ঢাকা, ৩ জুলাই ২০২৪, বুধবার, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৬ জিলহজ্জ ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

যখন-তখন কলড্রপ ভোগান্তি

কাজী সোহাগ
৩০ জুন ২০২৪, রবিবারmzamin

কলড্রপ নিয়ে চলছে ইঁদুর-বিড়াল খেলা। মোবাইলে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই কেটে যাচ্ছে কল। আবার নতুন করে সংযোগ নিতে হচ্ছে গ্রাহকদের। এতে ঠিকই টাকা কাটছে অপারেটররা। অথচ ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। এ অভিযোগ নতুন নয়। প্রতিদিনি হাজার হাজার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে গ্রাহকদের পক্ষ থেকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে নানা মাধ্যমে গ্রাহকরা তাদের অসন্তুষ্টির কথা জানাচ্ছেন।

প্রথমদিকে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসিতে) অভিযোগ জানালেও এখন তা কমেছে। কারণ বিটিআরসি এ বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা নিতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। উল্টো অভিযোগ আছে বিটিআরসি গ্রাহক সেবার বিষয়টি পাত্তা না দিয়ে মোবাইল অপারেটরদের স্বার্থ সংরক্ষণ করছেন।

বিজ্ঞাপন
বিপরীত ভূমিকা পালন করছে মোবাইল অপারেটররা। কলড্রপের জন্য ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে অপারেটরদের কাছে জানতে চাইলে তাদের দাবি কলড্রপের সংখ্যা আগের তুলনায় কমেছে। কিন্তু কতটা কমেছে এ নিয়ে তারা স্পষ্ট কোনো তথ্য দেন না। উল্টো আন্তর্জাতিক নিয়মের কথা তুলে ধরেন। তারা বলেন, আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) স্বীকৃত কলড্রপের হার ৩ শতাংশ বা এর নিচে হতে হবে।

বাংলাদেশে এই হার অনেক কম। অপারেটরদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিটিআরসিও একই তথ্য জানিয়ে আসছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। গ্রাহকরা এই কলড্রপ নিয়ে রীতিমতো অতিষ্ঠ। সম্প্রতি বিটিআরসি আয়োজিত গণশুনানিতে অর্ধেকের বেশি গ্রাহক এই কলড্রপ নিয়ে সরাসরি সংশ্লিষ্টদের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেননি। সম্প্রতি বিটিআরসি প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে জানিয়েছে, ১২ মাসে ৫২ দশমিক ৫৯ কোটিবার কল কেটে যাওয়ার (কল ড্রপ) শিকার হয়েছেন দেশের মোবাইল ফোন গ্রাহকরা। এতে মোবাইল ফোনের গ্রাহকদের প্রায় ১৮ দশমিক ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। কল ড্রপ তখনই ঘটে যখন কোনো মোবাইল ফোন অপারেটরের সিগন্যাল দুর্বল থাকে। বিটিআরসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অপারেটররা প্রতি তিন থেকে সাত মিনিটের কল ড্রপের জন্য গ্রাহককে এক মিনিট ফ্রি টকটাইম দিচ্ছেন। সে হিসেবে গ্রাহকের টাকার মাত্র ২২ শতাংশ পরিশোধ করেছে মোবাইল ফোন অপারেটররা। এর মানে হলো ৫২ দশমিক ৫৯ কোটিবার কল ড্রপের জন্য মাত্র ১১ দশমিক ৬৬ কোটি মিনিট গ্রাহককে ফ্রি টকটাইম দিয়েছেন তারা। এতে গ্রাহকের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৮ দশমিক ৪২ কোটি টাকা। যদি প্রতি মিনিটের সর্বনিম্ন্ন কলচার্জ ০.৪৫ পয়সা ধরা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রাহকরা একই নেটওয়ার্কে ৩৭ দশমিক ৬ কোটি মিনিট কল ড্রপের শিকার হয়েছেন, যা অন-নেট কল নামে পরিচিত। এবং অন্যান্য নেটওয়ার্কে ১৪ দশমিক ৯৯ কোটি মিনিট, যা অফ-নেট কল নামে পরিচিত। প্রতিবেদন অনুসারে, অপারেটররা গ্রাহকদের অন-নেট কলের জন্য শুধুমাত্র কল ড্রপের অর্থ পরিশোধ করেছেন। বছরে মোবাইল ফোন অপারেটরদের বিরুদ্ধে গ্রাহকরা প্রায় ৪০ হাজার অভিযোগ করেছেন বিটিআরসিতে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি ভয়েস কল ও মোবাইল ইন্টারনেট সেবা নিয়ে।

