প্রথম পাতা
সরজমিন
সিলেটে দীর্ঘস্থায়ী বিপর্যয়ের শঙ্কা
ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে
২১ জুন ২০২৪, শুক্রবার
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে বন্যায় চরম দুর্ভোগ। ছবি: মাহমুদ হোসেন
ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যের পানির বেসিন হচ্ছে সিলেট। ওই দু’রাজ্যে টানা বৃষ্টিপাত হলেই ডুবে যায় সিলেট। এই অবস্থা যুগ যুগ ধরে বিদ্যমান। এ দু’রাজ্যের পানি অপসারণের বিকল্প কোনো পথ নেই। ফলে বছর বছর বৃষ্টির মৌসুমে ডুবছেই সিলেট। এবার সিলেট অঞ্চলে প্রথম দফা উজানের ঢল আঘাত হেনেছিল ২৭শে মে। এই ঢলে তলিয়ে গিয়েছিল সিলেট। নতুন করে ১৭ই জুন থেকে ঢল এসেছে। এই ঢলে দ্বিতীয় দফা বিপর্যয় ঘটেছে। এখন সিলেট জেলার অর্ধেক পানির নিচে। প্রায় ১২ লাখ লোক পানিবন্দি। এবারের বিপর্যয় সহসাই কাটার সম্ভাবনা নেই। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে; সিলেট ও মেঘালয়ের উপরে মেঘমালা রয়েছে। আরও কয়েকদিন বৃষ্টি ঝরবে এ অঞ্চলে। আর বৃষ্টি ঝরলেই পানি বাড়বে। আবহাওয়াবিদদের মতে; স্থানীয় বৃষ্টিপাতে সিলেটের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয় না। উজানের ঢলই মূলত বিপর্যয়ের কারণ। পরিবেশবাদীরা জানিয়েছেন- সিলেট অঞ্চল দিয়ে যেসব নদী প্রবাহিত হয়েছে তার উৎপত্তি পাহাড়ি অঞ্চল থেকে। ফলে এসব নদ-নদীর মুখে বাঁধ বা ড্যাম আছে। বৃষ্টির মৌসুমে এসব বাঁধ বা ড্যাম খুলে দেয়া হলে প্রবল বেগে সিলেটে পানি ঢুকে। এটি এবারো ঘটেছে। জৈন্তাপুরের সারি নদীর উজানে রয়েছে লেসকা মাইন্ডু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। আর কোম্পানীগঞ্জের ধলাইয়ের উপর রয়েছে উমিও হাইড্রো ইলেক্ট্রিক প্রজেক্ট। জাফলংয়ের উজানে উমঘট নদীতে এখনো কোনো প্রকল্প হয়নি। বাস্তবতা হচ্ছে; গোটা মেঘালয় রাজ্যই হচ্ছে পাহাড়বেষ্টিত। শত শত মাইলের পাহাড় আর পাহাড়। বিশে^র সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি। সুতরাং বৃষ্টি হচ্ছে। আর এই বৃষ্টির পানি খুব দ্রুতই বাংলাদেশের সিলেটে নেমে আসে। কিছু অংশ নামে আসামের গৌহাটি ও করিমগঞ্জ এলাকা দিয়ে। যেদিকে পানিই নামুক সেটি অপসারণের একমাত্র স্থানই হচ্ছে সিলেট। সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় এই বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। সিলেটকে এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে সরকারের পলিসি লেভেলে নানা চিন্তাভাবনা চলছে। সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী প্রথমে সিলেট নগরকে রক্ষায় ২০ কিলোমিটার সুরমা নদী খননের জন্য একটি প্রকল্প পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু গতকাল মেয়র জানিয়েছেন; এই প্রকল্প দিয়েও তেমন লাভ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাতের ফলে কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাটের পানি এসে সিলেট নগরে প্রবেশ করে। এখন এই দুই এলাকা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। এ ছাড়া; সারি ও সুরমার পানি তো আছেই। এসব বিষয় নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। ২০২২ সালে সিলেটে প্রলয়ঙ্করী বন্যা হয়েছিল। এর আগে ২০০৪ সালে এর চেয়ে বেশি বন্যা হয়। এসব বন্যা নিয়ে চিন্তিত সিলেটের মানুষ। ‘সেইভ দ্যা হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’র সিলেটের সভাপতি আব্দুল হাই আল হাদী মনে করেন- সিলেট অঞ্চলে বন্যা দূর করতে হলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখতে হবে। যেমনি ভাবে পরিবেশ ঠিক রাখতে হবে তেমনি করে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। নদী যদি পানি ধারণ না করতে পারে তাহলে বন্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়। পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি বলেন- ভারতের মেঘালয়ের একমাত্র বেসিন হচ্ছে সিলেট। সুতরাং যখন পানি আসে তখন তীব্র বেগেই আসে। এবার মেঘালয়ে ১৫১ ভাগ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে জানান তিনি। বন্যাকবলিত সিলেট গতকাল পরিদর্শন করেছেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শনের পর তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
