অনলাইন
সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে 'গ্রীষ্ম কূটনীতিতে' ব্যস্ত চীন
মানবজমিন ডিজিটাল
(১১ মাস আগে) ১০ জুলাই ২০২৪, বুধবার, ১২:৪৫ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৭:৫৫ অপরাহ্ন

এই গ্রীষ্মে ভীষণ ব্যস্ত চীন। আফ্রিকা, ইউরোপ, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশ এবং এশিয়ার সাতজন বিশিষ্ট ব্যক্তি একের পর এক চীন সফর করেছেন। এটি বিশ্বের কাছে চীনের অবস্থান এবং দক্ষিণের দেশগুলির প্রতি চীনের সহযোগিতাকে প্রতিফলিত করে। মার্কিন চাপের অধীনে কিছু উন্নয়নশীল দেশ স্বাধীনতার প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি এবং আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ প্রদর্শন করে চীনের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার পথ বেছে নিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা ।
বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন যে, বিশেষ করে চীনের প্রস্তাবিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে উন্নয়নশীল দেশগুলি চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ উন্নয়ন সহযোগিতা ভাগ করে নিয়েছে। একইসঙ্গে চীনের সাথে সহযোগিতা এই দেশগুলির উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়াকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নীত করেছে। তাই, এই দেশগুলো চীনের সক্রিয় কূটনীতির প্রতি দৃঢ় সখ্যতা দেখিয়েছে। এই দেশগুলি তাদের নিজস্ব কর্ম এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে মার্কিন হস্তক্ষেপ এবং চীনের প্রকৃত অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গিনি-বিসাউ প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট উমারো সিসোকো এমবালো, থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারিস সাঙ্গিয়াম্পংসা, বেলারুশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাকসিম রাইজেনকভ, ভানুয়াতু প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী শার্লট সালওয়াই, সলোমন দ্বীপপুঞ্জের প্রধানমন্ত্রী জেরেমিয়া মানেলে এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সপ্তাহে চীন সফর করছেন। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান সোমবার চীন সফর করেছেন।
পারস্পরিক বন্ধন
চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হান ঝেং মঙ্গলবার থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মারিস সাঙ্গিয়াম্পংসার সাথে সাক্ষাত করে বলেন যে, পারস্পরিক আদানপ্রদান দৃঢ় করতে চীন থাইল্যান্ডের সাথে কাজ করতে প্রস্তুত। চীনের লক্ষ্য ব্যবহারিক সহযোগিতা, মানুষে মানুষে সাংস্কৃতিক বিনিময় বৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রচার। হান বলেন, চীন উচ্চ মানের বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতার অগ্রগতির জন্য থাইল্যান্ডের সাথে হাত মেলাতে ইচ্ছুক। সোমবার চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে পৌঁছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার একটি বিজনেস ফোরামে যোগ দেন। বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যম ডেইলি স্টার মঙ্গলবার জানিয়েছে, তিনি চীনের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে বাংলাদেশে অবকাঠামো, জ্বালানি ও লজিস্টিকসের মতো খাতে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন। শেখ হাসিনার সফরের কথা তুলে ধরার সময়, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর তার নতুন মেয়াদ শুরু হওয়ার এবং শেষ চীন সফরের পাঁচ বছর পর প্রথম সফর। মাও বলেন, 'চীন ও বাংলাদেশ ভালো প্রতিবেশী, ভালো বন্ধু এবং ভালো অংশীদার। উন্নয়নের জন্য আমাদের একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি এবং সুসংহত উন্নয়ন কৌশল রয়েছে।'
চীনের এক মুখপাত্র উল্লেখ করেছেন , ‘৪৯ বছর আগে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে, দুই দেশ একে অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছে। পারস্পরিকভাবে সহযোগিতায় নিযুক্ত রয়েছে, নিজ নিজ মূল স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ে একে অপরকে সমর্থন করেছে এবং যৌথভাবে আধুনিকীকরণ করেছে। আমরা উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতার একটি ভাল উদাহরণ স্থাপন করেছি’। চায়না ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ইয়াং জিউ গ্লোবাল টাইমসকে জানিয়েছেন,' চীন বিভিন্ন সামাজিক ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক পটভূমি, উন্নয়নে আগ্রহী এমন দেশগুলির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এটি প্রমাণ করে যে, চীন শক্তিশালী সংযোগ তৈরি করতে পারে এবং একটি উন্মুক্ত অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে।' জিউ বলেন, 'এটি চীনা কূটনীতির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্যও প্রতিফলিত করে: বৈশ্বিক উন্মুক্ততা এবং অন্তর্ভুক্তিকে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে দ্বিপাক্ষিক কূটনীতিকে শক্তিশালী করা।'
