অনলাইন
'থার্ড আই' দিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র নীতি পরখ করে দেখছে মিউনিখ
মানবজমিন ডিজিটাল
(১ বছর আগে) ৪ মার্চ ২০২৪, সোমবার, ১২:০৬ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৭:৩৭ অপরাহ্ন

হামাস-ইসরাইল বিরোধের বিষয়ে ভারত তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের আক্রমণের নিন্দা করা এবং গাজায় ইসরাইলের পাল্টা প্রতিক্রিয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে সম্মতি জানিয়েছে ভারত। তারও একটু আগে ইউক্রেন-রাশিয়া সামরিক সংঘর্ষের প্রতিক্রিয়ায় ভারত এমনকি ইউএনজিএ-তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে সোভিয়েত বিরোধী প্রস্তাবে ভোট দেয়া থেকে নিজেকে বিরত রেখেছে। এটা কোনও আশ্চর্যের বিষয় ছিল না যে, ১৬ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী (ইএএম) এস জয়শঙ্কর একটি ইন্টারেক্টিভ সেশনে ভারতের পররাষ্ট্র নীতির উপর কিছু অনুসন্ধানী প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন। এস জয়শঙ্কর স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, ভারত নীতিগতভাবে এক্ষেত্রে অত্যন্ত ভাল কাজ করেছে, যা ভারতের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর তার শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করে। এটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফল অবস্থানের একটি নিশ্চিতকরণ যে ভারতের পররাষ্ট্র নীতি মূলত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর, কখনো কখনো বহুপাক্ষিক সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল।
এই পারস্পরিক বন্ধনের অর্থ- বিশ্বশান্তি এবং মানব উন্নয়নের বৈশ্বিক অগ্রগতির লক্ষ্যে বিবাদ না করে পারস্পরিক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থর খেয়াল করা। এস. জয়শঙ্কর এই আলোকে ভারতের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনা প্রসঙ্গে ‘স্মার্ট পলিসি’র-মতো শব্দগুলি বেছে নিয়েছিলেন।
ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, আজ বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তার পরিবেশ ‘স্থিতিশীল নয়’। আজকের জটিল ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের মধ্যে দিয়েই সেই পথ প্রশস্ত হতে পারে। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ‘স্মার্ট’ হওয়া মানে অন্য কারো ক্ষতি না করে দেশের জাতীয় স্বার্থ পরিবেশন করার বিষয়ে ‘ইতিবাচক’ হওয়া এবং নীতি প্রণয়নে স্বচ্ছতা গ্রহণ করা।
মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্স হল বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমাবেশ যা ‘সংলাপের মাধ্যমে শান্তি’ স্থাপনের লক্ষ্যে সংঘটিত হয়। এই সমাবেশ একাধিক দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, সামরিক নেতাদের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা শিল্পের অধিনায়কদের একত্রিত করেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক উদ্যোগ ও মিথস্ক্রিয়ার জন্য একটি স্থান প্রদান করেছে। এতে ন্যাটো এবং ইইউ দেশগুলির প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এস. জয়শঙ্কর ব্যাখ্যা করেছেন, ভারত ‘পশ্চিম-বিরোধী কিন্তু অ-পশ্চিম’ নয় এবং নিশ্চিত করেছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সাথে ভারতের সম্পর্ক ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে। তিনি BRICS-এ ভারতের ইতিবাচক ভূমিকা এবং G7 থেকে G20-এ সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে দেশটির অবদান তুলে ধরেন। বিশ্ব শান্তি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাহায্যকারী একটি প্রধান স্বাধীন শক্তি হিসেবে ভারতকে উপস্থাপন করতে সফল হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।