প্রথম পাতা
শাহজাহানের জল্লাদ জীবন নিয়ে বই
ছয় শতাধিক ডাকাতি, ৩২ বছর কারাভোগ
ফাহিমা আক্তার সুমি
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, শুক্রবার
৭০ বছর বয়সী শাহজাহান ভুঁইয়া। তিনিই জল্লাদ শাহজাহান। তার হাতেই টেনেছেন ৬০ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির ফাঁসির দড়ি। নরসিংদী পলাশ উপজেলায় তার বাড়ি। তিনি মৃত হাছেন আলীর ভূঁইয়ার সন্তান। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। তার পঁয়ত্রিশটি হত্যা মামলা এবং একটি অস্ত্র মামলায় একশত চুরাশি বছর সাজা হয়। পরে উচ্চ আদালতের বিশেষ বিবেচনায় ৪২ বছর কারাদণ্ড পান। টানা ৩২ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। কারাভোগের আগে ছয় শতাধিক ডাকাতিও করেছেন। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। দায়িত্ব পালন করেন নরসিংদী জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি হিসেবে। পরবর্তীতে জড়িয়ে পড়েন নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। জেলে থাকা অবস্থায় পরিচিতি পান জল্লাদ হিসেবে। দীর্ঘ সময় কারাভোগের পর ২০২৩ সালের ১৮ই জুনে কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। এই মানুষটি বর্তমানে একাকী বসবাস করছেন ঢাকার কেরানীগঞ্জে।
প্রথম জল্লাদ হিসেবে তার খাতায় নাম উঠে ২০০১ সালে। নরসিংদীর কুখ্যাত খুনি ফিরোজ পাগলার ফাঁসি দিয়ে। তার বিরুদ্ধে তিনটি খুনের মামলা প্রমাণিত হওয়ায় আদালত তার ফাঁসির রায় চূড়ান্ত করেন। এই খুনের ঘটনায় ফিরোজ পাগলার স্ত্রীও ছিল। তবে তার বিরুদ্ধে প্রমাণ না থাকায় বেকসুর খালাস দেয়া হয়। ফিরোজের ফাঁসির দিন-তারিখ ঠিক হয়। এমন সময় জানা গেল জল্লাদ নেই। পরে সে সময়ের জেলার ফরমান আলী শাহজাহান ভূঁইয়াকে ফাঁসি কার্যকরের কথা জানান। তখন তিনি না করলেন না। প্রধান জল্লাদ প্রস্তাবেও রাজি হয়ে যান। সে সময় তার সহযোগী ছিলেন সাত জন। সেবারই প্রথম সম্পূর্ণ ফাঁসির প্রক্রিয়া জানতে পারলেন তিনি। শাহজাহান ভূঁইয়ার শৈশব, জেলজীবন, জল্লাদ শাহজাহান হয়ে উঠা আর কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের ফাঁসির মুহূূর্তগুলো নিয়ে লিখেছেন আত্মজীবনী। ‘কেমন ছিল জল্লাদ জীবন’ নামের আত্মজীবনী প্রকাশ হয়েছে অমর একুশে বইমেলা ২০২৪-এ। প্রকাশনা সংস্থা কিংবদন্তি পাবলিকেশন প্রকাশ করেছে বইটি।
ফাঁসির আসামির প্রস্তুতি: চূড়ান্ত আদেশ পাওয়ার একুশ-আঠাশ দিনের মধ্যে ফাঁসি কার্যকর করতে হয়। ফাঁসির রায় হওয়ার পরপরই সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে কনডেম সেলে নিয়ে রাখা হয়। একেকটা কনডেম সেলে একজন, তিনজন, পাঁচজন এভাবে বেজোড় সংখ্যক আসামি রাখা হয়। যেদিন ফাঁসির তারিখ নির্দিষ্ট হয় তার দুইদিন আগেই সেই আসামিকে এক নম্বর কনডেম সেলে এনে রাখা হয়। যেখান থেকে বের হলেই ফাঁসির মঞ্চ। তবে রাতের আঁধারে নিয়ে আসায় আসামি তখনো বুঝতে পারে না যে তাকে ফাঁসির জন্য নিয়ে যাচ্ছে। আর