শিক্ষাঙ্গন
শিক্ষা নিয়ে কেন এত আলোচনা?
পিয়াস সরকার
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বৃহস্পতিবার
একটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি; কোন ইস্যুটা দেশে বেশি আলোচিত- রাজনীতি নাকি শিক্ষা? একটু উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক। ২০২৩ সালটা ছিল বিভিন্ন দিক থেকে আলোচিত। পুরো বছর জুড়েই তাপ ছিল নির্বাচনের। ভোটের তাপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাপদাহও। ক্রীড়ামোদিরা উপভোগ করেছেন এশিয়া কাপ, ওয়ানডে বিশ্বকাপ। বছর জুড়েই আলোচনা কী হবে, কী হচ্ছে। তবে এই বছরের পরীক্ষাটা হলো ২০২৪ সালের শুরুতে। আলোচনা জল্পনা-কল্পনা হটিয়ে হয়ে গেল নির্বাচন। খুব একটা বেগ পায়নি আওয়ামী লীগ। কী হবে থেকে রাজনীতির দৌড়টা- হয়ে গেল। ২০২৩ সালে আলোচনা শুরু হয়েছিল পাঠ্য বই দিয়ে। আহ নতুন বই! এবছরই যাত্রা শুরু নতুন শিক্ষাক্রম। প্রথম চারমাসে শুধু শিক্ষার্থীরা বই-ই পেলেন। বই না মেলা, বইয়ের কাগজের মান কতো যে সমালোচনা ইয়ত্তা নাই। এই পর্যন্ত যদি সমালোচনার ফুলস্টপ দেয়া যেতো! কিন্তু না নতুন সমালোচনার শুরু যেন পরের থেকেই। বহমান নদীর মতো আঁকে বাঁকে আষ্টেপিষ্ঠে ধরে বইয়ের ভুল। যে আলোচনায় শিক্ষা প্রশাসন রীতিমতো ত্বরিতগতিতে নড়ে চড়ে বসে। সমালোচনার গতি বর্ষাকালে নদীর স্রোতের মতো প্রবাহিত হতে থাকে তখন চুপ থাকতে পারেননি সরকার। গঠন করে তদন্ত কমিটি। বলা যায়, ভুলের সব রেকর্ড যেন ভেঙে দেবার প্রতিযোগিতা। ভুলের সংশোধন আসে কিন্তু শাস্তি হয় না কারও। ২০২৩ সালে সমানতালে লড়াই চলে রাজনীতি ও শিক্ষার। শিক্ষায় গুণগত পরিবর্তন চায় সরকার।
প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে আনা হয় নতুন শিক্ষাক্রম। নতুন এই শিক্ষাক্রমের ধারা নিয়ে ইতিবাচক মনোবাসনা পোষণ করেন সিংহভাগ বোদ্ধা। তবে বাস্তবায়নের শঙ্কা কিন্তু থেকেই যায়। আমাদের অর্থাৎ গণমাধ্যমকর্মীদেরও আপ্যায়ন করে দেখানো হয় শিক্ষার নয়া মডেল। বাতিলের দাবিতে হয়েছে আন্দোলনও। নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ক্ষুব্ধ অনেক অভিভাবক। তারা বলছেন, এই শিক্ষাক্রমের কারণে উচ্ছে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত। ক্ষোভের কারণটা শিক্ষার্থীরা পড়তে বসছে না। স্কুলে কিছু শিখছে না। আমি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলাম। আমরা প্রথম বর্ষে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তখন খেয়াল করেছিলাম আমরা হরেক মানুষের সঙ্গে কমিউনিকেশন করতে পারছি না। অনার্সে