এ সময় প্রতিমন্ত্রী বলেছেন- উজান থেকে পানির সঙ্গে প্রতি বছর দেড় বিলিয়ন পলিমাটি আসে। এসব পলিমাটি সিলেট অঞ্চলের নদ-নদীর তলদেশকে ভরিয়ে দিচ্ছে। সুতরাং একবার সুরমা কিংবা অন্যান্য নদী খনন করলে হবে না। এর জন্য প্রতি বছরই নদী খনন করতে হবে। তিনি জানান- সিলেটের নদী খননের প্রকল্প নিয়ে ব্যাপক আকারে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। সিলেটের মেয়র মাসখানেক আগে যে প্রকল্প জমা দিয়েছিলেন সেটি এখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আছে। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর মতে; পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে না পারলে সহসাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। এর জন্য বছর বছর ড্রেজিং করে নদীর নাব্যতা স্বাভাবিক রাখতে হবে। সিলেট নগরকে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ সহ নানা প্রকল্পের চিন্তা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নুর আজিজুর রহমান জানিয়েছেন- শুধু সুরমা নদী খনন করলেই হবে না; ছড়া বা খালের উপর স্লুইচ গেইট নির্মাণ করতে হবে। একই সঙ্গে নগর জুড়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে। এই বেড়িবাঁধই হবে বন্যার প্রটেকশন।
তিনি জানান- এবার নতুন করে দেখা গেছে; বিমানবন্দর সড়ক দিয়ে নগরের উঁচু অংশ ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডে পানি ঢুকে। সিলেট-এয়ারপোর্ট সড়কের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। কারণ; মেঘালয় ও আসামের পানি দু’দিক থেকে সিলেট জেলা ও নগরকে ডুবিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এসব নিয়ে সরকারের পলিসি পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। এদিকে; ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি কিছুটা কমলেও এখনো দু’টি নদীর ছয়টি পয়েন্টের পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বাড়িঘরে টিকতে না পেরে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে মানুষ। জেলা প্রশাসনের হিসাবে সিলেট জেলায় প্রায় নয় লাখ ৫৮ হাজার মানুষ পানিবন্দি। বাড়িঘরে পানি উঠে পড়ায় আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছেন প্রায় ২২ হাজার মানুষ। বৃহস্পতিবার বিকালে ১৩ উপজেলা ও সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ অবস্থা জানিয়েছে সিলেট জেলা প্রশাসন। জেলার ৬৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ৭৮৬ জন আশ্রয় নিয়েছেন।
জেলায় বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন ৯ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪৮ জন। এর মধ্যে ওসমানীনগরে ১ লাখ ৮৫ হাজার ও গোয়াইনঘাটে ১ লাখ ৪৫ হাজার ২০০ মানুষের অবস্থা বেশি খারাপ। জেলার ১৫৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৩০টি ইউনিয়নের ১ হাজার ৬০২টি গ্রাম বন্যায় প্লাবিত। আর সিটি করপোরেশনের ২৩টি ওয়ার্ডে বন্যাকবলিত মানুষের সংখ্যা ৫৫ হাজার। বন্যাকবলিত অনেক এলাকায় উদ্ধার বা ত্রাণ সহায়তা যাচ্ছে না এমন অভিযোগ রয়েছে অনেকের। