্ষা করার সিদ্ধান্তকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য লড়াই করা জনগণের প্রতি অবমাননা বলে মনে করা হচ্ছে। এমনকি হাসিনার পতনও ভারতের প্রতি মনোভাব পরিবর্তন করতে পারেনি। এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার জানিয়েছেন, এবার বাংলাদেশ ভারতে ইলিশ রপ্তানি করতে পারবে না। 

তবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য প্রথম বিদেশ সফরে যাওয়ার আগে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ভারতে ইলিশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। দিল্লি এটি কী চোখে দেখবে তা বোঝা খুব কঠিন নয়। ইউনূসের সরকারের আশা-আকাঙ্খা যাই হোক না কেন, উপদেষ্টাদের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা ঠিকই ধরা পড়বে দিল্লির চোখে। এটি সরকারের দুর্বল অবস্থান এবং  প্রাথমিক তুষ্টি নীতির সূচনাও  হতে পারে। এই সময়ের মধ্যে ভারত স্পষ্ট করে দিয়েছে- ঢাকার অনুরোধ সত্ত্বেও নরেন্দ্র মোদি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকের সাইডলাইনে ইউনূসের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ দেখাননি। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঝাড়খণ্ডে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের’ উল্টো করে ফাঁসি দেয়ার হুমকি দিয়ে বিতর্ককে আরো উস্কে দিয়েছেন। এটি প্রমাণ করে ভারত এমন একটি দীর্ঘস্থায়ী কৌশল অনুসরণ করবে যাতে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা যায় এবং বাংলাদেশ সরকারকে দুর্বল করা যায়।

ভারতের এই প্লেবুক সহজেই বোধগম্য এবং পুরনো। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে যখনই আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো সরকার ছিল তখনি তারা দিল্লির দিক থেকে অস্থিতিশীলতার সম্মুখীন হয়েছে। শেখ মুজিব সরকারের সাথে ভারতের সম্পর্ক এবং ১৯৭৫ সালে মুজিব হত্যার পর বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা, বিশেষ করে কয়েক ডজন অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা যা সামরিক প্রতিষ্ঠানকে জর্জরিত করেছিল এর সাক্ষ্য বহন করে। যে কোনো ব্যবস্থা বা সমাজের জন্য একেবারে মৌলিক স্তরে কাজ করার ক্ষেত্রে, সবচেয়ে তাৎক্ষণিক এবং গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা যা জাতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। অন্যথায় সমাজে মাথাচাড়া দেয়  বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তা। বর্তমানে টালমাটাল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। এর জেরে ইউনূস প্রশাসনের মনোযোগ বিঘ্নিত হতে পারে। তারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে ফোকাস করতে সক্ষম হবে না- দেশের অভ্যন্তরে ফ্যাসিবাদী উপাদানগুলোর মোকাবিলা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের পাল্টা আক্রমণ। শীঘ্রই, সরকার পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য ভারতের সহায়তা  চাইতে বাধ্য হবে এমনটাই মনে করছে ভারত। আর সেই মুহূর্তেরই অপেক্ষা করছে দেশটি।

কূটনীতি শুধুমাত্র স্বদিচ্ছার উপর নির্ভর  করে না। এটি বাস্তব রাজনীতিকে ঘিরে আবর্তিত। যতক্ষণ না একটি দেশের বাস্তব ও কার্যকরী শক্তি থাকে যাতে অন্য দেশকে আলোচনার টেবিলে আসতে বাধ্য করা যায়, তাকে সবসময় দুর্বল অবস্থানে থেকেই কথা বলতে হবে। ভারতের অনেক কিছু হারানোর আছে, যা এক কর্তৃত্ববাদী শাসককে সমর্থন করে তারা অর্জন করেছিল। সেই শাসক গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত। বাংলাদেশের জাতীয় কাঠামোকে কলুষিত করার জন্য দায়ী। ক্ষমতার পরিবর্তনের পর  যতক্ষণ না ভারত বাংলাদেশের দুর্বলতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ খুঁজে পাচ্ছে,  ততক্ষণ পর্যন্ত তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত  হবে না।এই মুহূর্তে, কোনো শুভেচ্ছা এবং তুষ্টি কাজ করবে না। তারা বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও দুর্বল করতে পারে।