তিনি সাইডলাইনে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে মতবিনিময় করেন এবং পশ্চিম এশিয়া, ইউক্রেন এবং ইন্দো-প্যাসিফিকের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেনের সাথে পৃথক বিস্তৃত আলোচনা করেন। মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে ভারতের অংশগ্রহণকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকার করা হয়েছে। অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং পারস্পরিক সুবিধাগুলিকে কাজে লাগানোর জন্য ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টাকে বিকশিত করতে সাহায্য করেছে। আজকের অনিরাপদ বিশ্ব পরিবেশে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির একটি অসম গতিপথে ভারত দ্রুত প্রবৃদ্ধি নথিভুক্ত করছে, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বের দুটি বৃহত্তম পরীক্ষিত গণতন্ত্র, এমন এক সময়ে একসঙ্গে কাজ করার গুরুত্ব স্বীকার করে যখন মার্কসবাদী একনায়কত্ব এবং ‘মৌলবাদী’ শক্তি বিশ্বকে অস্থিতিশীল করার জন্য হাত মিলিয়েছে।
চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে কৌশলগত জোট এখন এমন পর্যায়ে বিকশিত হয়েছে যেখানে এই দুই প্রতিপক্ষ ভারতের বিরুদ্ধে গোপন অভিযান পরিচালনা করতে সহযোগিতা করছে বিশেষ করে জম্মু ও কাশ্মীর এবং পাঞ্জাবের সীমান্ত রাজ্যে, যা ভারতের জন্য প্রধান নিরাপত্তা হুমকি। পাশাপাশি এটি ভারত-মার্কিন সম্পর্ক জোরদার করার এবং কোয়াডের সাথে তার সম্পর্ক বাড়াতে ভারতের নীতিকে বৈধতা দেয়। ইসলামী বিশ্বে মৌলবাদের বিস্তারের ফলে সন্ত্রাসবাদ আরেকটি সাধারণ উদ্বেগ যা এই নতুন বৈশ্বিক হুমকির বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একত্রে আবদ্ধ করে। ভারতের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল মার্কিন নীতিনির্ধারকদের পাকিস্তানকে রঙিন চশমা ছাড়া দেখতে এবং পাক জেনারেলদের প্রতি পেন্টাগনের প্রতিশ্রুতিকে অতিক্রম করা। মনে রাখা ভালো যে পাকিস্তান 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে' মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনিচ্ছুক অংশীদার ছিল এবং এটি আল কায়েদা, তালেবান এবং আইএসআইএসের সাথে একটি সমীকরণ রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
পাকিস্তান ১৯৯৬ সালে কাবুলে তালেবান আমিরাত স্থাপনে সহায়তা করেছিল এবং ২০২১ সালে দোহা শান্তি আলোচনার শেষে আফগান থেকে আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহারের মাধ্যমে আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করেছিল। পাকিস্তান এই আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী হওয়ার ভান করেছিল কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইসলামিক কট্টরপন্থী দলগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য তার প্রতিশ্রুতি ত্যাগ না করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডান পাশে থাকার ছদ্ম নীতি নিয়েছিলো। ভারত-মার্কিন এবং মার্কিন-পাকিস্তান সম্পর্কের ত্রুটিপূর্ণ পুরনো নীতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তান পাক-আফগান বেল্টকে কট্টর ইসলামিক শক্তির জন্য একটি 'হোম গ্রাউন্ড বানিয়েছে' এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর মাধ্যমে আফগানিস্তানে চীনের অনুপ্রবেশকে সমর্থন করেছে। ভারতের তীব্র প্রতিবাদ উপেক্ষা করে ইতিমধ্যেই চীন-পাক অর্থনৈতিক করিডোরকে (CPEC) POK-এর উত্তরাঞ্চলের মধ্য দিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে পাকিস্তান ।
চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক বর্তমান ভূ-রাজনীতিকে প্রভাবিত করছে এবং আমেরিকান প্রশাসনকে অবশ্যই ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি যৌথ উদ্বেগ হিসাবে এটিকে দেখতে হবে । পাকিস্তানের সাম্প্রতিক নির্বাচনে, সেনাবাহিনী ইমরান খানের পথে এসেছিল যিনি ধারাবাহিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা করেছিলেন এবং যিনি কোনও দলীয় প্রতীক ছাড়াই কারাগার থেকে নির্বাচনে লড়াই করতে বাধ্য হন। তবে এটি আমেরিকার জন্য কোন স্বস্তি বয়ে আনবে না কারণ ভোটের মাধ্যমে তৈরি হয় পাকিস্তানের অনিশ্চিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে খাইবার পাখতুনখোয়া-আফগানিস্তান অঞ্চলে 'উগ্রবাদ' শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে পুরনো 'রাজনৈতিক' বিরোধ এখন 'ধর্ম ও জেহাদ' দ্বারা চালিত একটি দ্বন্দে পরিণত হয়েছে- এটি বিশ্বব্যাপী গুরুতর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী মোদির অধীনে ভারত পশ্চিম এশিয়ায় অর্থনৈতিক উন্নয়নকে আঞ্চলিক এজেন্ডার শীর্ষে রেখেছে এবং বাকি বিশ্বের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের "কানেক্টিভিটি"কে এগিয়ে নেওয়ার উপায় হিসেবে এই কৌশলী পদক্ষেপে সফল হয়েছে। আবার, এই বিষয়ে ভারতের উদ্যোগগুলি পারস্পরিক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য দ্বিপাক্ষিক বন্ধন গঠনের মৌলিক নীতির উপর নির্ভর করে। এর ফলস্বরূপ, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো ঘনিষ্ঠ মার্কিন বন্ধুদের মধ্যে এখন ইসরাইলের প্রতি তাদের মধ্যপন্থা এবং ইয়েমেন, সিরিয়া এবং কাতারের মতো কট্টরপন্থী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে একটি বিভাজন রেখা স্পষ্ট যারা হামাসের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে।
পশ্চিম এশিয়ায় শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের একটি নতুন দিকও রয়েছে। কারণ ইরানের আয়াতুল্লাহর সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের প্রতি সম্পূর্ণ বিদ্বেষ নিয়ে এই অঞ্চলে তাদের 'প্রক্সি'দের সক্রিয়ভাবে হামাসের পক্ষে এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে উৎসাহিত করেছিল। ইসরাইলে হামাসের হামলার নিন্দা করে ভারত সঠিক কাজ করেছে এবং ইসরাইলকে সতর্কতা অবলম্বন করার আহ্বান জানিয়েছে যাতে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেসামরিক হতাহতের ঘটনা একটি 'মানব' সংকট সৃষ্টি না করে।
ভারত এটাও স্পষ্ট করেছে যে তারা প্যালেস্টাইনে ‘দুই-রাষ্ট্র সমাধানের’ পক্ষে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণকে প্রচার করতে এবং এই অঞ্চলে ইসলামিক উগ্রবাদী শক্তির বিস্তার রোধ করতে ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডর চালু করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সাথে হাত মিলিয়েছে ভারত।
ইসরাইলের বিরুদ্ধে ‘অস্ত্র’ হিসাবে ব্যবহার করার জন্য হামাসের হাতে আটক জিম্মিদের মুক্তি নিয়ে মার্কিন উদ্বেগ ভারত বোঝে এবং আশা করে যে মিশরের মতো একটি দেশের মধ্যস্থতায়, ইসরাইলের সামরিক অভিযানে বিরতি' জিম্মি মুক্তির' সম্ভাবনাকে শক্তিশালী করবে। ভারত মধ্যপ্রাচ্যে একটি স্বাধীন অবস্থান নিয়েছে ঠিক যেমনটি ইউক্রেন-রাশিয়ার সামরিক সংঘাতের সময়ে তারা দেখিয়েছিলো। প্রধানমন্ত্রী মোদি সেই সংঘর্ষের শুরুতে নিজেই ঘোষণা করেছিলেন যে "এটি যুদ্ধের যুগ নয়" এবং শত্রুতা বন্ধ করে শান্তির জন্য আলোচনার পক্ষে আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। ভারতের অবস্থান সারা বিশ্ব বুঝতে পেরেছে। মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে জয়শঙ্কর দৃঢ়ভাবে পুনর্ব্যক্ত করেছেন যে কীভাবে ইউক্রেন-রাশিয়া এবং ইস্রায়েল-হামাস সংঘাতের প্রতি ভারতের প্রতিক্রিয়া রাজনৈতিক গঠনকে বাধাগ্রস্ত না করে বিশ্ব শান্তির জন্য সর্বোত্তমভাবে কাজ করেছে। ভারতের অগ্রাধিকার ছিল দ্বিপাক্ষিকভাবে অর্থনৈতিক সুবিধার অন্বেষণের মাধ্যমে তার জনগণের উন্নতি করা । আর তাই বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ভারতের বিদেশ নীতিকে তুলে ধরতে জয়শঙ্করকে সাহায্য করেছে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে।
সূত্র : yespunjab.com
( প্রতিবেদনের লেখক গোয়েন্দা ব্যুরোর সাবেক পরিচালক।)