ঢাকা, ১৩ মে ২০২৪, সোমবার, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৪ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

অপারেশন আটলান্টা নজরে রেখেছে বাংলাদেশি জাহাজটিকে

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে
১৬ মার্চ ২০২৪, শনিবার

সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজকে উদ্ধারে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। এরমধ্যে এগিয়ে এসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স (ইইউএনএভিএফওআর)। তারা এমভি আব্দুল্লাহকে পর্যবেক্ষণে রেখেছে। বাংলাদেশের এই জাহাজকে উদ্ধারে তাদের এই পুরো কার্যক্রমের নাম দেয়া হয়েছে ‘অপারেশন আটলান্টা’। এর মধ্যে জলদস্যুদের সঙ্গে তাদের  গুলিবিনিময়ও ঘটেছে। তবে সেই উদ্ধার প্রচেষ্টা নিয়ে একধরনের আতঙ্কের মধ্যে আছেন নাবিকদের স্বজনরা। 
ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স (ইইউএনএভিএফওআর) বৃহস্পতিবার এমভি আব্দুল্লাহকে উদ্ধারে তাদের প্রচেষ্টার বিষয় জানিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে। এতে দস্যুদের সঙ্গে গুলিবিনিময়ের বিষয় উল্লেখ করা হয়নি।

‘এমভি আবদুল্লাহ’কে ঘিরে ‘অপারেশন আটলান্টা’ তার কার্যক্রম চালাচ্ছে উল্লেখ করে ইইউএনএভিএফওআর জানায়, ছিনতাই হওয়া জাহাজের পরিস্থিতি এখনো একই অবস্থায় আছে এবং নাবিকরা নিরাপদে আছে। সেই বিজ্ঞপ্তিতে  বলা হয়, জিম্মি  জাহাজে অন্তত ১২ জন জলদস্যুকে নিশ্চিত করা হয়েছে। যদিও ছিনতাইয়ের সময় ২০ জন সশস্ত্র ব্যক্তির কথা বলা হয়েছিল।

ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সোমালি উপকূলের উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্য অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় জলদস্যু গোষ্ঠীর ৩টি ক্যাম্প চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব জায়গা থেকে তারা ছিনতাই অভিযানে সহায়তা করে থাকে।

বিজ্ঞাপন
এর আগে, ওই অঞ্চলে ‘এমভি রুয়েন’ নামের আরেকটি জাহাজ ছিনতাই করে জলদস্যুরা। ওই দলের সদস্যরাই ‘এমভি আবদুল্লাহ’র ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলে ওই বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

অপারেশন আটলান্টা সামুদ্রিক নিরাপত্তায় সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপের সমন্বয় সাধনের জন্য বাংলাদেশ ও সোমালি কর্তৃপক্ষ এবং এই অঞ্চলের অংশীদারদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে বলেও ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
এদিকে নাবিকদের উদ্ধারে পশ্চিমা দেশগুলোর এই নৌশক্তির প্রচেষ্টা নিয়ে সরকার ও জাহাজের মালিকপক্ষ একটু  আশান্বিত হলেও নাবিকদের স্বজনরা আছেন আতঙ্কে। সমঝোতা ছাড়া সশস্ত্র অভিযানে জিম্মিদের উদ্ধারে কোনো প্রচেষ্টা হলে হিতে বিপরীত হতে পারে বলেও শঙ্কা করছেন তারা। 

গতকাল বিকালে কথা হয় জাহাজে জিম্মি  নাবিক নুরুদ্দিনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস শিমুর সঙ্গে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার আমার  স্বামীর সঙ্গে ৩ মিনিটের মতো কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, দস্যুরা তাদেরকে শারীরিকভাবে কোনো আঘাত করেনি। তবে তারা আতঙ্কের মধ্যে আছেন। এরমধ্যে বিদেশি দুইটা জাহাজ তাদেরকে উদ্ধারে এসেছিল। এসময় দস্যুরা হুমকি দিচ্ছিল, এভাবে আসলে জিম্মিদেরকে মেরে ফেলা হবে। তারা  নাবিকদের মাথায় অস্ত্র তাক করে রেখেছিল। পরে জাহাজের ক্যাপ্টেন স্যার ওই জাহাজগুলোকে সরে যেতে বলেন। এরপর সেগুলো চলে যায়।’

তিনি বলেন, এভাবে আসলে উদ্ধার সম্ভব নয়। দস্যুদের সঙ্গে নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে  জিম্মিদের মুক্ত করতে হবে। আমরা আশাবাদী জাহাজের মালিকপক্ষ এই বিষয়টি করবেন। আমাদের সরকারও তাই করবেন।
জাহাজের মালিকপক্ষ কবির গ্রুপের লোকজনের সঙ্গে কথা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। আমরা আগ্রাবাদে ওনাদের অফিসে গিয়েছি। ওনারা যথেষ্ট কো-অপারেটিভ। ওনারা বলেছেন, আমাদের স্বজনদের নিরাপদে ফেরাতে যা কিছু করার করবেন। আমরা আশাবাদী ২০১০ সালে যেভাবে ছিনতাই হওয়া জাহাজের নাবিকদের ফেরত এনেছে, এবারো  তারা তাই করবেন। কোনো রক্তারক্তি ছাড়াই  করবেন।

