ঢাকা, ২১ এপ্রিল ২০২৫, সোমবার, ৮ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২১ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

শেষের পাতা

সরজমিন মোহাম্মদপুর থানা

‘আমার ভাগ্নে ৭ম শ্রেণির ছাত্র, আন্দোলন দেখতেও যায়নি’

সুদীপ অধিকারী
২৪ জুলাই ২০২৪, বুধবার
mzamin

মা তুমি চিন্তা করো না। তুমি কাঁদছো কেনো? তুমি কেঁদো না মা, আমি তো কিছুই করিনি। শুধু শুধু আমাকে ধরে এনেছে। উপরে আল্লাহ আছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। গতকাল সকালে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানা থেকে আদালতে চালান করার জন্য প্রিজন ভ্যানে উঠানোর সময় এভাবেই নিজের মাকে অশ্রুসিক্ত হয়ে কথাগুলো বলছিল সপ্তম শ্রেণির ছাত্র নাঈম   হোসেন। আর ছোট্ট ছেলেকে আদালতে নিয়ে যাওয়া দেখে কেঁদে বুক ভাসচ্ছিলেন মা। বলছিলেন, বাবা তুমি চিন্তা করো না। ভয় পেয়ো না। আমরা আছি। আমরা তোমার পেছন পেছন আসছি। যেভাবেই হোক তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো। 

থানার সামনে অপেক্ষমান নাঈমের মামা মো. স্বপন মানবজমিন’কে বলেন, আমার ভাগ্‌নে স্কুলে পড়ে। ৭ম শ্রেণির ছাত্র। ও অনেক ছোট।  এসব আন্দোলন সম্পর্কে কিছুই বোঝে না সে। কখনো আন্দোলন দেখতেও যায়নি। কড়া নির্দেশ ছিল ওর মায়ের। কিন্তু সোমবার রাত ১১টার দিকে মোহম্মদপুরের কাঠপট্টি এলাকায় নিজেদের বাসার সামনে থেকে থানায় তুলে আনলো পুলিশ। আমরা কখনো ভাবতেই পারিনি আমার এই ছোট্ট ভাগ্‌নেকে এভাবে ধরে আনা হবে। তিনি বলেন, আমিও কাঠপট্টি এলাকায় থাকি। আমার আপা রাতে এসে হঠাৎ কান্নাকাটি শুরু করে। আমরা রাতেই থানায় চলে আসি। অনেক ধরাধরি করেছি। অফিসারদেরকে অনেক বুঝিয়েছি, আকুতি-মিনতি করেছি। কোনো কাজ হয়নি। এখন মারামারির মামলায় নাঈমকে চালান করা হলো। কোনোকিছু না করেও তাকে বাসার সামনে থেকে ধরে নিয়ে এসে মামলার আসামি বানানো হলো। এই ছোট্ট বয়সে ও  এত মানসিক চাপ কীভাবে নিবে। ওর ক্যারিয়ারটাই শেষ। 