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের জন্য ২৮ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে এবং ৬০০ টন চাল দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে উদ্ধার তৎপরতা চালানো হচ্ছে। সিলেট আবহাওয়া অফিস বলছে, সিলেটে গত ২৪ ঘণ্টায় ১১০ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে আর সকাল ৬টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ২০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। তবে আগামী ৭২ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
পাঠকের মতামত
সূত্র : আজকের পত্রিকা ১২ / ১১ / ২০২৩ আবু তাহের খান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গত ৩০ অক্টোবর ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং বিশ্বব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত জ্বালানি ব্যবহারসংক্রান্ত দুদিনব্যাপী এক সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে বলেছেন, ‘হাওর এলাকায় আর কোনো সড়ক নির্মাণ করা হবে না’ (আজকের পত্রিকা, ৩১ অক্টোবর ২০২৩)। পরিকল্পনামন্ত্রীর এ বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করার আগে এ-সংক্রান্ত কিছু তথ্য সামনে আনা যেতে পারে বলে মনে করি, যার প্রথমটি হচ্ছে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কসংক্রান্ত। ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল তৎকালীন রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ উক্ত সড়কের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের সাড়ে চার বছরের কম সময়ের ব্যবধানে এবং নির্ধারিত সময়ের কয়েক মাস আগে ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর উক্ত সড়কের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মোট ৮৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ২৯ দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কের উদ্বোধনকালে বলা হয়েছিল, এর মধ্য দিয়ে হাওরাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হলো। এখন প্রশ্ন দুটি: এক. ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণের মধ্য দিয়ে ওই এলাকার সাধারণ মানুষের লালিত স্বপ্ন আসলেই পূরণ হয়েছে কি না; এবং দুই. অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ কেনই-বা হাওরে সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিলেন? প্রথম প্রশ্নের উত্তর পেতে প্রথমেই জানা দরকার, ওই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের যাতায়াতের কষ্ট লাঘবের জন্য আসলে কী ধরনের রাষ্ট্রীয় সহায়তা প্রয়োজন। জবাবে বলব, তাদের সাধারণ প্রত্যাশা হচ্ছে বিদ্যমান সেকেলে নৌযানব্যবস্থার বিপরীতে একটি মোটরযানচালিত আধুনিক যোগাযোগ অবকাঠামো। তা সেটি সড়ক, সেতু, নাকি টানেল—সেটি মুখ্য বিবেচ্য নয়। সে ক্ষেত্রে এর মধ্যে কোনটি ওই অঞ্চলের জন্য উপযুক্ত, তা নির্ধারণের দায়িত্ব ছিল সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ যে এ ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, তা এরই মধ্যে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আরও প্রমাণিত হয়েছে, হাওর অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি ও জলাভূমির গঠন বিবেচনায় সেখানে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণ একেবারেই সমীচীন হয়নি। আর তাই এ নিয়ে উক্ত সড়ক উদ্বোধনের আড়াই বছর পেরোতে না পেরোতেই পরিকল্পনামন্ত্রী এই বলে হতাশা ব্যক্ত করলেন যে ‘এখন টের পাচ্ছি, হাওরে সড়ক নির্মাণ করে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছি। হাওরে সড়ক বানিয়ে উপকারের চেয়ে অপকারই হয়েছে।’ (প্রথম আলো, ২০ মে ২০২৩) এবার দ্বিতীয় প্রশ্নের অর্থাৎ অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ কেন হাওরে সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সে জিজ্ঞাসার জবাব খোঁজার চেষ্টা। হাওর অঞ্চলের পশ্চাৎপদ যোগাযোগব্যবস্থার অন্যতম ভুক্তভোগী হিসেবে তাঁর কাছে হয়তো মনে হয়েছিল, সড়ক নির্মাণই হচ্ছে এর সমাধান এবং সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় দপ্তরকে তিনি হয়তো তেমনটিই বলেছিলেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় দপ্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করে তৎকালীন রাষ্ট্রপতিকে তখন বলা দরকার ছিল যে ওই এলাকার ভূপ্রাকৃতিক গঠন ও পরিবেশের বিবেচনায় সেখানে সড়ক নির্মাণ করাটা সমীচীন হবে না; বরং তার পরিবর্তে দীর্ঘ সেতু বা বিকল্প কোনো ব্যবস্থার কথা ভাবা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ সে পথে না হেঁটে ‘রাষ্ট্রপতি চেয়েছেন’ এটাকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করে এগিয়েছে, যেটি বাংলাদেশের মুৎসুদ্দি আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতির একটি ঘৃণ্য ত্রুটিপূর্ণ দিক। যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাইপূর্বক তার ফলাফলের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতিকে যদি বুঝিয়ে বলা যেত, ওখানে সড়ক নির্মাণ করাটা সমীচীন হবে না বা তার পরিবর্তে বিকল্প উপায়ের কথা তাঁরা বলতেন, তাহলে নিশ্চয় তিনি মেনে নিতেন। কিন্তু এ দেশের চাটুকার আমলারা প্রায় কখনোই তা করেন না। এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকভাবেই কয়েকটি প্রশ্ন সামনে আসে। ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণের আগে সত্যি কি যথাযথভাবে এর সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল? হয়ে থাকলে তা যাচাইয়ে কেন এটি ধরা পড়ল না যে এ ধরনের সড়ক নির্মাণ করা হলে সেই অঞ্চলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হবে, নতুন করে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে এবং সামগ্রিক পরিবেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এর মানে হচ্ছে, সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজটি যথাযথভাবে হয়নি, যেমনটি এ দেশের অধিকাংশ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে হয় না। সাম্প্রতিক সময়ে সরকার কর্তৃক যেসব উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, বলাই যায়, এগুলোর বেশির ভাগই উপযুক্ত সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই রাজনৈতিক ও অন্যান্য বিবেচনায় গ্রহণ করা হয়েছে। আর এসব বিবেচনার মধ্যে অন্তত একটি হচ্ছে বেশি বেশি নির্মাণকাজের সঙ্গে কার্যাদেশদাতা ও কার্যাদেশ লাভকারী—উভয় পক্ষের বেশি বেশি যুক্ত থাকতে পারার আনন্দ। আর এটি যে কত বেশি সত্য, তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ হচ্ছে নানা প্রতিষ্ঠানের আওতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা বহুসংখ্যক বহুতল ভবন ও অন্যান্য স্থাপনা অব্যবহৃত পড়ে থাকা। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে গড়ে ওঠা এমন কয়েকটি উড়ালসড়ক সম্প্রতি নির্মাণ করা হয়েছে, যেগুলো যানজট নিরসনের পরিবর্তে তা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এবার হাওরের বুক চিরে সড়ক নির্মাণসংক্রান্ত মূল আলোচনায় ফিরে আসা যাক। বাংলাদেশের মতো নিচু ভূমির দেশ ছাড়াও পৃথিবীতে এমন আরও কিছু কিছু দেশ রয়েছে, যেখানে আধুনিক নৌযানব্যবস্থাকে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রধান, জুতসই ও জনপ্রিয় যানবাহন হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। যেমন ইউরোপের নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, লুক্সেমবার্গ, এশিয়ার থাইল্যান্ড ও মালদ্বীপ, আফ্রিকার সেনেগাল, দক্ষিণ আমেরিকার চিলি ইত্যাদি। বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলেও এ ধরনের যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা ভাবা যেতে পারে। বিকল্প হিসেবে দীর্ঘ সেতু নির্মাণের কথা ভাবাটাও সমীচীন বলে মনে হয় না। বঙ্গবন্ধু সেতু বা পদ্মা সেতুর তুলনায় এ ধরনের সেতু তো একেবারেই নস্যি।