শেষের পাতা
‘কমিশন দ্বন্দ্বে’ জটিলতায় ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
স্টাফ রিপোর্টার
১১ জুন ২০২৪, মঙ্গলবারঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে কমিশন নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি করপোরেশন (সিএমসি) ও বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান এপিক সলিউশন। এই দ্বন্দ্ব গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। প্রকল্প সূত্র বলছে, ৬ শতাংশ কমিশন নিয়ে প্রতিষ্ঠান দু’টির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। এই দ্বন্দ্বে প্রকল্পের কাজ নিয়েও জটিলতা তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৃতীয় পক্ষকে কমিশন দেয়ার ফলে একদিকে প্রকল্পের খরচ বেশি হচ্ছে আবার এই বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে প্রকল্পে ধীর গতি তৈরি হতে পারে। এতে বাংলাদেশেরই ক্ষতি।
২০১৫ সালে সিএমসি ও এপিক সলিউশনের সঙ্গে ২ বছরের একটি চুক্তিস্বাক্ষর হয়। ওই চুক্তি অনুযায়ী, সিএমসিকে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কাজ পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করবে এপিক সলিউশন। বিনিময়ে তাদের ৬ শতাংশ কমিশন দিবে সিএমসি। তবে চুক্তির ২ বছর মেয়াদের মধ্যে কাজ পায়নি সিএমসি। এরমধ্যে চুক্তি নবায়ন করাও হয়নি। পরবর্তীতে প্রকল্পের কাজ পেলেও এপিক সলিউশনকে কমিশন দিতে আস্বীকৃতি জানায় সিএমসি। তাদের এই দ্বন্দ্ব এখন দেশের আদালতে গড়িয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠান দু’টির করা ওই চুক্তি অনুযায়ী তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ হলে সেটি চীনের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সালিশ কমিশন নিষ্পত্তি করার কথা।
গত বছর এপিক সলিউশনের স্বত্বাধিকারী শাহেদ রহমান বশির একটি রিট করেন। পরে হাইকোর্ট সিএমসি’র বিল থেকে ৬ শতাংশ কমিউশন রিজার্ভ রাখতে সেতু বিভাগের সচিব ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিবদের নির্দেশ দেন। এরপর সিএমসি হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে। বিষয়টি শুনানি হলে, এই বিষয়ে স্থিতাবস্থা জারি করে আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে বিচারপতি ফারাহ মাহবুবের নেতৃত্বে একটি ভিন্ন হাইকোর্ট বেঞ্চকে দুই মাসের মধ্যে রুল নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেয়া হয়। হাইকোর্টে বিষয়টি নিষ্পতি হওয়া না পর্যন্ত এই স্থিতাবস্থা জারি থাকবে।
প্রকল্প সূত্র বলছে, স্থিতাবস্থা কোন পর্যায়ে দেয়া হয়েছে সেটা বুঝে পদক্ষেপ নিবে সংশ্লিষ্টরা। এজন্য সেটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। জুনের মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। অন্যথায়, আগের রায় অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। তখন এপিক সলিউশনের জন্য ৬ শতাংশ রিজার্ভ রেখে দেয়া হবে। এই অর্থ রিজার্ভ হিসেবে রেখে দিলে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বিলের একটা অংশ পাবে না। এতে তারা কাজ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনাগ্রহ দেখাতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
দুই প্রতিষ্ঠানের কমিশনের দ্বন্দ্বে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শাহাবুদ্দিন খান মানবজমিনকে বলেন, এপিক সলিউশনের ৬ শতাংশ টাকা রিজার্ভ রাখার জন্য আদালত শুরুতে রায় দেন। পরে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে স্থিতাবস্থা জারি করে দুই মাসে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে বলা হয়েছে আপিল বিভাগ থেকে। এই বিষয়টি নিয়ে আমরা চাই দ্রুত সমাধান হোক। আদালত থেকে যে রায় দেয়া হবে আমাদের সেই রায় মানতে হবে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, জি টু জি প্রকল্পে কমিশন বা তৃতীয় পক্ষের আবির্ভাবের নজির এর আগে আমি দেখিনি। কারণ যে দেশের সঙ্গে চুক্তি হয় সেই দেশের সরকারই ঠিকাদার, পরামর্শক নির্ধারণ করে দেয়। সেখানে তৃতীয়পক্ষের আবির্ভাব অস্বাভাবিক। তৃতীয় পক্ষ কোন স্টেজে আবির্ভাব হয়েছে সেগুলো যাচাই-বাছাই করতে হবে। এখন তাদের দ্বন্দ্বের কারণে যদি প্রকল্পে ধীর গতি হয় তাহলে ভারী বিনিয়োগে অর্থনৈতিক রিটার্ন সময়মতো পাবো না। এতে ক্ষতিটা বাংলাদেশের।
তিনি বলেন, ৬ শতাংশ কমিশন প্রকল্পের বড় একটা অংশ। তার মানে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য কাউকে ৬ শতাংশ কমিশন দেয়ার ফলে প্রকল্পে বিনিয়োগ ভারী হচ্ছে। এতে আমাদের প্রকল্প আমরা যে টাকায় বাস্তবায়ন করতে পারতাম তারচেয়ে কিছুটা বেশিতে করা লাগছে।
হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (কাওলা) হতে শুরু হয়ে আব্দুল্লাহপুর, ধউর, আশুলিয়া, বাইপাইল হয়ে ইপিজেড পর্যন্ত নির্মাণ হচ্ছে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। নির্মাণাধীন এক্সপ্রেসওয়েটি ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং এর প্রকল্প ব্যয় ১৭ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা। ২ শতাংশ হার সুদে প্রকল্পের ৮৫ শতাংশ ঋণ দিচ্ছে চীন (এক্সিম ব্যাংক)। যা ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। বাকি ১৫ শতাংশ খরচ বহন করছে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, বর্তমানে প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে হয়েছে ২৬ শতাংশ। আর ২১ কিলোমিটার পর্যন্ত পিয়ার হেড দৃশ্যমান হয়েছে।