জিম্মি এক নাবিকের এক স্বজন বলেন, ‘এই দুর্ঘটনা হয়তো আল্লাহ এভাবে লিখে রেখেছেন। মালিকপক্ষের কিছু অবহেলা এজন্য কম দায়ী নয়। তারা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখেনি, কোনো আর্মস ফোর্স রাখেনি। অথচ ওই রুটটা অনেকটা অনিরাপদ। ওই রুট দিয়ে যাওয়া প্রায় সব জাহাজে গানম্যান থাকে, আরও আনুষঙ্গিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে। তারা এর আগেও এরকম একটি পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল। অন্তত সেই অভিজ্ঞতার কারণে তাদের সাবধান থাকা দরকার ছিল। এখন আমরা চাই, আমাদের স্বজনরা নিরাপদ বাড়ি ফিরে আসুক।’
জানা যায়, এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজটি অপহরণের পরপর সেটার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জিম্মি এই জাহাজে ছিল না পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। 

সাধারণত একটি জাহাজের ৩ ফুট উচ্চতার কাঁটাতারের বেষ্টনি থাকে রেলিং জুড়ে। এর ফলে কেউ জাহাজ বেয়ে উপরে উঠতে পারে না। কিন্তু এই জাহাজে কোনো বেষ্টনি ছিল না। 
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ একটি রুট দিয়ে জাহাজ চলাচল করছে। কিন্তু  সেখানে সশস্ত্র টিম পাহারাদার রাখা হয়নি। এটা আসলেই প্রশ্নের বিষয়। 

একটি মেরিটাইম সূত্র বলছে, সেদিন এমভি আব্দুল্লাহ অপ্রচলিত রুট দিয়ে যাচ্ছিল। ওই যাত্রায় জাহাজটিকে অবশ্যই ভারত মহাসাগরের সোমালিয়া উপকূল দিয়ে যাওয়ার কথা। যেটি আর্ন্তজাতিক স্বীকৃত একটি রুট। কিন্তু সেই পথে না গিয়ে জাহাজটি সোমালিয়া উপকূল থেকে অনেক দূর দিয়ে যাচ্ছিল। আন্তর্জাতিক স্বীকৃত রুট না হওয়ায় সেখানে ছিল না পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আর সেই রুটে সোমালিয়ার জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার বড় ঝুঁকি ছিল। এ ছাড়া  জাহাজটিতে ভাড়া করা কোনো আর্মড ফোর্স ছিল না। এসব জানার পরও কেন জাহাজটি সেই অপ্রচলিত রুট দিয়ে যাত্রা করলো সেটি প্রশ্নের বিষয়। 

এদিকে এমভি আব্দুল্লাহ’র মালিকপক্ষ ও শিপিং করপোরেশনের কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, নাবিকদের  উদ্ধারে কোনো সশস্ত্র অভিযান চালানো হবে না। এতে উল্টো তাদের (নাবিকদের) জীবননাশের শঙ্কা থাকবে। এক্ষেত্রে মুক্তিপণ তথা সমঝোতার মাধ্যমে দস্যুদের নিবৃত্ত করা হবে। এক্ষেত্রে একটা নীতিগত সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৪ই মার্চ) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এমন সিদ্ধান্ত হয়। সেই বৈঠকে জাহাজের মালিকপক্ষের প্রতিনিধিও যোগ দিয়েছিল। জাহাজের মালিক ও বিমাকারী সংস্থাকে আলোচনার কৌশল ঠিক করাসহ আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি নিতে বলা হয়।

জানা যায়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই বৈঠকে কয়েকটি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে জলদস্যুদের সঙ্গে আলোচনায় কখন কী কৌশল নেয়া হবে, তা গণমাধ্যমে প্রকাশ না করতে সভায় সকলকে বলে দেয়া হয়েছে। এর বাইরে নাবিকদের স্বজনদের আহাজারিও যতটা সম্ভব প্রকাশ্যে না আনতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরামর্শ দিতে সভায় অনুরোধ করা হয়। এই বিষয়ে বলা হয়েছে, আহাজারি বেশি প্রকাশ পেলে ও নিজেদের কৌশল ফাঁস হলে, আলোচনায় জলদস্যুরা কৌশলগতভাবে সুবিধা পেয়ে থাকে। 

এদিকে একটি সূত্রে জানা যায়, সোমালিয়ার জলদস্যু দ্বারা জাহাজ অপহরণ হওয়ার বিষয়টি দেশটির সরকারকে কূটনৈতিক চ্যানেলে জানানো হয়েছে। তবে জলদস্যুরা সাগরের যে অঞ্চলে বিচরণ করে ও যে স্থানে জাহাজটি নিয়ে গেছে, সেখানে দেশটির সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই।

অপারেশন আটলান্টার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি শাখাওয়াত হোসেন গতকাল বিকালে মানবজমিনকে বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেভাল ফোর্স থেকে উদ্ধারের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। তারা একবার রিসকিউ করার চেষ্টাও করেছে। পরে সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে সরে গেছে। তারা এখনও এই জাহাজকে মনিটরিং করছে।’

নাবিকদের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জিম্মি নাবিকরা সোমালিয়ার উপকূলে আছে। দস্যুদের একটি সশস্ত্র গ্রুপ জাহাজে আছে। নাবিকরা সুস্থ আছেন। আর তাদেরকে উদ্ধারে বিভিন্ন তৎপরতা চলছে। আর জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে। এরমধ্যে তারা যোগাযোগ করলে দ্রুত রেসপন্স করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’

পাঠকের মতামত

যে জাহাজের কোন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই সেই জাহাজ এই পথে পাঠানোর পিছনে কি কোন রহস্য আছে এটাও খোঁজে দেখার দরকার।

Khan
১৬ মার্চ ২০২৪, শনিবার, ৫:৫১ পূর্বাহ্ন

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status