মাত্র দুইদিন পরই তার জীবনের অধ্যায় শেষ হয়ে যাবে। কনডেম সেলের ছোট ভেন্টিলেটর দিয়ে জীবনের শেষ আলোটুকু দেখতে থাকে। জল্লাদদেরও দুইদিন আগে থেকে খবর জানানো হয়। আসামির ভর আর উচ্চতার সঙ্গে মিল রেখে বস্তা দিয়ে একটা পুতুল বানানো হয়। সেই পুতুলকেই কয়েকবার ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে পরীক্ষা করা হয় ঠিক আছে কিনা। ফাঁসির মঞ্চের সব লোহার যন্ত্রাংশেও তেল, গ্রিজ মেখে পিচ্ছিল করে রাখা হয়। লোহার যন্ত্রপাতির নাড়াচাড়া আর গ্রিজ দিয়ে ঘষার শব্দ শুনে কনডেম সেলের আসামিরা বুঝতে পারে, তাদের মধ্যেই কেউ একজনের সময় ফুরিয়ে এসেছে। জেলখানার সুবেদার, জেলার মিলে সাজাপ্রাপ্ত আসামির খোঁজখবর নিতে যান। জিজ্ঞেস করেন ভালোমন্দ কিছু খেতে ইচ্ছা করে কিনা। জেলখানার মধ্যেই ভালোমন্দ খাবারের আয়োজন করা হয়। কয়েক টুকরো বেশি মাংস, আস্ত মাছ পাতে পেয়ে কোনো কোনো আসামি বেশ খুশি হন, কেউ কেউ বুঝতে পারেন যে, পিটিশন করে হয়তো কোনো লাভ হয়নি। ধীরে ধীরে এভাবেই এগিয়ে যায় ফাঁসি কার্যকরের দিকে। শেষবারের মতো দেখার জন্য খবর দেয়া হয় আসামির পরিবারকে। শেষবার কথা বলার সময় তাদের বেশির ভাগ আবেগ ধরে রাখতে পারেন না। কান্না শুরু করেন। ফাঁসির দিন-রাত আটটা পর্যন্ত আসামির পরিবার তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান। এত আয়োজন দেখে আসামি বুঝতে পারেন এই আয়োজন তার শেষ বিদায়ের জন্য। এই দেখা তার জীবনের শেষ দেখা। রাত আটটা থেকেই ফাঁসির প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। জল্লাদরা তাদের প্রস্তুতি সব শেষ করে। এরপর ফাঁসির আসামিকে তওবা পড়াতে রাত সাড়ে আটটায় বাইরে থেকে বড় মাওলানা আসেন। তওবা পড়ানো শেষ হলে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়তে বলেন।
ফাঁসির মঞ্চের প্রস্তুতি: ফাঁসির জন্য কিছু নির্দিষ্ট সময় ঠিক করা থাকে। রাত দশটা বেজে এক মিনিট, এগারোটা বেজে এক মিনিট, এগারোটা উনষাট মিনিট, বারোটা এক মিনিট, এমন বেজোড় সময়গুলোতে ফাঁসি কার্যকর করা হয়। নির্দিষ্ট সেই সময়ের এক ঘণ্টা আগেই জল্লাদরা ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত রাখে। শেষে আরেকবার যন্ত্রাংশে গ্রিজ ঘষা হয়। ফাঁসির দড়িতে কলা, ঘি, মাখন মেখে পিচ্ছিল করা হয় যেন হুট করে পড়ার পর আসামির মাথা ছিঁড়ে আলাদা না হয়ে যায়। জল্লাদের প্রস্তুতি চলাকালে বাইরে থেকে আসতে থাকেন সিভিল সার্জন, এডিএম, ডিসি, ওসি, এসপিসহ জেলখানার ডাক্তার ও নার্সরাও সেখানে উপস্থিত থাকেন। নির্দিষ্ট সময়ের মিনিট দশেক আগে জেল সুপার সবাইকে নিয়ে সাজাপ্রাপ্ত আসামির সেলে যান। তাদের পেছনে পেছনে জল্লাদরাও থাকেন। জেল সুপার আসামির সেলে ঢুকে বলেন, ‘দেখো, তুমি তো আবেদন করেছো, কোর্টে আপিল করেছো, রাষ্ট্রপতির কাছেও প্রাণভিক্ষা চেয়েছো কিন্তু সবখান থেকেই তোমার আবেদন নাকচ করে দেয়া হয়েছে। যেহেতু তোমার ফাঁসির রায় বহাল আছে। তাই আমাদের এখানে আর কিছুই করার নেই। আজ রাতেই তোমার ফাঁসি হয়ে যাবে। মারা যাওয়ার আগে তোমার কোনো শেষ কথা আছে কিনা। জেল সুপারের কথা শুনে কোনো কোনো আসামি কান্নায় ভেঙে পড়েন। কেউ কেউ আবার পরিবারের উদ্দেশ্যে কিছু অসিয়ত করে যান। কেউ আবার কিছুই বলেন না। কথা শেষ হওয়ার পর জেল সুপার সবাইকে নিয়ে বের হয়ে যান। এরপর জল্লাদরা প্রবেশ করেন।
