দেশ বিদেশ
মোবাইল হ্যান্ডসেট
‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ এখন সংকটে
কাজী সোহাগ
৩০ মার্চ ২০২৪, শনিবার
১৫ হাজার কোটি টাকার মোবাইল ফোনের বাজারে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে কারখানা স্থাপনকারী ব্যবসায়ীরা। বিদেশ থেকে অবৈধভাবে অবাধে মোবাইল হ্যান্ডসেট আসায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এতে বাড়ছে অর্থপাচার। অবৈধভাবে আসা হ্যান্ডসেটের জন্য যে অর্থ বিদেশে যাচ্ছে হুন্ডি বা নানা অবৈধ উপায়ে। এতে দেশের ডলারের স্থিতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরি করতে ও মেইড ইন বাংলাদেশকে ব্র্যান্ড করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে এই খাতে বিনিয়োগ করা ২ হাজার কোটি টাকা এখন হুমকির মুখে পড়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি ৩ থেকে ৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
এ প্রসঙ্গে মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (এমআইওবি) এর সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন বলেন, সরকারের মূলমন্ত্র ‘স্মার্ট বাংলাদেশ। আর এই ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার মাধ্যম হিসেবে মোবাইল ফোনের গুরুত্ব অপরিসীম। বস্তুত ১৮ কোটি জনগণের বেশির ভাগের হাতে মোবাইল ফোন আছে বলেই ডিজিটাল বাংলাদেশ সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। দেশে মোবাইল ফোনের বাজার প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার এবং এই শিল্পে সরাসরি ৩ থেকে ৪ লাখ লোক জড়িত। ২০১৮ সালের আগে বাংলাদেশে মোবাইল ফোন বিদেশ থেকে আমদানি হতো। কিন্তু সরকারি প্রণোদনায় ২০১৮ সাল থেকে দেশে একের পর এক মোবাইল ফোন কারখানা স্থাপিত হতে থাকে এবং এ পর্যন্ত দেশে দেশি-বিদেশি ১৭টি মোবাইল ফোন কারখানা স্থাপিত হয়েছে। দেশের চাহিদার প্রায় ৯৯ ভাগ ফোনই এখন দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। কিন্তু অবৈধভাবে ফোন আমদানি বন্ধ না করায় স্থানীয় বাজারের প্রায় ৩৫-৪০ ভাগ এখন চোরাই ফোনের দখলে। তৈরি ফোন আমদানিতে যেখানে প্রায় ৫৮ ভাগ কর রয়েছে, সেখানে এসব ফোন বিনা শুল্ক/করে বাজারজাত হচ্ছে। ফলে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে কারখানা স্থাপনকারী ফোন ব্যবসায়ীরা। ২০২২ সালে গঠিত হয় স্থানীয় মোবাইল কারখানাগুলোর সংগঠন ‘মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (এমআইওবি)’ যা ২০২৩ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাভ করে। ১৭টি কারখানাই বর্তমানে এর সদস্য। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন মোবাইল কারখানাগুলোর জন্য এই সংগঠনের সদস্যপদ বাধ্যতামূলক ঘোষণা করেছে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে দ্রুত ন্যাশনাল ইকুপমেন্ট আইডেনটিটি রেজিস্টার (এনইআইআর) চালুর দাবি জানানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে এমআইওবি-এর সভাপতি জাকারিয়া শহিদ বলেন, ফোন প্রস্তুতকারকদের সংগঠন, মোবাইল ফোন অপারেটর, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সকল অংশীজনের সঙ্গে কয়েক বছরের পর্যালোচনা শেষে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন ২০২১ সালে এনইআইআর চালু করে। এই সিস্টেমের মাধ্যমে কার্যকরীভাবে মোবাইল ফোনের অবৈধ আমদানি ও বিক্রয় রোধ করা সম্ভব। উল্লেখ করা যেতে পারে এনইআইআর সিস্টেম চালু করার মাধ্যমে অবৈধভাবে ও কর ফাঁকি দিয়ে মোবাইল ফোনের আমদানি বন্ধ করা হবে, এ আশ্বাসের ভিত্তিতেই দেশের প্রায় সব প্রধান মোবাইল আমদানিকারক স্থানীয়ভাবে কারখানা স্থাপন করেছিলেন। ২০২০ সালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিপুল সরকারি অর্থ ব্যয় করে এনইআইআর সিস্টেমটি কেনে ও স্থাপন করে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ২০২১ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে এনইআইআর চালু করার কিছুদিনের মধ্যেই তা স্থগিত বা শিথিল করে দেয়া হয়। তিনি বলেন, এনইআইআর চালু করার কিছুদিন আগে থেকেই অবৈধ হ্যান্ডসেট আমদানিকারকরা সাবধান হয়ে যায় এবং চোরাই পথে মোবাইল আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এনইআইআর বন্ধ করে দেয়ার ফলে বৈধ মোবাইল হ্যান্ডসেটের বাজারে ধস নেমে আসে। অবৈধভাবে ও কর ফাঁকি দিয়ে দেশে আনা হ্যান্ডসেট ব্যবহারে কোন বাধা না থাকায় অবৈধভাবে হ্যান্ডসেট আমদানি করা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে মোবাইল ফোনের বাজারের প্রায় ৪০ ভাগ দখল করে আছে অবৈধভাবে আমদানি করা হ্যান্ডসেট। এই পণ্যের ওপর সরকার কোনো রাজস্ব আদায় করতে পারছে না। বর্তমান অর্থবছরে সরকার এই খাত থেকে সম্ভাব্য ২০০০ কোটি টাকার রাজস্ব হারাবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এনইআইআর সিস্টেম শিথিল করাতে ৫ ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে কারখানাগুলোকে।
