প্রথম পাতা
জাবিতে মাদকের ৮ সিন্ডিকেট, ফোন দিলেই মেলে ডেলিভারি
পিয়াস সরকার ও ইমরান হোসাইন হিমু
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, সোমবার
বিস্তৃত ক্যাম্পাস। চারদিকে সবুজের সমারোহ। সুন্দর পরিপাটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্যের মাঝে লুকিয়ে ভয়াল মাদকের থাবা। গাঁজা থেকে হিরোইন- সবকিছুই সহজলভ্য এখানে। এমনকি ফোন দিলেই চলে আসে ডেলিভারি। গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি
স্বামীকে আটকে রেখে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার পর আলোচনায় এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মাদক সিন্ডিকেট। ওই ঘটনার পর কিছুটা আড়ালে রয়েছেন মাদক কারবারিরা। ক্যাম্পাসে মাদক সিগারেটের মতো সহজলভ্য। কয়েকটি স্পটে মাদক কেনাবেচা হয় দেদারছে।
ক্যাম্পাসে সরজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায় এখানে মাদক বিক্রিতে অন্তত আটটি সিন্ডিকেট সক্রিয়। তারা হলে এবং হলের বাইরে বিভিন্ন স্পটে মাদক সরবরাহ করে। এই মাদক কেনাবেচাকে কেন্দ্র করে আরও অনেক ধরনের অপরাধও হয়ে থাকে এখানে।
জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দোকানের পাশেই পাওয়া যায় গাঁজা। ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে নিয়ে এসে বিক্রি করে চলে যায়। তাদের নির্দিষ্ট সময় থাকে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ট্রান্সপোর্ট এলাকায় সন্ধ্যার পর তিন দফায় বিক্রি হয় গাঁজা। আর যেকোনো সময় কিনতে চাইলে ফোন দিতে হয়। তার ভাষ্যমতো আধা ঘণ্টার মধ্যেই চলে আসে গাঁজা।
বিষয়টি যাচাই করতে তাকে অনুরোধ করার পর তিনি একটি নম্বরে ফোন দিলেন। তাকে বলা হলো ছোট একটা সবজি আনতে। ঠিক ২০ মিনিটের মাথায় সাইকেলে করে এলেন ট্রান্সপোর্ট এলাকায়। তার চোখে-মুখে ভয় স্পষ্ট। ‘সবজি’র দাম ৮০ টাকা আর ডেলিভারি চার্জ ২০ টাকা। তিনি ২০ টাকা বেশি দাবি করলেন। ওই ব্যক্তি যে সবজি বহন করে এনেছিলেন তা আসলে গাঁজা। ক্যাম্পাসে এমন নানা নামে বিভিন্ন মাদকের নামকরণ করা হয়েছে। বিভিন্ন সাংকেতিক নামেও মাদক সরবরাহের অর্ডার দেয়া হয়।
গল্পের ছলে ডেলিভারি দিতে আসা তরুণ বলেন, কয়েকদিন ধরে ক্যাম্পাসে ঢুকি না। ভয়ও লাগে। আপনারাও ফোন দেন না এখন খুব একটা।
তার কথা অনুযায়ী জানা যায় মেয়েদের হলেও যায় গাঁজা। জাহানারা ইমাম হলের আবাসিক এক শিক্ষার্থী বলেন, এটা নতুন কিছু না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সংলগ্ন স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্যাম্পাসে দুই ধরনের মাদক মিলে। তাদের ভাষায় ছোট মাল আর বড় মাল। ছোট মাল হচ্ছে গাঁজা। এটা যত্রতত্র যেখানে সেখানে পাওয়া যায়। আর বড় মালের জন্য যেতে হয় ক্যাম্পাসের বাইরে। বড় মাদকের মধ্যে আছে ইয়াবা। এ ছাড়াও বিক্রি হয় হেরোইন, মদ ও ফেনসিডিল। এগুলো বিক্রির প্রধান স্পট ক্যাম্পাস সংলগ্ন আমবাগান ও ইসলামপুর এলাকা। ‘বড় মাল’ ক্যাম্পাসের বাইরে পাওয়া গেলেও এটিও মেলে হোম ডেলিভারি। আবার ক্যাম্পাসের বাইরে থেকেও মাদক সেবন ও কিনতে আসেন অনেকে। এই মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রিত হয় আটটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। প্রত্যেকটি সিন্ডিকেটের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীসহ বহিরাগতরা জড়িত। এই মাদক সিন্ডিকেট মূলত আমবাগান ও ইসলামপুর এলাকা থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। তাদের অনেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত বা তাদের প্রশ্রয়ে এসব কারবার করেন।
আমবাগান ও ইসলামপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ব্যাপক উপস্থিতি। তারা এখানের বিভিন্ন বাড়িতে মেস করে ভাড়া থাকেন।