তবে শেষ পর্যন্ত কী বা কোনটি করা হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত প্রকৃত বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরিচালিত গভীরতাপূর্ণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সম্ভাব্যতা সমীক্ষার ভিত্তিতে—সব বিষয়ে পণ্ডিত আমলা-সদস্যের তাৎক্ষণিক মতামত বা অপরিপক্ব রাজনৈতিক সুপারিশের ভিত্তিতে নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পরিবেশ ও প্রতিবেশকে ধ্বংস করে এরই মধ্যে যেসব সড়ক নির্মিত হয়ে গেছে, সেগুলোর কী হবে? এ প্রশ্নের বস্তুত কোনো জবাব নেই। তবে উত্তম হতো যদি এ সড়কগুলোকে হাতিরঝিলে অবৈধভাবে নির্মিত বিজিএমইএ ভবনের মতো নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু সেটি তো এখন আর সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এই অবস্থায় গত শতাব্দীর ষাটের দশকে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে রাঙামাটির বিস্তীর্ণ এলাকার হাজার হাজার মানুষকে যেমন নবসৃষ্ট কাপ্তাই হ্রদের পানির নিচে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ককেও এখন তেমনটি গণ্য করা যেতে পারে, যা এখন ওই অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের নতুন করে বাড়তি জলাবদ্ধতার কবলে পড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কী অদ্ভুত মিল! রাঙামাটি হাজার হাজার মানুষকে আবাসচ্যুত করে সৃষ্ট কাপ্তাই হ্রদ যেমন এখন লক্ষ পর্যটকের আকর্ষণীয় বিনোদনস্থল, কিশোরগঞ্জ-হবিগঞ্জ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষকে বাড়তি জলাবদ্ধতায় ডুবিয়ে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কও এখন তেমনি আকর্ষণীয় পর্যটনস্থল। আর দুটি ঘটনাই ঘটানো হয়েছে উন্নয়নের নাম করে। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, এমন ঘটনা শুধু কিশোরগঞ্জ-হবিগঞ্জ অঞ্চলেই ঘটেনি। সাম্প্রতিক সময়ে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অসংখ্য জলাভূমির পানির প্রাকৃতিক প্রবাহধারাকে বন্ধ করে দিয়ে সেতু, পার্ক, সরকারি দপ্তর, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিল্প-কারখানা ইত্যাদি নানা স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। এগুলোকে এখন চরম আত্মঘাতী কাজ মনে হলেও তথাকথিত উন্নয়নের তথা বিশেষ শ্রেণি কর্তৃক সম্পদ কুক্ষিগত করার নির্মম প্রয়াস হিসেবে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কীই-বা করার আছে! তবে চরম হতাশার মধ্যেও এই ভেবে সান্ত্বনা খোঁজা যে শেষ পর্যন্ত হাওর অঞ্চলের বাসিন্দা পরিকল্পনামন্ত্রীর বোধোদয় হয়েছে, পরিবেশ ও প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এভাবে দৃষ্টিনন্দন সড়ক নির্মাণ করা একেবারেই ঠিক হয়নি। লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
কোম্পানিগন্জ ও ভোলাগঞ্জে ধলাই নদী সর্ব সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক পাথর ও বালু উত্তোলনের জন্য, এর ফলে নদী নূন্যতম ১০ মিটার গভীর ও ১০০ মিটার প্রসস্থ হবে, ঢলের পানি সহজে হাওরে চলে যাবে, বন্যার ঝুঁকি অনেকটা কমে যাবে, সাথে স্থানীয় মানুষদের রুটি-রুজির বন্দোবস্ত হয়ে যাবে।