ফাঁসির আগের-পরের দৃশ্যপট: সহকারী জল্লাদদের একজন আসামির হাত পেছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ দিয়ে বেঁধে ফেলে। আর প্রধান জল্লাদ গিয়ে মুখে কালো টুপি পরিয়ে দেয়। এই টুপিকে বলা হয় যমটুপি। যমটুপি পরানোর কারণ হলো ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আসামি সবকিছু দেখে যেন জ্ঞান হারিয়ে না ফেলে। মঞ্চে তোলার পর দুই পা এক করে একটা ফিতা দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। যেন মঞ্চের কপাট খোলার সময় পা দিয়ে কোথাও ঠেস দিতে না পারে। সবকিছু ঠিকমতো হয়ে যাওয়ার পর প্রধান জল্লাদ গিয়ে আসামির গলায় দড়ি পরিয়ে দেয়। এরপর লিভার ধরে জেল সুপারের ইঙ্গিতের অপেক্ষায় থাকে। জেল সুপারও মঞ্চে উঠে জল্লাদের ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে থাকেন। তার হাতে থাকে লাল একটি রুমাল। রুমালটি উঁচিয়ে ধরে তিনি ঘড়ি ধরে সময় দেখতে থাকেন। প্রধান জল্লাদ আসামিকে কালিমা পড়তে বলেন। কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই জেল সুপারের হাত থেকে লাল রুমালটা খসে পড়বে। সেই সঙ্গে পৃথিবী থেকে ঝরে যাবে একটা তাজা প্রাণ। সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জেল সুপার রুমাল ছেড়ে দেন। সেটাই প্রধান জল্লাদের ইঙ্গিত। সেও সঙ্গে সঙ্গে লিভার টেনে দেয়। খুলে যায় দশ ফুট মঞ্চের উপরের জোড়া কপাট। কিছু বুঝে উঠার আগেই আসামি তার গলায় তীব্র ব্যথা অনুভব করতে থাকে। টানা সতেরো-আঠারো মিনিট একটা দড়ির সঙ্গে যুদ্ধ করে শেষমেশ হার মানতে হয়। সবকিছু স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকরা মঞ্চে উঠেন। স্টেথোস্কোপ দিয়ে পরীক্ষা করেন শরীরে কোথাও প্রাণের চিহ্ন আছে কিনা।
যেদিন ফাঁসি থাকে সেদিন জল্লাদের জন্য পোলাও, মাংস, বিরিয়ানিসহ ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। নিজেকে ভুলিয়ে রাখার জন্য মাঝে মধ্যে মদের বোতলও পাওয়া যায়। জল্লাদ শাহজাহান বলেন, একটা ফাঁসি শেষ হওয়ার পর আমি সাধারণত দুই থেকে তিন দিন বিশ্রামে থাকি। এরপর আবার সেলে ফিরে যাই। ফিরোজ পাগলার যখন ফাঁসির মুহূর্ত ঘনিয়ে আসছিল তখন জেল সুপারের সঙ্গে আমরাও যাই তাকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে আসতে। আমরা যখন ফিরোজ পাগলার হাত বাঁধতে যাই, তখন সে আমাদের ধমক দিয়ে বলে, ‘এই ছাড় আমারে। তোমরা কি আমার লগে দুষ্টামি করছো?’ তিন তিনটি খুন করার পর ফিরোজ তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। মানুষ তাকে ফিরোজ পাগলা বলেই ডাকতো। ধমক দিয়ে ছাড়তে বললেও ফিরোজ পাগলাকে আমরা ছাড়িনি। ছাড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। জোর করে হ্যান্ডকাফ বেঁধেই তাকে যমটুপি পরানো হয়। এরপর নিয়ে যাওয়া হয় ফাঁসির মঞ্চে।