উঠে পছন্দের বিষয়ে পড়তে এসেও। ফরিদপুর জিলা স্কুলে পড়ুয়া অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর (আদিব) সঙ্গে আমার কথা হয় নিয়মিত। তার বড় বোন একাদশের শিক্ষার্থী। আদিবের মুখে আমি হাসি দেখেছি সপ্তম শ্রেণিতে প্রথম। যে ছেলে স্কুলে না যাওয়ার বাহানা খুঁজতো। এখন সে স্কুলে যায় সবার আগে। যাতে প্রথম সারিতে বসতে পারে। আবার আদিব গ্রুপের লিডার হবার জন্য প্রথম হাতটাও নাকি তোলে। বাহ! শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে সবচেয়ে বেশি আপত্তি অভিবাকদেরই। দীর্ঘ দিন বছর যুগ ধরে সমাজে প্রচলিত সন্তান পড়ার টেবিলে বসবে। শুধু তাই নয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা শব্দ করে পড়বে। হবে প্রথম। কিন্তু তারা মেনে নিতে পারছেন না আমার ছেলে বা মেয়ে তো পড়ার টেবিলেই নাই। তাদের কাছে প্রশ্ন কী লাভ, মুখস্থ করে প্রথম হয়ে? ক্লাসের প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় হওয়া শিক্ষার্থীর কথাই শুধু ভাববেন। আর শেষ বেঞ্চে বসা ছেলেটা যে মুখ লুকিয়ে আছে তা দেখবেন না। ধরেন সে ছেলেটা জানে কীভাবে নেতৃত্ব দিতে হয়। সে রসায়নে ভালো করে কী করবে? সে তো ভবিষ্যতে সাকিব আল হাসান, মাহাথির মোহাম্মদ কিংবা জাস্টিন বিবার হতে চায়। এই মেধা কেন নষ্ট করছেন? প্রথম শ্রেণির বাচ্চাকে ১০-১২টা বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিতে আর ক্লাস কোচিংয়ের চাপে মানসিক রোগী বানাতে একটু কষ্ট হয় না।
আপনার বাচ্চাটা একটু বেড়ে উঠকু হাসি-মুখে। মানুষের মতো মানুষ হয়ে। আপনি আজ হাত ধরে চলছেন কাল সে একা চলতে পারবে তো? তাকে একা চলার শিক্ষাটা দিন। ক’দিন আগে আমার বউ পিঠা বানাতে পারে না; এনিয়ে সেকি ট্রল। কিন্তু আপনার ছেলে বা মেয়ে আপনার অবর্তমানে...কী লাভ যদি আপনার আদরের সন্তানটা ভালো না থাকে। কষ্ট নিয়ে মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে বড় হয়। শিক্ষাক্রম একেবারেই নতুন, আছে নানা মসৃণ করবার সুযোগ। তা কিন্তু করতেই হবে। নতুন একটি শিক্ষাক্রম চালু হলো কিন্তু শিক্ষকরাই জানেন না কী করতে হবে। শিক্ষকদের মেলেনি যথেষ্ট ট্রেনিং। শিক্ষকদের প্রস্তুত করেই চালু করা উচিত ছিল নতুন শিক্ষাক্রম। আর অ্যাসাইনমেন্ট করতে খরচ বেড়েছে অভিভাবকদের। এটা নিয়ে একটা পরিকল্পনা থাকা উচিত সরকারের। কারণ চরাঞ্চলে যেখানে একটা কলম বা খাতা কেনার জন্য পরিকল্পনা করতে হয় অভিভাবককে তারা কীভাবে কী করবেন এটার একটা স্পষ্ট রূপরেখা থাকা উচিত। বেসিক বিষয় যেমন গণিত, ইংরেজির ভিত মজবুতকরণে বাস্তবতাসম্পন্ন পরিকল্পনা থাকা উচিত। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির ফাইলটা থাকা চাই টেবিলে। এমন যাতে না হয়, অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করার জন্য গড়ে উঠে নতুন কোচিং সেন্টার। এখন যেহেতু শিক্ষকের হাতে অনেক নম্বর।
