ঢাকা, ৭ অক্টোবর ২০২৪, সোমবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩ রবিউস সানি ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

তিতাসের হারুন

৫০০ কোটি টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ

স্টাফ রিপোর্টার
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বুধবারmzamin

তিতাস গ্যাস কোম্পানির অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসছে অহরহ। সোমবার তিতাসের দুর্নীতিবাজ এমডি’র চুক্তি বাতিলের পর কোম্পানিটিতে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা এখন চরম শঙ্কায় আছেন। তিন বছর ধরে তিতাস গ্যাস কোম্পানিতে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হারুনুর রশীদ মোল্লাহ’র বিরুদ্ধে। তিনি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এ সময়ে ১৫০টি প্রতিষ্ঠানকে গ্যাসের নতুন সংযোগ ও লোড বৃদ্ধি করে অন্তত ৫৫০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে তিতাস গ্যাসের দুর্নীতিবাজ এক শ্রেণির কর্মকর্তার উস্কানিতে গতকাল পেট্রোবাংলায় বিক্ষোভ, হামলা ও ভাঙচুর করে কোম্পানির একদল কর্মকর্তা-কর্মচারী। তিতাস গ্যাসে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের প্রতিবাদে এ বিক্ষোভ বলে জানিয়েছেন তারা। এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার সাংবাদিকদের বলেন, তিতাসের লোকজনের দাবি হচ্ছে তাদের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে এমডি করতে হবে। কিন্তু পেট্রোবাংলার সিনিয়রিটির তালিকায় তিতাস গ্যাসের শীর্ষ ৫০-৬০ এর মধ্যেও কেউ নেই। আবার অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এটা করে একশ্রেণির লোকজন দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়ার চেষ্টা করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের নীতি হচ্ছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। তিনি বলেন, আমরা পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে অবহিত করেছি। যারা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তিতাস গ্যাস সূত্র জানিয়েছে, শাহনেওয়াজ পারভেজকে দায়িত্ব দেয়ার পর থেকে তিতাসের জিএম (জিএম ইএসডি) হেলাল তালুকদার, জিএম (অডিট) মো. রাশিদুল আলম, ডিজিএম (পিসিডি) ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক, প্রিপেইড মিটার প্রকল্পের পিডি কাওসার আলম সুমন অন্যদের উস্কানি দিতে শুরু করেন। অন্যদের ফুঁসলিয়ে পেট্রোবাংলায় গিয়ে হামলার নেতৃত্ব দেন। মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে বিক্ষুব্ধরা রাজধানীর কাওরান বাজারে পেট্রোবাংলার প্রধান কার্যালয় পেট্রো সেন্টারের নিচতলার রিসিপশনের গ্লাস ভাঙচুর করেন। এর পৌনে এক ঘণ্টা পর তারা তিতাস গ্যাসে ফিরে যান। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ মোল্লাহ’র চুক্তি ৯ই সেপ্টেম্বর বাতিল করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এরপর গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজকে তিতাস গ্যাসে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চলতি দায়িত্ব দেয়া হয়। শাহনেওয়াজ পারভেজ সৎ ও দক্ষ হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। যা তিতাস গ্যাসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের জন্য শঙ্কার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন অনেকে।

এদিকে, হারুনুর রশীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিন বছর ধরে তিনি তিতাস গ্যাস কোম্পানিতে এক ধরনের রামরাজত্ব কায়েম করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে তিনি আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে তিন বছরে ১৫০টি প্রতিষ্ঠানকে গ্যাসের নতুন সংযোগ ও লোড বৃদ্ধি করে অন্তত ৫৫০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন। প্রতিটি সংযোগ ও লোড বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ঘুষের রেট ছিল ৫ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা। তার সময়ে অন্তত ১ হাজার ৪০০টি অবৈধ গ্যাস-সংযোগ দেয়া হয়। এসব অবৈধ সংযোগ থেকে মাসে ২০ কোটি থেকে ৩০ কোটি টাকা ঘুষ আদায় করতো তার সিন্ডিকেট। 