এরপর ২০০৪ সালে ফাঁসি হয় কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদারের। ফাঁসি কার্যকরের স্থান নির্ধারণ করা হয় খুলনা জেলে। কোনো এক কারণে খুলনা জেলের কোনো আসামি বা সেখানকার কোনো জল্লাদ এরশাদ শিকদারের ফাঁসি দিতে চাইলো না। জল্লাদ শাহজাহানের ধারণা ছিল, তারা এরশাদ শিকদার ও তার পরিবারকে ভয় পেতো। তখন খুলনা জেলের জেলার ছিলেন ফরমান আলী। তিনি লোক পাঠালেন জল্লাদ শাহজাহানকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। শাহজাহান বলেন, আমার সঙ্গে সহকারী জল্লাদ হিসেবে নিলাম হাফিজুদ্দিন আর হারেসকে। ঢাকা জেল থেকে বের হয়ে দেখি সাংবাদিকরা ভিড় করে আছেন জেলগেটে। আমাদের তিন জনকে দাঁড় করিয়ে একটা ছবি নেয়া হলো। এরপর গাড়িতে উঠে রওনা হলাম খুলনার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সাংবাদিকরা কিছুতেই পিছু ছাড়ছিল না। আরিচা ঘাট পর্যন্ত তারা আমাদের পিছু পিছু গেল। খুলনা জেলগেটে গিয়ে রাত দুইটায় পৌঁছালাম। এরশাদ শিকদারের ফাঁসি তখনো তেইশ দিন বাকি। দেশে তখন যাতায়াত ব্যবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। আর কোনো একটা কারণে হরতাল-অবরোধ চলছিল। খুলনা জেলগেটে গিয়ে আমাদের হাত ও পায়ের বেড়ি খুলে ফেললাম। জেলে ঢোকার আগেই আমরা আমাদের কয়েদির পোশাক খুলে সাধারণ পোশাক পরে নিলাম। কারণ আমাদের প্রতি কড়া নির্দেশ ছিল যেন খুলনা জেলের কেউ আমাদের জল্লাদ পরিচয় জানতে না পারে।
প্রধান ওয়ার্ডের ত্রিশ নম্বর রুমে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। সেখানে খুব ভালো সময় কাটাতে শুরু করলাম। এরশাদ শিকদারের ফাঁসির তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল মে মাসের দশ তারিখ। জেলার, ডেপুটি জেলার, আর জেল সুপার ছাড়া এই তারিখটা আর কেউ জানতো না। ফাঁসির দিন সকালে জেলার সাহেব আমাদের বললেন কয়েদির কাপড় নিয়ে তৈরি থাকতে। কারণ কয়েদির কাপড় পরেই আমরা ফাঁসির মঞ্চে যাবো। সেদিন সকালেই জেলের সবাই জানতে পেরেছিল যে আজ রাত বারোটা এক মিনিটে এরশাদ শিকদারের ফাঁসি। তার পরিবারকেও খবরটা জানানো হলো। খবর পেয়ে সেদিন সকাল থেকেই তার পরিবারের সবাই এক এক করে এরশাদ শিকদারকে দেখতে আসছিল। তবে জেলখানা থেকে কড়া নির্দেশ ছিল কেউ যেন এরশাদ শিকদারকে সরাসরি ফাঁসির কথা না বলে। কারণ এর আগে যখন ফাঁসির রায় ঘোষণা হয়েছিল তখন এরশাদ শিকদার বলেছিল, ‘প্রয়োজনে আমি নিজের জান নিজে নেবো, তবুও ফাঁসির দড়িতে ঝুলবো না’। কিছুদিন পর ময়মনসিংহ থেকে চিঠি এলো সেখানে বাছের নামে এক আসামির ফাঁসির জন্য জল্লাদ লাগবে। চিঠি পেলে না করার আর কোনো সুযোগ ছিল না তার। তাই ফাঁসির পাঁচদিন আগে ময়মনসিংহ চলে গেলেন তিনি। এরপর ফাঁসি কার্যকর করে ঢাকা চলে এলেন। সাধারণ কয়েদির মতো থাকতে লাগলেন। শাহজাহান বলেন, ২০০৭ সাল। হঠাৎ একদিন খবর পেলাম কাশিমপুর জেলে দুইটা ফাঁসি হবে। বাকিদের নির্দেশনা দিয়ে ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করলাম। দুইটা ফাঁসি একসঙ্গে হওয়ায় প্রস্তুতিতেও বেশ সময় লাগছিল। কিন্তু কোনো কারণে মঞ্চ তৈরি হওয়ার পরও ফাঁসি হলো না। আমাদের জানানো হলো পরদিন ২৯শে মার্চ ফাঁসি হবে।