এদিকে ১৪ বছরের সজীব কাজ করতেন মোহম্মদপুর টাউন হল বাজারের মুরগির দোকানে। সারারাত গাড়ি থেকে মুরগি নামিয়ে যা আয় করতেন তাই সংসার চালানোর জন্য তুলে দিতেন মায়ের হাতে। কিন্তু সোমবার রাত ১০টার দিকে তাকেও তুলে আনা হয় মোহম্মদপুর থানায়। গতকাল সকালে থানার সামনে কথা হয় সজীবের বড়ভাই মো. শাহিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার ভাইতো পড়ালেখা করে না। ও আন্দোলন করবে কেন? ও তো মুরগির দোকানে কাজ করে। প্রতিদিনের ন্যায় সোমবার রাতেও টাউন হলে নিজের কাজ করছিল। সেখান থেকে ওকে থানায় ধরে আনা হয়। এখন ওকে চালান করে দেয়া হলো। কী মামলায় চালান করা হলো তাও আমাদেরকে বলা হয়নি। তিনি বলেন, ও এমন কী করেছে? আমার সুস্থ ভাইকে রাতে ধরে এনে নির্যাতন করা হয়েছে। ভোর সকালে ওকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকেই সকাল সাড়ে ১০টার দিকে থানায় আনা হয়েছে। থানায় ঢোকার সময় আমার ভাইকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখেছি। ওর হাতেও জখম রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা অবশ্যই চাই যারা অন্যায় করেছে তাদের শাস্তি হোক। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে যেভাবে ধরে এনে এসব মারামারিসহ বিভিন্ন মামলায় ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে তা মোটেও কাম্য নয়। আমরা এখন কোথায় যাবো? কাকে ধরবো কিছুই বুঝতে পারছি না। নাঈম ও সজীবের মতোই মোহম্মদপুর বাঁশবাড়ি এলাকা থেকে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হেঁটে আসার সময় সোমবার রাত ৮টার দিকে থানায় ধরে আনা হয় ১৭ বছরের অন্তর ও ২০ বছর বয়সী তুহিনকে। এই দুই চাচাতো ভাইকে মঙ্গলবার মোহম্মদপুর থানার সামনে দেখতে আসা রেডিয়েন্ট ফার্মাসিটিক্যালে কর্মরত মামা মো. রাজু বলেন,  আমার দুই ভাগ্‌নের মধ্যে অন্তর শাহবাগের একটি রেস্টুরেন্টে কজ করে। ও সবেমাত্র কয়েকদিন ঢাকাতে এসেছে। ঢাকার কিছুই চেনে না সে। ও কেমন করে আন্দোলনে যাবে। ও তো এই এলাকায়ই থাকে না। রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকায় ও আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আর তুহিন কাজ করে মোহম্মদপুর টোকিও স্কয়ারের একটি দোকানে। আমি বসিলা ৪০ ফিটের আমার বাসা থেকে বেড় হয়ে ওদেরকে বাসস্ট্যান্ডের দিকে আসতে বলি। ওরা দু’জন আমার ফোন পেয়েই হেঁটে আসছিল। তখনই ওদেরকে আটক করে থানায় আনা হয়। ওরা এসবের কিছুই জানে না। এই খবর শুনে দেশের বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়ায় আমাদের পরিবারের মানুষগুলো পাগল হয়ে যাচ্ছে। ওদের বাবা-মা বার বার ফোন দিচ্ছে। এসব আন্দোলন-মারামারি নিয়ে ওদের বিষণ ভয়। ওরা প্রথম থেকেই এসব পাশ কাটিয়ে চলছিল। এর ভিতরেও কখনো যায়নি। আর ওদের সঙ্গেই এটা হলো। এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই আমাদের। তিনি বলেন, যারা অন্যায় করেছে তারা ঠিকই পালিয়ে গেছে। আর এখন আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে ঝামেলায় ফেলা হচ্ছে।

মোহম্মদপুর আল্লাহ-করিম মসজিদের সামনে সবজি বিক্রেতা মো. রাকিব হোসেনকেও (২২) তার বাসা থেকে আটক করে আনা হয় মোহম্মদপুর থানায়। থানায় তাকে দেখতে আসা রুমমেট নজরুল ইসলাম বলেন, আমাদের বাড়ি ভোলার চরফ্যাশন। মোহম্মদপুর চাঁদ উদ্যান এলাকায় বাসা ভাড়া করে থাকি। আর ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করি। রাকিবও আমার সঙ্গে আল্লাহ-করিমের সামনে সবজি বিক্রি করতো। গত বৃহস্পতিবার মোহম্মদপুর বাস্ট্যান্ড এলাকায় আন্দোলন চলাকালে অন্যদের মতো কৌতুহলবসত রাকিবও তার ফোনে আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভের কিছু ঘটনার ভিডিও করে রাখে। যা তার ফোনেই ছিল। সোমবার রাতে হঠাৎ আমাদের মেসে পুলিশ অভিযান চালায়। পুলিশ আমাদের সকলের ফোন চেক করে। এ সময় আমাদের বাসার তিনজনের ফোনে আন্দোলনের ভিডিও দেখতে পয়। তখন বাকি দু’জনকে অন্যদের জিম্মায় রেখে গেলেও রাকিবকে থানায় ধরে আনে পুলিশ। আমরাও ওর সঙ্গে রাতে থানায় আসি। কিন্তু আমাদের কিছুই জানানো হয়নি তখন। এখন দেখছি মোহম্মদপুরে সংঘর্ষের মামলায় ওকে চালান করে দেয়া হলো। নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা পেটের দায়ে ঢাকায় সবজি বিক্রি করি। যা টাকা পাই তা বাড়িতে পাঠিয়ে খুব কষ্টে  মেস বাসায় থাকি। এখন শুধুমাত্র ভিডিও করার দায়ে আমার বন্ধুকে এভাবে সংঘর্ষের মামলায় চালান করা হলো। এটা মেনে নেয়া যায় না। 