২০২১ সালে বিটিআরসিতে ২৩ হাজার ১৬টি অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে নেটওয়ার্ক কাভারেজ নিয়ে ৪ হাজার ৫২৩টি অভিযোগ এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। আর ২০২২ সালে অভিযোগ জমা হয়েছে ১৫ হাজার ৭৪৯টি। গত বছরের নেটওয়ার্ক কাভারেজ নিয়ে ১ হাজার ৬২২টি অভিযোগের এখনো সমাধান মেলেনি। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃত অভিযোগের পরিমাণ এই সংখ্যার কয়েকগুণ বেশি। কারণ প্রায় সব গ্রাহকই প্রায় দিনই মোবাইল সেবা নিয়ে কোনো না কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন। এদিকে কলড্রপের পাশাপাশি নতুন করে যুক্ত হয়েছে ডাটা কলড্রপ। অর্থাৎ কেউ ইন্টারনেট ব্যবহার করে হোয়াটসআ্যাপ, ইমো, মেসেঞ্জার বা অন্য কোনো যোগাযোগ মাধ্যমে কথা বলার সময় হঠাৎ করে লাইন কেটে যায়। এসব প্রসঙ্গে বাংলাদেশে মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশন এর সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, ভয়েসে কলড্রপের যন্ত্রণায় গ্রাহক যখন একেবারে অতিষ্ঠ তার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ডাটা কলড্রপ।

২০১৮ সালের ১০ই ডিসেম্বর কলড্রপ এর ক্ষতিপূরণ নেটওয়ার্কের মান এবং মূল্য নির্ধারণে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে এডভোকেট ইসরাত হাসানের মাধ্যমে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়। কিন্তু যথাযথ উত্তর না পাওয়ায় আমরা মহামান্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করি। মহামান্য হাইকোর্ট বেশকিছু যুগান্তকারী নির্দেশনা প্রদান করে। কলড্রপের ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহককে মেসেজ দিয়ে জানাতে হবে যে আপনার একটি কলড্রপ হয়েছে এবং তার প্রেক্ষিতে আপনাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ এক মিনিট বা নির্ধারিত সময় টকটাইম আপনার ব্যালেন্সে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। প্রথম কয়েকদিন গ্রাহকদের জানালেও এখন আর কলড্রপের মেসেজ বা ক্ষতিপূরণ অপারেটর প্রদান করে না। তিনি বলেন, এর অন্যতম কারণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি গ্রাহক অধিকার এর ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

বিটিআরসি গ্রাহক অধিকার রক্ষায় খুব একটা যত্নবান না। যতটা না তারা রেভিনিউ ভাগাভাগি করার ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। মান নিয়ন্ত্রণে বা মান পর্যবেক্ষণে তাদের কোনো পর্যবেক্ষণে কোনো ডিভিশন সার্বক্ষণিক কাজ করে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যতদিন যাচ্ছে ততই ভয়েস কলের ক্ষেত্রে মান খারাপ হচ্ছে। তার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ডাটা কলের ক্ষেত্রেও কলড্রপ। আর মিউট কলের কথা তো বলে শেষ করা যাবে না। এটি অন্য আরেকটি বড় ব্যাধি টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে। বিটিআরসি’র সার্বক্ষণিক অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টা একটি অপারেশন টিম এবং একটি ল্যাব থাকা উচিত যেখানে প্রত্যেকটি সেকেন্ড প্রত্যেকটি কলের মান দেখভাল করা হবে এবং অফিস খোলার সঙ্গে সঙ্গে অপারেটরকে নোটিশ করা হবে। গ্রাহকের ক্ষতিপূরণ প্রদান না করলে সঙ্গে সঙ্গে অপারেটরকে জরিমানার আওতায় আনতে হবে।