সোমবার চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের সঙ্গে এক বৈঠকে বেলারুশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাকসিম রাইজেনকভ বলেন, বেলারুশ চীনের প্রস্তাবিত বৈশ্বিক উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় গভীরভাবে অংশগ্রহণ করে এবং যৌথভাবে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বহুপাক্ষিকতাকে মেনে চলে।
এছাড়াও, কিছু বিশেষজ্ঞ আশা করেছিলেন যে, ভানুয়াতু এবং সলোমন দ্বীপপুঞ্জের নেতাদের সফরগুলি চীন এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপের দেশগুলির (পিআইসি) মধ্যে সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে, কারণ এই অঞ্চলে সহযোগিতার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। চীন পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লি হাইডং গ্লোবাল টাইমসকে বলেছেন -'গ্লোবাল সাউথ দেশগুলির সাথে চীনের সহযোগিতা শুধুমাত্র মৌখিক প্রতিশ্রুতি নয়, ব্যবহারিক এবং কার্যকর ফলাফলের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। '
লি বলেন, চীনের কূটনীতি বহুমুখী এবং বিস্তৃত অঞ্চলে এর ব্যাপ্তি । চীনের কূটনৈতিক সম্পৃক্ততার সুযোগ বিস্তৃত। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, মার্কিন নীতি দ্বারা বিরক্ত কিছু উন্নয়নশীল দেশ চীনের সাথে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাস্তব ফলাফলের বিষয়টি স্বীকার করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের তথাকথিত ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কথা উল্লেখ করে চাপ বাড়াচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, মার্চ মাসে, পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড্যানিয়েল ক্রিটেনব্রিঙ্ক সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটিকে বলেছিলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে এই অঞ্চলে পরিকল্পিত চারটি নতুন দূতাবাসের মধ্যে দুটি খুলেছে । সিনেট কমিটির র্যাঙ্কিং সদস্য, রিপাবলিকান জেমস রিশ বলেছেন, 'প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে ওয়াশিংটন চীনা প্রভাবের বিরুদ্ধে আমাদের কূটনীতিকদের ময়দানে নামাতে বিলম্ব করেছে। '
দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের এই উন্নয়নশীল দেশগুলির উপর মার্কিন চাপ বিদ্যমান। বেইজিং ফরেন স্টাডিজ ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস অ্যান্ড ডিপ্লোমেসির একজন অধ্যাপক সং ওয়েই গ্লোবাল টাইমসকে বলেছেন, ‘ ভূ-রাজনৈতিক এবং শীতল যুদ্ধের মানসিকতার উপর ভিত্তি করে মার্কিন পক্ষ নেওয়ার আহ্বান জানানো সত্ত্বেও প্রশান্ত মহাসাগরের এই দেশগুলির সাথে চীনের সহযোগিতা বাস্তব উন্নয়নের দিকটি প্রতিফলিত করে। যা সকলের কাছে স্পষ্ট’। ওয়েই - এর মতে , 'তাদের নিজস্ব উন্নয়ন কৌশলের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই দেশগুলি চীনের সাথে তাদের উন্নয়ন সহযোগিতা জোরদার করা, চীনের দ্রুত উন্নয়নের ফলে উদ্ভূত সুযোগগুলি ভাগ করে নেওয়া এবং চীনের উন্নয়ন অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।'
অরবানের বেইজিং সফরের বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন যে, ইউক্রেন সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের জন্য হাঙ্গেরির গঠনমূলক প্রচেষ্টাকে চীন প্রশংসা করে। লিন বলেন, 'সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চীন তার নিজস্ব উপায়ে শান্তি ও আলোচনার প্রচার চালিয়ে যাবে, গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে। '
বিপরীতে যা চলছে
চীন যখন এই সপ্তাহে উন্নয়নশীল দেশগুলির এই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আতিথেয়তা করছে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২৪ সালের ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনকে ব্যবহার করছে রাশিয়া এবং চীনের হুমকিকে ঠেকাতে। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে ছোট ছোট চক্র গঠনের প্রচেষ্টা বাড়াচ্ছে। কিছু বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে, বেইজিংয়ের উন্মুক্ত অংশীদারিত্বের আকাঙ্ক্ষা ওয়াশিংটন-নেতৃত্বাধীন ব্লকে তীব্র বৈপরীত্যর সূচনা করেছে , যা বিশ্বজুড়ে বিভাজন, অশান্তি এবং সংঘাতের বীজ বপন করেছে। ন্যাটো তার চারটি ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ অংশীদারদের সাথে সম্পর্ক গভীর করতে প্রস্তুত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় জোট, এশিয়ান জোট এবং বিশ্বব্যাপী অন্যান্য অংশীদারদের মধ্যে সমস্ত বাধা বিপত্তি কাটিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছে। লি বলেছেন, ‘চীনের কূটনৈতিক কার্যকলাপ দেখায় যে আমরা ব্লক সংঘর্ষের বিরোধিতা করি। আমরা বিশ্বব্যাপী সমস্ত দেশের সার্বভৌম সমতার নীতি অনুশীলনের উদ্দেশে কাজ করে যাচ্ছি। অন্যদিকে, ন্যাটো একটি সামরিক জোট বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে মার্কিন আধিপত্য বজায় রেখে বৈশ্বিক বিষয়ে পশ্চিমের প্রভাবশালী ভূমিকাকে সমর্থন করে।’
লি- এর মতে , চীনের কূটনৈতিক দর্শন এবং অনুশীলনগুলি ন্যাটোর থেকে মৌলিকভাবে আলাদা। ন্যাটো যখন বিশ্বে বিভাজন, অশান্তি, সংঘাত এবং যুদ্ধর ক্ষেত্র প্রস্তুত করে তখন চীনের লক্ষ্য, দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা, অবিভাজ্যতা এবং শেষ পর্যন্ত মানবজাতির জন্য একটি নিরাপদ ভবিষ্যত।
সূত্র : গ্লোবাল টাইমস