বাংলারজমিন
যেভাবে জাফরের সাম্রাজ্যের পতন
মোহাম্মদ উল্লাহ, চকরিয়া (কক্সবাজার) থেকে
২৪ মে ২০২৪, শুক্রবার
কক্সবাজারের চকরিয়া-পেকুয়ার সাবেক এমপি জাফর আলমের পতনে উপজেলা জুড়ে মিষ্টি বিতরণ করেছে উৎসুক জনতা। বিগত ১৫ বছর এলাকায় তিনি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। শুধু বিএনপি-জামায়াত নয় তার হাত থেকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও সাংবাদিকও রেহাই পাননি। কোনো নেতাকর্মী অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেও সাবেক সংসদ সদস্য জাফরের হয়রানিসহ মারধর ও নির্যাতনের শিকার হতেন। নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন তিনি। সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন থেকে ছিটকে পড়েন তিনি। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিলেও তা মানেননি তিনি। ৭ই জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীকের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন জাফর। দ্বিতীয় দফায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও সাবেক সংসদ সদস্য জাফর আলমকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ফজলুল করিম সাঈদী। এবারেও নির্বাচনের শুরুতে নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেন জাফর আলম।
জানা যায়, ২০১৮ সালের নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জাফর আলম। এমপি হওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। শতাধিক অস্ত্রধারী নিয়ে গড়ে তোলেন জাফর বাহিনী। এই বাহিনী দিয়ে চকরিয়ার চিংড়িজোনে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। তার বাহিনীর নেতৃত্বে চিংড়িঘের দখল, জায়গা জমি দখল, চাঁদাবাজি, গরু চুরি, খাস জমি দখল, চুরি-ডাকাতি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে কাউকে তোয়াক্কা করতেন না। এক সময় জাফর অর্থের অভাবে সংসার চালাতে হিমশিম খেতেন। বর্তমানে তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক। তার রয়েছে গাড়ি-বাড়ি। জাফর একাধিক মার্কেটের মালিক।
এমনকী তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ কাজ করলে তাকে ছাড় দিতেন না। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়েও প্রকাশ্যে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও গালিগালাজ করতেন। কারও সঙ্গে টানা স্থায়ী সম্পর্কও টিকতো না। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, জাফর আলম এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় আওয়ামী লীগ বাদ দিয়ে গড়ে তোলেন ‘জাফর লীগ’। গত পাঁচটি বছর এই জাফর লীগ দিয়ে চকরিয়া-পেকুয়ায় আওয়ামী লীগ নিধন, সাধারণ মানুষের জায়গা জমি-দখল, চিংড়িঘের দখল ও সরকারি জমি দখল, খুন-খারাবিসহ নানা অপকর্ম করতেন। তার পিএস আমিন চৌধুরী, ভাতিজা জিয়াবুল ও ভাগিনা মিজানের নেতৃত্বে শতাধিক ক্যাডার নিয়ে বাহিনী গড়ে তোলেন। এই বাহিনীর হাতে চকরিয়ার রাজপথে ৫ জন বিএনপি-জামায়াতের কর্মী নিহত হয়েছে। চিংড়িজোনের চাষিরা থাকতেন আতঙ্কে। তার বাহিনীকে প্রতি মৎস্য জো’য়ে মাছ ও চাঁদা না দিলে দখল হয়ে যেতো চিংড়ি ঘের। এভাবে চাষিরা চাঁদা দিয়ে মাছ চাষ করেছেন। তার অপকর্মের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল ‘গরু চুরি’। এই বাহিনীর হাতে নিরাপদ ছিল না চকরিয়ার খামারিরা।
এমপি জাফর আলমের ডান হাত হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ চট্টগ্রামের বৃহত্তম গরুচোর সিন্ডিকেটের প্রধান সাহারবিল ইউপি চেয়ারমান নবী হোছাইন। নবী হোছাইনের নেতৃত্বে এ অঞ্চলে গরু চুরি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠেছে।
তাকে দিয়ে উপকূলীয় এলাকায় চিংড়িঘেরে ডাকাতি ও গরু চুরি করানো হতো বলে অভিযোগ রয়েছে জাফর আলমের বিরুদ্ধে। নবী হোছাইন একাধিকবার গ্রেপ্তার বা তার বিরুদ্ধে মামলা হলেও এমপি জাফর আলমের সহযোগিতায় পার পেয়ে যেতো। তার ক্যাডার জিয়াবুল, মিজান, শওকত, আজিম, ও রুবেলের হাতে হামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মাতামুহুরী থানা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি মহসিন বাবুল, সাংগঠনিক সম্পাদক ইকবাল দরবেশি ও উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মারুফ হোসেন। সর্বশেষ হামলার শিকার হন দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার চকরিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি ও চকরিয়া প্রেস ক্লাবের যুগ্ম সধারণ সম্পাদক সাংবাদিক মোহাম্মদ উল্লাহ। সাংবাদিক মোহাম্মদ উল্লাহকে সহযোগিতা করার অপরাধে জাফর আলম সরাসরি প্রাণনাশের হুমকি দেন প্রেস ক্লাবের সভাপতি জাহেদ চৌধুরীকে। ওই সময় সাংবাদিক জাহেদ চৌধুরী চকরিয়ায় সাধারণ ডায়েরিও করেছেন।