এদিকে ভাই সাইফুলের খবর জানতে সোমবার রাত থেকে থানায় থানায় হন্নে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন বোন সাদিয়া। রাতভর থানার সামনে কাটানোর পর ভাইয়ের দেখা পেতে মঙ্গলবার সকালেও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন বোন। কখন ভাইকে বাইরে নিয়ে আসবে, চালান করবে আর দূর থেকে এক পলক দেখবে বোন। কিন্তু ৮ আসামির চালানের পরও তাদের মধ্যে নিজের ভাইকে খুঁজে পায়নি বোন সাদিয়া। অশ্রুশিক্ত হয়ে তিনি বলেন, সোমবার থেকে আমার ভাই নিখোঁজ। লোক মারফত শুনতে পারি আমার ভাইকে মোহম্মদপুর থানায় ধরে আনা হয়েছে। তাই  রাতেই এখানে চলে আসি। এখান থেকে বলা হয় আমার ভাই সাইফুল ভিতরেই আছে। তবে তার সঙ্গে দেখা করা যাবে না। ভাই ভিতরে আছে শুনে আটক হলেও কিছুটা স্বস্তিতে ছিলাম যে, আমার ভাইকে পাওয়া গেছে। ভাইয়ের খাবার এনে পুলিশকে দিলাম। খাবার দেয়ার জন্য টাকাও দিলাম। বার বার করে আমাকে আস্বস্ত করা হয়েছে আমার ভাই ভিতরেই আছে। কিন্তু এখন দেখছি আমার ভাই এখানে নেই। তাহলে কেনো আমাকে বলা হলো। এখন আমি আমার ভাইকে কোথায় খুঁজবো?  কী করবো কিছুই মাথায় আসছে না। 
এসব বিষয়ে মোহম্মদপুর থানার ডিউটি অফিসার এসআই মো. সহিদুল জানান, সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে আমরা ৮ জনকে আটক করেছি। তাদের সকলকেই আদালতে চালান করা হয়েছে। তারা দোষী না নির্দোষ এটা আদালতই যাচাই-বাছাই করবেন।  

পাঠকের মতামত

কি আর বলবো এটা নাকি স্বাধীন দেশ

ফাহিম
২৫ জুলাই ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২:৫৯ পূর্বাহ্ন

এই ধরনের পরিস্থিতি খুবই দুঃখজনক। নিরপরাধ শিশুদের সাথে এমন আচরণ মানা যায় না। বিচার সঠিকভাবে হওয়া উচিত।

Mohammad Nazrul Isla
২৪ জুলাই ২০২৪, বুধবার, ১২:৫৬ অপরাহ্ন

এই ধরনের পরিস্থিতি খুবই দুঃখজনক। নিরপরাধ শিশুদের সাথে এমন আচরণ মানা যায় না। বিচার সঠিকভাবে হওয়া উচিত।

মোঃ সুজন
২৪ জুলাই ২০২৪, বুধবার, ১১:৫৬ পূর্বাহ্ন

অবাক হব না, যদি এদের বিরুদ্ধে ৭১ এর যুদ্ধাপরাধ মামলা দেয়া হয়।

parvez
২৪ জুলাই ২০২৪, বুধবার, ১১:৪২ পূর্বাহ্ন

সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া এভাবে গন গ্রেপতার সমাজে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে যা কাম্য নয়

মনির
২৪ জুলাই ২০২৪, বুধবার, ১০:০৪ পূর্বাহ্ন

সব সময় দুর্ভোগ নাঈম হোসেনদের।

ছালাম
২৪ জুলাই ২০২৪, বুধবার, ৮:৩২ পূর্বাহ্ন

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status