ইলিশের দিকে নজর দেয়া যাক, যা পশ্চিমবঙ্গর মানুষ  দুর্গাপূজার সময় বিশেষভাবে উপভোগ করে। ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়ই দেশেই ইলিশ উৎপাদন হয়। বাংলাদেশ এই সুস্বাদু মাছের একচেটিয়া উৎস নয়। এমনকি ভারত বিভিন্ন দেশে ইলিশ রপ্তানিও করে। অনেকেই বলে থাকেন যে, সবচেয়ে সুস্বাদু ইলিশ পদ্মায় পাওয়া যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে নদীর অবস্থা সম্পর্কে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। পদ্মাকে বাঁচিয়ে রাখতে তার জলপ্রবাহ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ কি কখনো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যা এটিকে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা ইলিশের জন্য একটি ভালো প্রজনন ক্ষেত্র করে তোলে? এর ফলে পানির প্রয়োজনীয় মাত্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশের নদীপথের শিরা ও ধমনীগুলো অবরুদ্ধ করার জন্য কে দায়ী, যার ফলে আসন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটছে? কেন তারা বাংলাদেশকে পানি দিতে চায় না, কিন্তু সেই বাংলাদেশের কাছেই আবার মাছ চায়?

বাংলাদেশ ও ভারতের সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে কত শতাংশ মানুষ এই দামি মাছ কিনতে ও খেতে সক্ষম? কেন বাংলাদেশ তাদের নিজেদের লোকেদের জন্য এটিকে আরো  সস্তা এবং সহজলভ্য করার চেষ্টা করছে না? এই ইলিশ কূটনীতি দিয়ে ইউনূস কী অর্জন করেছেন? পশ্চিমবঙ্গ কি পদ্মা, যমুনা এবং তিস্তায় প্রবাহিত পানির ন্যায্য অংশ ছেড়ে দিতে রাজি হবে ? মোদি এবং অমিত শাহ কি পিছু হটবেন এবং সার্বভৌমত্ব ও শ্রদ্ধার নীতিতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করবেন? ভারত কি আওয়ামী লীগের শাসনামলে জড়িত অপরাধী ও খুনিদের আশ্রয় দেয়া বন্ধ করবে? গত সাড়ে পনেরো বছরে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার পর  অহংকারী ভারতের সামনে নম্র ও দুর্বলতা দেখিয়ে বাংলাদেশের কী লাভ?

জুলাইয়ের গণহত্যার প্রধান অপরাধী দিল্লিতে আশ্রয় পেয়েছে। একজন গণহত্যাকারীকে রক্ষা করতে এবং তাকে বন্ধু বলতে ভারতের কোনো দ্বিধা নেই! এতে তারা দ্বিদলীয় ঐকমত্যও দেখিয়েছেন। ভারতকে বাংলাদেশের জনগণ এবং তার ফ্যাসিবাদী দালাল আওয়ামী লীগের মধ্যে যে কোনো একটিকে বেছে নিতে হবে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা অন্তরের। ভারতকে এটা মেনে নিতে হবে, অন্যথায় কোনো সহযোগিতার পথ খোলা থাকবে না।  ইলিশ সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের মাধ্যম হতে পারে না।  

(লেখকের নিজস্ব মত)
সূত্র :  সাউথ এশিয়া জার্নাল

 

পাঠকের মতামত

পানির নায্য হিস্যা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই 'INTER NATIONAL WATER CONVENTION'এ স্বাক্ষর করতে হবে ।

মিলন আজাদ
৪ অক্টোবর ২০২৪, শুক্রবার, ৪:০৯ অপরাহ্ন

দেশ বিদেশ থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

দেশ বিদেশ সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status