এসবের মধ্যে রয়েছে- প্রথমত- অবৈধভাবে দেশে আসা হ্যান্ডসেটের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কঠিন, কারণ তারা কর ফাঁকি দেয়। দ্বিতীয়ত- বৈধ ফোন তৈরির কারখানাগুলোর জন্য রয়েছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের নানা রকমের নিয়ম-নীতি, বিধি- নিষেধ, উচ্চ লাইসেন্স ফি। অথচ অবৈধ ফোনের ক্ষেত্রে কমিশনের কোনো নিয়ম-নীতিই প্রযোজ্য নয়। তৃতীয়ত- এনইআইআর সিস্টেম শিথিল করার ফলে সরকার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। চতুর্থত- গ্রাহক নিম্নমানের সেট কিনে প্রতারিত হচ্ছে, তাছাড়া অবৈধ মোবাইলের কোনো ওয়ারেন্টি নেই। পঞ্চমত- অবৈধভাবে আমদানিকৃত মোবাইল ফোন দিয়ে নানারকম অপরাধ সংঘটিত হয়, যা প্রতিরোধ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হিমশিম খেতে হয়। এনইআইআর চালু করার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল এইসব অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করা। এদিকে এনইআইআর সিস্টেমটি অবিলম্বে পুনরায় চালু করা ছাড়া প্রতিশ্রুতিশীল মোবাইল তৈরির শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মানবজমিনকে জানান মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ এর সহ-সভাপতি রেজওয়ানুল হক। তিনি বেশ কয়েকটি কারণ তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশে ১৭টি দেশি-বিদেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে কারখানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্থানীয় চাহিদার প্রায় শতভাগ মুঠোফোন দেশে তৈরি করছে। এ শিল্পে বর্তমানে প্রায় ২৫ হাজার কারিগরি দক্ষ লোক কর্মরত। এ বিশাল শিল্পকে বাঁচাতে হলে অবৈধ আমদানি বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে অবৈধভাবে আমদানি করা মুঠোফোন বিক্রয়ের ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকায় চোরাইপথে এ সকল অবৈধ মুঠোফোন বাংলাদেশের বাজারে আসছে।
গত ৬ মাসের বাজার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ মুঠোফোন বাজারে আসছে অবৈধ পথে। এই পণ্যের ওপর সরকার কোনো রাজস্ব আদায় করতে পারছে না। ফলে বর্তমান অর্থবছরে সরকার আনুমানিক ২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাবে। রেজওয়ানুল হক বলেন, বর্তমানে সন্ত্রাসীরা সিমকার্ড ছাড়া ওয়াই-ফাই বা অন্য কোনো প্রযুক্তির মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম। যদি মুঠোফোনের আইএমইআই নম্বরটিও সিমের সঙ্গে রেজিস্ট্রি করা থাকে তবে আইপি এড্রেস ও আইএমইআই-এর মাধ্যমে এ সকল সন্ত্রাস মোকাবিলা সম্ভব। এনইআইআর পদ্ধতি এই নিরাপত্তা খুব সহজেই প্রতিষ্ঠা করতে পারে। কারখানা স্থাপনকারী ফোন ব্যবসায়ীরা মানবজমিনকে বলেন, বৈধ ফোনের কারখানা চালু রাখা এবং মোবাইল রপ্তানি ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে দেশে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। প্রযুক্তি বিশ্বে বাংলাদেশ গর্বভরে পদচারণা করতে সক্ষম হবে। ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ পণ্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ নামকরণের সার্থকতাও আসবে এরই মাধ্যমে।
পাঠকের মতামত
সরকারকে অবশ্যই অবিলম্বে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
দেশের ফোনের মান ভালো না এবং দাম অনেক বেশি, ধরতে গেলে আকাশ-পাতাল ব্যবধান, যে ফোনটা বাহির থেকে ২০হাজার টাকায় কেনা যায় সেটা বাংলাদেশে কিনতে গেলে ৩৫ হাজার টাকা লাগে তাহলে মানুষ বাহির থেকে ফোন কিনতে আগ্রহী হবে না কেন!!!! আর তাছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে ফোন এত সস্তা কিভাবে বিক্রি করে? তারা কি তাদের দেশের সরকারকে কর দেই না,,, নাকি শুধু বাংলাদেশী কোম্পানি গুলোই সরকারকে কর দেই।
আপনারা নিজেদের ফোনের কোয়ালিটি ভালো করেন তাহলে এমনেই চুরাই ফোন বন্ধ হয়ে যাবে, আর প্রবাসীরা যে ফোন নিয়ে আসে ঐ দিকে চোখ দিয়েন না কেননা ওরা বাহিরে ইনকাম করে ফোন কিনে, দেশের টাকায় কিনে না।
সরকারের উচ্ছ পর্যায়ের নেতা কর্মি সরকারের অনেক কর্মচারী বিদেশি হ্যান্ডসেট ব্যবহার করে।