প্রথম পাতা
লোকসভা নির্বাচন, নরমে-গরমে প্রথম দিন
সেবন্তী ভট্টাচার্য্য, কলকাতা থেকে
২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবারশুরু হয়ে গেল ভারতের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন। সাত দফা ভোটপর্বের প্রথম দফায় শুক্রবার ২১টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল মিলিয়ে ভোট ছিল ১০২টি আসনে।
প্রথম দফায় ছিল পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার এবং জলপাইগুড়িও। সব থেকে বেশি অশান্তির ছবি দেখা গিয়েছে কোচবিহারে। ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে ভয়ঙ্কর ঘটনার সাক্ষী থেকেছে কোচবিহারের শীতলকুচি। কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল ৪ জনের। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল রাজ্য-রাজনীতি। সেই ঘটনা এখন অতীত। তবুও চোখ বুজলেই সেখানকার মানুষের চোখের সামনে ভেসে ওঠে আতঙ্কের দৃশ্য। ভোট এলে ভয়ও বাড়ে। স্বাভাবিকভাবেই ভোটের মওসুমে শীতলকুচিতে বাড়তি নজর রয়েছে কমিশনের। তা সত্ত্বেও লোকসভা ভোটে উত্তেজনা শীতলকুচি এলাকায়। উঠেছে বুথ জ্যাম, রিগিংয়ের অভিযোগ। নির্বাচন কমিশনেও জমা পড়েছে গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগ। প্রচুর অভিযোগ এসেছে রাজভবনে। নির্বাচন কমিশনে মোট ৩৮৩টি অভিযোগ জমা পড়েছে। তারমধ্যে কোচবিহার থেকে এসেছে ১৭২ অভিযোগ, আলিপুরদুয়ার থেকে এসেছে ১৩৫ অভিযোগ, জলপাইগুড়ি থেকে এসেছে ৭৬টি অভিযোগ। রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ মোট ২৮টি। যার মধ্যে বিজেপি ৯, তৃণমূল ৯ এবং সিপিএম ১টি অভিযোগ জমা করেছে। অভিযোগ, শীতলকুচির বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ভোটারদের হুমকি দিয়েছে তৃণমূল। গেরুয়া শিবিরের এক কর্মীকে হাঁসুয়ার কোপ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। গোঁসাইহাট পঞ্চায়েত এলাকায় এক বিজেপি কর্মীকে বাঁশ ও লাঠি দিয়ে মারধরের অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে। যদিও এই অভিযোগ মানতে নারাজ তৃণমূল। তাদের পালটা দাবি, তাদের কর্মী-সমর্থকদের আক্রমণ করা হচ্ছে। দিনহাটার ১ নম্বর ব্লকের তৃণমূলের ব্লক সভাপতিকে মারধরের অভিযোগ ওঠে। কোচবিহার দক্ষিণ বিধানসভার চান্দামারিতে সংঘর্ষে জড়ায় তৃণমূল-বিজেপি। জখম হন একাধিক। আবার ভেটাগুড়িতে বাড়ির কাছেই আক্রান্ত হন তৃণমূলের ব্লক সভাপতি অনন্ত বর্মণ। উত্তেজনার ছবি ধরা পড়ে জলপাইগুড়ির ডাবগ্রাম ফুলবাড়িতেও। বিজেপি বিধায়ক শিখা চ্যাটার্জির বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি লোক নিয়ে বুথে ঢুকে গণ্ডগোল করছেন। এমনই অভিযোগ ঘাসফুল শিবিরের। অন্যদিকে আবার আলিপুরদুয়ারের তুলসীপাড়া চা বাগানে চারটি বুথে বিজেপি এজেন্টদের বসতে না দেয়ার অভিযোগ করেছেন বিজেপি প্রার্থী মনোজ টিগ্গা।
সকাল থেকে নির্বিঘ্নেই চলছিলো ভোটদান। হঠাৎই ছন্দপতন। বুথের বাইরে মর্মান্তিক মৃত্যু সিপিএম কর্মীর। ধূপগুড়ি ব্লকের বিনয় শা মোড় এলাকায় ১৫/১২৪ নম্বর বুথের বাইরে সিপিএমের অস্থায়ী ক্যাম্পে বসে ছিলেন দলীয় কর্মী প্রদীপ দাস (৫৮)। আচমকাই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। দ্রুত তাকে দলের অন্য কর্মীরা হাসপাতালেও নিয়ে যান। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। হাসপাতালে নিয়ে আসার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। আচমকা কেন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন, আগে থেকে কোনো শারীরিক অসুস্থতা ছিল কিনা সে বিষয়ে স্পষ্টভাবে এখনো কিছু জানা যায়নি। পরিবারের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন স্থানীয় সিপিএম নেতারা। ঘটনার পর কান্নায় ভেঙে পড়ে তার পরিবার। সিপিএম নেতা জয়ন্ত মজুমদার জানান, মর্মান্তিক ঘটনা। দলের বড় ক্ষতি হলো। এদিকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানের আকস্মিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা দেখা দেয় কোচবিহারে। মৃত জওয়ানের নাম নীলেশ কুমার নীলু (৪২)। বিহারের নওয়াদা জেলার বাসিন্দা নীলু কোচবিহারে বেলতলা এলাকায় নির্বাচনী কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। বৃহস্পতিবার রাতে হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার নাক, মুখ দিয়ে রক্তপাত শুরু হয়। এরপর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। দেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে।