শিক্ষার্থীরা যাতে শিক্ষকের কোচিং বা টিউশনিতে যেতে বাধ্য না হয়। একটা গল্প শোনা যায়, সত্য মিথ্যা জানা নেই। আইনস্টাইনকে নোবেল জয়ের পর কেউ একজন প্রশ্ন করেছিলেন, এক মাইল সমান কতো কিলোমিটার? তিনি বলতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন, যে জিনিস আমি বইয়ে পাবো তা মুখস্থ রেখে কী হবে। এবার আসি বইয়ের কন্টেন্ট নিয়ে। শরীফ থেকে শরীফার গল্প এখন সবার মুখে মুখে। আছে নানা ভুল নিয়ে আলোচনা। এই আলোচনা-সমালোচনা হয়তো অনেকাংশেই যৌক্তিক। এবার আসি প্রথম লাইনে লেখা কোন ইস্যুটা বেশি দেশে আলোচিত; রাজনীতি নাকি শিক্ষা? এই দৌড়ে ঢের এগিয়ে শিক্ষা। বর্তমানে ইন্টারনেটে মেলা রাজনৈতিক আলোচনার ভিউ কমতে শুরু করেছে। কিন্তু ২০২৪ সালের দৌড়টা ভালোই দিয়েছে শরীফ থেকে শরীফার গল্প। শিক্ষা নিয়ে আলোচনা চলছেই। হয়তো সামনেও চলবে। রাজনীতির আলোচনা এখন ম্রিয়মান। কিন্তু শিক্ষার আলোচনা ঊর্ধ্বমুখী। হবেই না কেন? প্রায় প্রতিটি ঘরেই যে শিক্ষার্থী। আর রাজনীতি নিয়ে ভাবার লোক এখন এই গ্রামে দু’জন, পাশের গ্রামে একজন। কিন্তু প্রতিটি গ্রামে শিক্ষার্থী কতো আপনিই বলুন?
পাঠকের মতামত
বাংলার শিক্ষাগতি জাফর হাসান মাহমুদ ~~~~~~~~~~~~~~~ যে শিক্ষা জাতির আলো যে শিক্ষা জাতির শক্তি সে শিক্ষার আজ হলো কি? চারিদিকে শিক্ষার নিস্প্রভ দেখি এই বুঝি হয়ে এলো পরিসমাপ্তি এ জাতির শিক্ষার প্রদীপ খানি। এ জাতির শিক্ষার অগ্রগতি কি উপায় ঘটাবে তুমি? বিদ্যমান এরা করে দিচ্ছে যে জাতির শিক্ষার অবনতি। পড়শীর বিস্তীর্ণ আর বৈরিতায় যে মন্থর বাংলার শিক্ষা গতি। যে শিশুর হাতে থাকবে বর্ণমালা তার হাতে আজ বোঝা ভরা। যে তরুণ থাকবে পাঠগৃহে সে তরুণ আজ ভবঘুরে যারা থাকবে গবেষণা গারে তারা নেশার আসরে নৃত্যলিলাতে। যারা সন্ধা নামিতে গৃহে ফিরে পড়ার কক্ষে মজিবে মনোনিবেশে। তারা এখন নির্জনবন নদী আর রাস্তার পাশঘেঁষে বসে আছে গেমস ও নেশার সঙ্গম নিয়ে। নেই কেহ তা দেখার শাসকের যে দরকার ক্ষমতার জাতির শিক্ষার কি দরকার? জাতি হবে যতো নির্বোধ শাসকের হবে ততো আমোদ। কে ধরিবে এই হাল ভেঙে গেছে যে পাল। এ জাতির শিক্ষাতরী যাচ্ছে ভাসি কে ফেরাবে এই হাল? উজানে বাহিবে এই তরী। আসো কোনো বীর জোয়ান ধরে রাখো এই হাল নয় তো নিবে যাবে এ জাতির শিক্ষার আলোকশক্তিবল।