হারুনুর রশীদ মোল্লাহ’র বিরুদ্ধে আরও অভিযোগের মধ্যে রয়েছে-তিনি কেরানীগঞ্জ এলাকায় কয়েক শ’ ছোট-বড় শিল্পকারখানায় অবৈধ সংযোগ দিয়ে প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকা মাসোহারা নিতেন। গত তিন বছরে এসব কারখানায় একবারের জন্যও অভিযান চালানো হয়নি। সমপ্রতি জ্বালানি বিভাগ থেকে ওই এলাকায় গোপনে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। দায়িত্ব দেয়া হয় জ্বালানি খাতের সবচেয়ে সৎ ও দক্ষ অফিসার হিসেবে পরিচিত গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজকে। এরপর গত দু’দিনের ঝটিকা অভিযানে ওই এলাকায় অসংখ্য অবৈধ শিল্পকারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে হারুনুর রশীদ মোল্লাহ তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের এমডি পদে পদোন্নতি পান। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে একের পর এক ঘুষ ও অনিয়মের অভিযোগ উঠতে থাকে। প্রায় দুই বছরে এমডি থাকাকালীন তিনি অবৈধভাবে ১০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ হাতিয়ে নেন এই খাত থেকে। এই অর্থের একটা অংশ তুলে দিতেন সিন্ডিকেটের হাতে। বিনিময় হিসেবে ২০২৩ সালের আগস্টে তিতাসের এমডি পদে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান তিনি। হারুনুর রশীদ মোল্লাহ এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন যে, যত বড় অনিয়ম-দুর্নীতি করুক না কেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় বারবার ছাড় পেয়ে যান। সাবেক প্রতিমন্ত্রীর ছত্রছায়ায় মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নিয়ে ক্যাপটিভ পাওয়ারে গ্যাস-সংযোগ, গ্যাসের নতুন সংযোগ ও অবৈধ সংযোগের রমরমা বাণিজ্য করেছেন তিনি। চুক্তি নবায়ন হওয়ার পর তিনি এতটাই বেপরোয়া হয়ে পড়েছিলেন, বড় বড় শিল্পকারখানার মালিকদের কাছে প্রতিমাসে ৫ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা ঘুষ দাবি করতেন। যারা তাকে ঘুষ দিতেন না, তাদের নানাভাবে হয়রানি করতেন। কোনো কারণ ছাড়াই তাদের শিল্পকারখানার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতেন। এরপর নানাভাবে করতেন হয়রানি।
তিতাসের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের কোনো গ্যাস বিতরণ সংস্থা ১০ মেগাওয়াটের বেশি কোনো ক্যাপটিভ পাওয়ার কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করতে চাইলে এজন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অনুমতি নিতে হয়। ১০ মেগাওয়াটের বেশি এমন অন্তত ২০টি ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রকে গ্যাস-সংযোগ দিয়েছেন তিতাসের বর্তমান এমডি হারুন, যেগুলোর একটিরও অনুমতি নেয়া হয়নি। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের অনুমতি ছাড়াই গ্যাস সরবরাহ করা প্রতিটি ক্যাপটিভ কেন্দ্র থেকে ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা নেয়া হয়েছে। বেশকিছু ক্ষেত্রে তিতাসের এমডি ১০ মেগাওয়াটকে ভেঙে একাধিক ভাগে লোড দিয়েছেন। এতে কৌশলে এড়ানো গেছে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি। এ ছাড়া অন্তত ১০০ ক্যাপটিভ কেন্দ্রকে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়েছে ঘুষের বিনিময়ে।

অভিযোগ আছে, সিএনজি স্টেশনে গ্যাস সংযোগে প্রতিটির কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা করে ঘুষ নিয়েছেন তিতাসের এমডি। সিএনজি স্টেশনে গ্যাস সংযোগ নিতে হলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) লাইসেন্স নেয়া বাধ্যতামূলক। এই লাইসেন্স না থাকলেও একের পর এক নতুন গ্যাস সংযোগ দিয়েছেন তিতাস গ্যাসের এমডি হারুন। তিতাস সূত্র বলছে, ঢাকায় লাইসেন্সবিহীন সিএনজি স্টেশন রয়েছে ৪০টি। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জে ১৫টি, নরসিংদীতে ১০টি, গাজীপুরে ১০টি, মুন্সীগঞ্জে ২টিসহ মোট ৭৯টি লাইসেন্সবিহীন গ্যাস সংযোগ রয়েছে তিতাসের। 
 

পাঠকের মতামত

হরি হরি লুট,

হরিসেবক
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বুধবার, ২:৫৯ অপরাহ্ন

তিতাস গ্যাসের গ্যাস চুরির জন্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব হারুণ মোল্লা এর সহযোগী ও সংশ্লিষ্ট Authority হিসাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার ও Contract basis পরিচালক অপারেশন কামরুজ্জামান খান দায় এড়াতে পারেন না। তাই এ দুজন এর অপসারন সময়ের দাবী।

Nahid
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বুধবার, ১১:৩১ পূর্বাহ্ন

এমডি কে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করে আইনের আওতায় আনা উচিত। তার অনুসারী দুর্নীতিবাজদের ও ছাঁটাই করা উচিৎ।

Khalil
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বুধবার, ৬:১২ পূর্বাহ্ন

তিতাস গ্যাস এর শেয়ার কিনছি ২০১৬-১৭ এর দিকে। সেই শেয়ার কিনে না একটা ভাল ডিভিডেন্ড পেলাম, না ক্যাপিটাল গেইন। কমতে কমতে ৫০-৬০ টাকার শেয়ার ২০-২১ টাকাতে নেমে এখন ২৫-২৬ টাকায় ঘুরে। আমরা কপাল থাপড়ায় একটা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনে আর এরা সব মচ্ছব করছিল। বাহ! কি সৌন্দর্য! তিতাস সহ সব রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস কোম্পানির গত ১০-১২ বছরের সকল টপ ম্যানেজমেন্টের এবং কোম্পানির পারফর্মেন্স রিভিউ করা দরকার। আর যারা এ ধরণের লুটপাটে জড়িত, সব গুলোর সম্পদ জব্দ করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া দরকার। দেশ ধ্বংসী এসব লোকের আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে এই শাস্তি হলেই কেবল পরবর্তী কেউ এমন দায়দায়িত্বহীন কাজ করার পূর্বে শ খানেক বার চিন্তা করবে।

ফয়েজ
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বুধবার, ৩:৩৫ পূর্বাহ্ন

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status