যেসব কারণে কলড্রপ: টেলিযোগাযোগ খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, অন্তত চারটি কারণে মোবাইল ফোনে কলড্রপ হয়। এর জন্য শুধু মোবাইল ফোন অপারেটররা দায়ী বা তৃতীয়পক্ষ দায়ী বিষয়টি এমন নয়। কলড্রপের জন্য অনেকগুলো পক্ষই জড়িত। এর মধ্যে চারটি প্রধান কারণ খুঁজে পেয়েছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন মূলত চার কারণে কলড্রপ হয়ে থাকে। এগুলো হলো- ১: মোবাইল অপারেটরদের নেটওয়ার্কের কারণে। এর মধ্যে রয়েছে নেটওয়ার্কের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, নেটওয়ার্কের অপ্রতুলতা, বেতার তরঙ্গের (স্পেকট্রাম) স্বল্পতা এবং অ্যান্টেনা ও রেডিওতে ক্যাবলের কানেকশন দুর্বলতা, ২: মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর কারণে কলড্রপ। ব্যবহারকারীর মোবাইল হ্যান্ডসেটে সমস্যা থাকতে পারে। মোবাইলের হঠাৎ ব্যালেন্স শেষ হয়ে যেতে পারে। মোবাইলের ব্যাটারির চার্জ হঠাৎ শেষ হয়ে যেতে পারে। এসব সমস্যার কারণেও মোবাইলে কলড্রপ হয়ে থাকে। ৩: টেলিকম সেবায় যুক্ত অন্যান্য অবকাঠামো সেবাদাতা কোম্পানি যেমন- এনটিটিএন’র (ভূগর্ভস্থ ক্যাবল সেবা) ফাইবার কাটা গেলে অথবা মানের অবনতি হলে এবং টাওয়ার কোম্পানির সেবার মানে ঘাটতি থাকলে কলড্রপ হতে পারে, ৪: পরিবেশ এবং প্রতিবেশগত অন্যান্য কারণ। গুরুত্বপূর্ণ স্থান, সরকারি অফিস ও স্থাপনায় সাইট স্থাপনের (টাওয়ার) অনুমতি না পাওয়া, সীমান্ত এলাকায় সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী নেটওয়ার্ক সীমিতকরণের কারণে, মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনায় অবৈধ জ্যামার ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট ইন্টারফেয়ারেন্স, অনুমোদনহীন রিপিটার, বুস্টার ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট ইন্টারফেয়ারেন্স, শহর এলাকায় নতুন নতুন সুউচ্চ ভবনের কারণে নতুন নতুন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়া, ইনডোর বিল্ডিং সলিউশনের (আইবিএস) বসানোর যথাযথ অনুমতি না পাওয়া এবং বাড়িমালিকরা সাইট বা টাওয়ার সরিয়ে ফেলার জন্য ক্রমাগত চাপ দেয়ায় এবং নতুন সাইটের অনুমোদন না পাওয়ায় সৃষ্ট সমস্যার কারণে মোবাইলে কলড্রপ হতে পারে।

মোবাইল অপারেটরদের শীর্ষ কর্মকর্তারা মানবজমিনকে বলেন, টেলিযোগাযোগের মতো ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কে কলড্রপ খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। আমাদের মোট কলড্রপের হার মোট কলের ১ শতংশেরও কম। তবে আমরা মনে করি, কলড্রপের পরিমাণ আরও কমাতে হলে টেলিযোগাযোগ সেবার মৌলিক বিষয় ও বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। স্বীকার করে তারা জানান, মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির ধরনটাই (নেচার) এমন যেখানে শতভাগ কলড্রপ মুক্ত সেবা দেয়া সম্ভব নয়।

 

 

 

 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status