ফাঁসির আসামি ইফতেখার আল হাসান মামুন ও আতাউর রহমান সানিকে নিয়ে এলাম জল্লাদরা মিলে। তাদের পরানো হলো যমটুপি। এরপর রাত আটটা এক মিনিটে দু’জনের ফাঁসি একসঙ্গে কার্যকর করলাম। কফিনে ভরে লাশ এম্বুলেন্সে পাঠিয়ে দিলাম পরিবারের কাছে। দুই জনের ফাঁসি শেষ হওয়ার পরপরই ডিআইজি সাহেব আমাকে বললেন, শাহজাহান তোমার আরেকটা কাজে ময়মনসিংহ যেতে হবে র্যাবের গাড়িতে ওঠো। র্যাবের গাড়ির কথা শুনে আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম দুইজন জেএমবি সদস্যের ফাঁসি দিয়েছি, তাদের সব তথ্য ঢাকতে হয়তো আমাকেও মেরে ফেলবে। এই ভয় থেকে আমি র্যাবের গাড়িতে উঠতে চাইলাম না। ভয় পেতে দেখে ডিআইজি নিজের গাড়িতে আমাকে ময়মনসিংহ নিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে জানলাম বাংলাভাই ও আবদুল আউয়াল সেই জেলে আছেন। তাদের ফাঁসি আজ রাতেই হবে। আমি পৌঁছানোর আগে সেখানকার কয়েদিরা মঞ্চ প্রস্তুত করে রাখে। আমি গিয়ে শুধু ফাঁসির দড়িটা একবার দেখলাম। দুইজন আসামিকে একসঙ্গে যমটুপি পরিয়ে মঞ্চে আনা হলো। তবে বাংলাভাইয়ের মাথায় টুপি পরানোর আগে সে আমাদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘তার মৃত্যুর পর যেন কোনো ছবি তোলা না হয়। এরপর দু’জনকে মঞ্চে এনে পা বাঁধা হলো। রাত বারোটা এক বাজার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। পরে তাদের লাশ স্বজনদের কাছে পাঠানো হলো। দেশে সেবারই প্রথম কোনো জল্লাদ একরাতে চারটা ফাঁসি কার্যকর করেছিল। ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ের পর আসামি লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, লে. কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিন আহমদ (আর্টিলারি), মেজর (অব.) একেএম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার) ও মেজর (অব.) বজলুল হুদার ফাঁসির রায়ও কার্যকর করেন জল্লাদ শাহজাহান। এরপর ২০১২ সালে ১২ই ডিসেম্বর আবদুল কাদের মোল্লার ও ২০১৫ সালে ১১ই এপ্রিল রাত ১০টা ১ মিনিটে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর (সাকা চৌধুরী) ফাঁসির রায় কার্যকর করেন তিনি। তিনি বলেন, জল্লাদ হলেও আমি একজন রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। অনেকবার ফাঁসি দিতে গিয়ে আমার মধ্যে একটু- আধটু খারাপ লাগা কাজ করেছে। এরপরেও আরও বেশ কিছু ফাঁসি দিয়েছি বিভিন্ন জেলায় গিয়ে। আমার হিসেবে এই সংখ্যা ষাট। দীর্ঘসময় কারাভোগের পর জল্লাদ শাহজাহান নতুন জীবন শুরু করেন। কেরানীগঞ্জের গোলামবাজার এলাকার বড় মসজিদের মিনারের পাশেই চায়ের দোকান দেন তিনি।