প্রথম পাতা
ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ করছে সরকার- সিপিডি
স্টাফ রিপোর্টার
৫ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার
তিন বছরের ব্যবধানে দেশের মানুষের মাথাপিছু ঋণ এক লাখ টাকা থেকে বেড়ে দেড় লাখ টাকা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ এবং তা পরিশোধের বাধ্যবাধকতা ক্রমশ বাড়ছে। এতে সরকারকে অপর্যাপ্ত রাজস্ব আদায়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধের জন্য ক্রমাগত নতুন ঋণ নিতে বাধ্য করছে। গতকাল ‘বাংলাদেশ এক্সটারনাল পাবলিক বরোইংস অ্যান্ড ডেবট সার্ভিসিং ক্যাপাসিটি; আর দেয়ার রিজন ফর কনসার্ন?’- শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব তথ্য দিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সিপিডি ও এশিয়া ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রকৃতপক্ষে আমরা পাবলিক ও পাবলিকলি গ্যারান্টিযুক্ত ঋণের দায়বদ্ধতার একটি বড় অংশ পরিশোধের জন্য আবার ঋণ নিচ্ছি। তাই দ্রুত অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈদেশিক ঋণ এবং ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতার হার বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, গত ২০২৩ সালের জুন শেষে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি বিদেশি ঋণ ছিল ৯৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, যা গত সেপ্টেম্বরে ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। বিদেশি ঋণ-জিডিপি অনুপাত ২১ দশমিক ৬ শতাংশ তুলনামূলকভাবে বেশি না হলেও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মত দেন তিনি। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঋণ পোর্টফোলিওর (ঋণের বিভিন্ন উৎস) গঠন দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। ঋণের শর্তাবলীও আরও কঠোর হচ্ছে। বিশেষ করে জিডিপি, রাজস্ব আয়, রপ্তানি, রেমিটেন্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সঙ্গে তুলনা করলে বৈদেশিক ঋণ ও ঋণ পরিশোধের দায়বদ্ধতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা অর্থনীতিতে উদ্বেগ আকারে দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত বিশ্বের সর্বনিম্নের কাতারে জানিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এর সঙ্গে ঋণ বহনের সক্ষমতা ও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা উদ্বেগ তৈরি করেছে।
অনুষ্ঠানে সিপিডি’র বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, তিন বছর আগে মানুষের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ টাকা। এখন তা দেড় লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, বিগত বছরগুলোতে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের ৭০ শতাংশ নেয়া হয়েছে বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরিতে। ফলে খাতভিত্তিক উন্নয়ন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এসব প্রকল্প থেকে একটি গোষ্ঠী লাভবান হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, গত দেড় দশকে ঋণ করে অনেক মেগা প্রকল্প করেছে সরকার। তা সবার উন্নতিতে কাজে আসেনি। বরং মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার বেড়েছে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। ঋণ বাড়লেও বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি হয়নি। মেগা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিরা বিদেশে টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকতে পরে বলেও সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।
বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রসঙ্গে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, যদি ১০০ শতাংশ ঋণ নিয়ে থাকে তার ৮০ শতাংশ সরকারের আর ২০ শতাংশ ব্যক্তিখাতের। ব্যক্তিখাতের ঋণের অবস্থা কী, কেউ কি বলতে পারবেন। এ টাকা কেউ কেউ বিদেশে নিয়ে গেছেন। কেউ ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করেছেন। এ হিসাবটা কম গুরুত্বপূর্ণ না। তিনি বলেন, সরকার তো দেশের ভেতরেও ঋণ নিচ্ছে। সেই ঋণের পরিমাণ কত? যে ঋণ আমরা বিদেশ থেকে নিই, তার দ্বিগুণ আমরা দেশ থেকে নিই। সরকারের এখন যে ঋণের পরিমাণ তার দুই-তৃতীয়াংশ অভ্যন্তরীণ ঋণ, সেটিই বড় বিষয়। সরকারের দায়-দেনা পরিস্থিতি বুঝতে হলে বৈদেশিক ঋণের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ঋণও দেখতে হবে। বৈদেশিক ঋণের কারণে মাথাপিছু দায়-দেনা যদি ৩১০ ডলার হয়, অভ্যন্তরীণ ঋণ যোগ করলে সেটা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৮৫০ ডলার। তিনি আরও বলেন, ঋণ পরিশোধের ক্যাপাসিটি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, রেভিনিউ বাজেট থেকে উন্নয়ন প্রকল্পকে অর্থায়ন করতে একটা পয়সাও দিতে পারে না। আমরা প্রতারণামূলক বাস্তবতা বা ইউলিসিভ রিয়েলিটিতে আছি।
কোভিড, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতার কারণে ঋণ বেড়েছে বলে অনেকে দাবি করলেও প্রকৃত কারণ ভিন্ন বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ঋণ পরিশোধের চাপের বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০১৮-১৯ সালেও সরকারের আদায় হওয়া রাজস্বের ২৬ শতাংশ ঋণ পরিশোধে ব্যয় হতো। অথচ এই হার এখন ৩৪ শতাংশে উঠেছে যেখানে অভ্যন্তরীণ ঋণ যাচ্ছে ২৮ শতাংশ আর বিদেশি ঋণ সাড়ে ৫ শতাংশ। বিদেশি ঋণ নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই বলে অনেকেই দাবি করলেও বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মোডি বা স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস হিসাবে বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং কমছে বলে দাবি করেন তিনি।
এদিকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ প্রফেসর রেহমান সোবহান বলেন, বাংলাদেশের ঋণের বড় বাধা এখন ঋণগুলোর শর্ত এবং এর সঠিক বাস্তবায়ন। আমরা যদি আশির দশকে ওপেকের সময়ের দিকে ঋণের সংকটের দিকে তাকাই। সেখানে দু’টি পরিস্থিতি ছিল। একটি, লাতিন আমেরিকায় খুব বেশি ঋণ নিয়ে বিপদে পড়া। তারা বিপদে পড়েছিল স্বল্পমেয়াদি ঋণে, সেগুলো তাদেরকে খুব সস্তায় দেয়া হয়েছিল। ফলে তারা এক সময়ে গিয়ে ঋণ সংকটে পড়েছিল। একই ঘটনা শ্রীলঙ্কার ঋণ সংকটেও। শ্রীলঙ্কার অনেক ঋণ স্বল্পমেয়াদি। শ্রীলঙ্কার একই সময়ে অনেক আফ্রিকান দেশেও একই সমস্যা তৈরি হয়েছে।
ড. রেহমান সোবহান বলেন, একইভাবে বাংলাদেশও স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়ে সংকটের পথেই আছে। এটা খুবই উল্লেখ করার মতো, এ ধরনের ঋণ এখন বাড়ছে। যেহেতু আমাদের রপ্তানি আফ্রিকার অনেক দেশের চেয়ে ভালো, তাই এ জায়গায় তেমন সংকট নেই। তার মতে, আপনি কীভাবে ঋণ পরিশোধ করবেন। অথচ আমাদের রপ্তানি আয় তেমন একটা উল্লেখযোগ্য নয়, যেখানে ভিয়েতনামের রপ্তানি আয় ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ৪৫ বিলিয়নের রপ্তানি দিয়ে আপনি কীভাবে ২০০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয়ের দেশকে টপকে যাবেন। ভিয়েতনাম তাদের ঋণের বোঝা বাড়ায়নি। তারা এফডিআই বাড়িয়েছিল। আমাদেরকে এফডিআই আনার জন্য সে ধরনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেন, যতদিন আমাদের ডমেস্টিক সেভিংস এবং ডমেস্টিক ইনভেস্টমেন্ট না বাড়বে ততদিন আমাদের বিদেশি ঋণ, বিদেশি সহায়তা দরকার হবে।