একদিকে যখন ভোটের এই চিত্র অন্যদিকে দেখা গেছে চমকপ্রদ আয়োজন। ভোট দিলেই থাকছে ভালোমন্দ আহারের ব্যবস্থা। জলপাইগুড়ির পাহাড়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৭/২০৮/২০৯ নম্বর বুথের ভোটারদের আহারের সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে তৃণমূল সদস্যদের তরফে। সকালের জলখাবারে গরম-গরম লুচি, কাবলিচানা, সঙ্গে পনির দিয়ে সুস্বাদু তরকারি এবং মিষ্টি। সেই সঙ্গে লাঞ্চেও সুস্বাদু মেনু। দুপুরের খাবারে সাদা ভাত, ডাল, ডিমের কারি, শেষ পাতে চাটনি।
এত গেল বাংলার কথা, গোটা দেশের মধ্যে বিশেষ নজর ছিল মণিপুরের দিকে। ক’দিন আগে পর্যন্ত গোষ্ঠী সংঘর্ষে আগুন জ্বলেছে এখানে। এই পরিস্থিতিতে আজ সকালে ২৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ঘিরে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। সেই ভিডিওতে গুলি চালানোর শব্দও পাওয়া গিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, অল্প সময়ের ব্যবধানে দুবার গুলি চলছে। মানুষ চিৎকার করে উঠছে আতঙ্কে। পরে আবার গুলির শব্দ পাওয়া যায়। অনুমান, দুই গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াই চলছিল। তবে এটা পরিষ্কার নয়, ইনার মণিপুর না আউটার মণিপুর কোথায় গুলি চলেছে। মণিপুরের এক কেন্দ্রেই এবার ভোট হচ্ছে দু’দফায়। ইনারপুরে আজই নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলেও আউটার মণিপুরে প্রথম দফায় ভোট করানো হচ্ছে আংশিকভাবে। এই পরিস্থিতিতে চাঞ্চল্য ছড়ায় ওই ভিডিও ঘিরে। পাশাপাশি পূর্ব ইম্ফলের ২টি এবং পশ্চিম ইম্ফলের ৩টি বুথে স্থগিত হয়ে যায় ভোটগ্রহণ পর্ব। পোলিং অফিসার জানিয়েছেন, ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ তুলে বুথে ভাঙচুর করে কয়েকজন দুষ্কৃতি। উত্তেজনা ছড়াতেই ৫টি বুথে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। অন্যদিকে ছত্তীসগড়ের বিজাপুরে ভোট চলাকালীনই বিস্ফোরণ হয়। ডিউটি করতে গিয়ে আহত হন সিআরপিএফ জওয়ান। বিস্ফোরণের পরই আতঙ্ক ছড়ায় এলাকায়। বুথ ছেড়ে পালিয়ে যান ভোটাররা। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, ভোট বুথের কাছে আইইডি বিস্ফোরণ হয়েছে। কোথা থেকে ওই বিস্ফোরক এলো, তা এখনো জানা যায়নি। গোটা ঘটনার তদন্ত শুরু করা হয়েছে।
তামিলনাড়ুর সব আসনেই আজ ভোট ছিল। শুক্রবার সকাল সকাল ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে বুথে পৌঁছে যান দক্ষিণের প্রথমসারির মেগাস্টাররা। ভোরবেলায় বুথে গিয়ে ভোট দিলেন রজনীকান্ত। তারপর ভক্তদের সঙ্গে ছবিও তোলেন। খানিকক্ষণ পর সেই একই বুথে গিয়ে ভোট দিলেন অভিনেতা ধনুষ, অজিথ, বিজয় সেতুপতিও। চেন্নাইয়ের এক বুথে ভোট দেন অভিনেতা কমল হাসান। সস্ত্রীক ভোট দেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিন।
গরম উপেক্ষা করেই আজ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মানুষ শামিল হয়েছিলেন ভোট উৎসবে। ব্যতিক্রম শুধু নাগাল্যান্ড। উত্তর-পূর্বের ওই রাজ্যটির প্রায় ২০টি বিধানসভা এলাকায় ভোটের হার প্রায় শূন্য। কারণ পূর্ব নাগাল্যান্ডের ২০টি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে আলাদা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ফ্রন্টিয়র নাগাল্যান্ড টেরিটরি (FNT) তৈরি করতে হবে এই দাবি জানিয়ে পূর্ব নাগাল্যান্ডের প্রভাবশালী সংগঠন ইস্টার্ন নাগাল্যান্ড পিপলস ফ্রন্ট (ENPO) ওই এলাকায় ভোট বয়কটের ডাক দেয়। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্র ওই আলাদা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা গঠনের বিজ্ঞপ্তি দেয়নি। সেই ক্ষোভেই বৃহস্পতিবার গোটা এলাকায় সম্পূর্ণ শাট ডাউনের দাবি তোলে ENPO। আর তাই ভোটের দিন গোটা পূর্ব নাগাল্যান্ডে ছিল কার্যত বন্ধের ছবি।