শেষের পাতা
টাকা ফেরত পেতে গ্রাহকের হাহাকার
স্টাফ রিপোর্টার
১০ জুন ২০২৪, সোমবার
মোসলেহ উদ্দিন। কাপড় ব্যবসায়ী। থাকেন ঢাকার কামরাঙ্গীরচর এলাকায়। ২০১৮ সালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে ১ কোটি ৭ হাজার টাকা জমা রেখেছিলেন। এক বছর মেয়াদি সঞ্চয়ের মেয়াদ শেষ হয় ২০১৯ সালে। কিন্তু এখনো তিনি সুদ-আসল কিছুই পাননি। ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও মূল আমানত তুলতে হিমশিম খাচ্ছেন। কীভাবে কোন উপায়ে কার কাছে গেলে টাকা ফেরত পাবেন তারও কোনো নিশ্চয়তা মিলছে না। ফলে ৬ বছর ধরেই প্রতিষ্ঠানটির দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন মোসলেহ উদ্দিন। শুধু মোসলেহ উদ্দিনই নয় ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে টাকা রেখে পথে বসেছেন হাজার হাজার আমানতকারী। নগদ অর্থ খুইয়ে মানবেতর দিন পার করছেন ভুক্তভোগীরা। এদের মধ্যে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকও। কেউই কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছে না। অনেকে পেনশনের টাকা রেখেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এদিকে অর্থ লোপাট ও নানা সংকটে পড়ে এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএলএফএসএল)। অর্থ সংকটে থাকা প্রতিষ্ঠানটি ফেরত দিতে পারছে না আমানতকারীদের অর্থ। আমানতের টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় প্রতিদিন প্রতিষ্ঠানটির দুয়ারে ধরনা দিচ্ছেন বিপুলসংখ্যক আমানতকারী।
নজিরবিহীন ঋণ কেলেঙ্কারি আর গ্রাহকের আমানতের টাকা লোপাটের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএলএফএসএল) এখন দেউলিয়া হওয়ার পথে। প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) ছাড়া আরও ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান একেএম শহীদ রেজার নামও রয়েছে। হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে আইএলএফএসএলে নিরপেক্ষ পর্ষদ বসানো হলেও আগেই গ্রাহকের জমানো প্রায় সব টাকা চুষে নিঃশেষ করা হয়েছে। পর্ষদ এখন টাকা ফেরত চাইলে খেলাপিরা উল্টো হুমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আবার কেউ কেউ ঋণের প্রায় পুরো টাকাই মেরে দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। ২০১৮ সাল থেকেই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে আইএলএফএসএল। এর দেয়া মোট ৪ হাজার ১৩০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপিই ৯১ শতাংশ বা ৩ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। জানা গেছে, মাত্র ১২টি প্রতিষ্ঠানই হাতিয়েছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। এর আগে পি কে হালদার একাই প্রতিষ্ঠানটি থেকে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা লুটে নেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সম্প্রতি উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে আইএলএফএসএলে নিরপেক্ষ পর্ষদ বসানো হলেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। এদিকে সামপ্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক এজিএম হাসান মোহাম্মদ তারেক বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস বিভাগে (এফআইসিএসডি) লিখিত অভিযোগ করেছেন। তিনি তার অভিযোগে বলেন, প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মশিউর রহমান এবং মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান জসিম উদ্দিন বিভিন্ন সময় অবৈধভাবে রেপটাইল ফার্ম লিমিটেড এবং আনান কেমিক্যাল লিমিটেডের নামে বিভিন্ন সময়ে বিপুল পরিমাণের অর্থ ছাড় করেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে পর্ষদের অনুমোদন ব্যতীত মো. মশিউর রহমান এবং জসিম উদ্দিনের সিদ্ধান্তে রেপটাইল ফার্ম লিমিটেড এবং আনান কেমিক্যাল লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠানের জন্য ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর হেড অফিসে দুটি সুসজ্জিত কক্ষও বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময় আইএলএফএসএল- এর গাড়ি রেপটাইলস ফার্ম, আনান কেমিক্যাল লিমিটেডের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ৩০শে জুন সময়ে প্রতিষ্ঠানটির আয়ের বিপরীতে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ২ টাকা ৭৬ পয়সা। যা ২০২২ সালের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল ২ টাকা ১১ পয়সা। অর্থাৎ ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান বেড়েছে ৬৫ পয়সা। ২০২২ সালের তুলনায় ১৪ কোটি ৪১ লাখ ৭৬ হাজার ৬৫৯ টাকা লোকসান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯ কোটি ২২ লাখ ৩৩ হাজার ৩৫৬ টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুন সময়ে লোকসান ছিল ৪৬ কোটি ৮০ লাখ ১৯ হাজার ৬১৯ টাকা। টানা চার বছর বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ না দেয়া প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার সংখ্যা ২২ কোটি ১৮ লাখ ১০ হাজার ২৪৬টি। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদ বিনিয়োগকারীদের ২০২২ সালের জন্য কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। ২০২২ হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো লভ্যাংশ না দেয়ার এমন ঘোষণা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ। এদিকে ২০২১ হিসাব বছরেও কোনো লভ্যাংশ দেয়নি কোম্পানিটি। উল্লিখিত সময়ে শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৯ টাকা ২৬ পয়সা (লোকসান)। ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি নেট সম্পদমূল্য (এনএভি) দাঁড়িয়েছে ১৫৪ টাকা ১৯ পয়সা (লোকসান)। এ ছাড়া এ হিসাব বছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নগদ অর্থপ্রবাহ (এনওসিএফপিএস) হয়েছে ৭ টাকা ৪ পয়সা (লোকসান)। এ বিষয়ে জানতে চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হককে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি।
পাঠকের মতামত
যে নৈরাজ্য লুটপাট, অরাজকতা এইদেশটার উপর চলছে মনে হয় অচিরেই এইদেশ একটি অর্থনৈতিক পঙ্গু রাষ্ট্রে পরিণত হবে।