চারুকলা বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, এখানে ওপেনলি কোনো তথ্যই পাবেন না। মাদক সাধারণত বিভিন্ন বাসা ও দোকানের আড়ালে সংরক্ষণ করা হয়। এরপর চাহিদামতো সরবরাহ করা হয়। আমবাগান এলাকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামাওয়াত খান বলেন, এখানে বিভিন্ন আয়োজনের জন্য মাদক খুবই কমন বিষয়। এমনকি বিভিন্ন নামিদামি বারে যেসব মদ পাওয়া যায় সেগুলোও খুব সহজেই পাওয়া যায়।
যাচাই করার জন্য সামাওয়াতকে অনুরোধ করার পর তিনি ফোন দেন এক নম্বরে। তিনি এক ধরনের মাদকের নাম বলে জানতে চান দেয়া যাবে কিনা। অপরদিক থেকে ওই ব্যক্তি বলেন, এখন ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি খারাপ; তাই এখন দেয়া যাবে না। সপ্তাহখানেক পর ফোন দিতে বলেন।
সংঘবদ্ধ ধর্ষণকাণ্ডের পর র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) সংবাদ সম্মেলনে জানায়, মাদক ব্যবসার আড়ালে দীর্ঘদিন ধরেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ধর্ষণের শিকার ভুক্তভোগীদের অনেকে ভয় এবং লজ্জায় মুখ খোলেন না বলেও জানিয়েছে তারা। আলোচিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলরুমের একটি কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনায় পুরো দেশ যখন তোলপাড় তখন এই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত মামুনুর রশিদ ওরফে মামুনকে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা এবং ধর্ষণের অন্যতম সহায়তাকারী মো. মুরাদকে নওগাঁ থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ক্যাম্পাসে ও এর আশেপাশে মাদক ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের মধ্যে প্রায়শই বিবাদ লেগে থাকে। অনেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন, আবার জামিনও পেয়েছেন। তবে মাদক মাফিয়ারা থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণকারীদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী নেতাদের নাম এসেছে। আবার ছাত্রলীগ নেতাদের মাসোয়ারা দিয়েও মাদক ব্যবসা করছেন অনেকে। জাবি ছাত্রলীগের পদধারী ৪০০ জনের মধ্যে ৩০০ জনের ছাত্রত্ব নেই। এরাই মূলত হলে সিট দখল করে মাদক ব্যবসা পরিচালনা করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্বামীকে আটকে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী মো. মামুনুর রশিদ মামুনও মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত ছিল। ২০১৭ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে অবস্থান করে মাদক ব্যবসা চালাতো সে। মাসে তিন থেকে চার দফায় কক্সবাজার থেকে সাত থেকে আট হাজার পিস ইয়াবা এনে বিশ্ববিদ্যালয়সহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিক্রি করতো সে। তার ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতারা জড়িত। ছাত্রলীগের একটি চক্রের সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সামনে এবং বটতলা এলাকায় মাদক বিক্রি করতো মামুন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলে মামুনের সরবরাহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতো ধর্ষণের ঘটনায় অপর অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর রহমান। নয়ারহাটের দায়িত্বে টিটু, বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী বটতলা বাজারে নুরু, কলমাতে মামুনের ভাগ্নে আতিক, বিশমাইলে হাসান নামে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি এসব হটস্পটের সরবরাহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতো। এ ছাড়াও ক্যাম্পাসে জনি নামে অপর এক ব্যক্তিও মামুনের মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত বলে জানা যায়।
মামুনের চট্টগ্রামের সরবরাহকারী ছিল আরিফ নামে এক ব্যক্তি এবং কক্সবাজারের সরবরাহকারী ছিল সাইফুল ইসলাম বাপ্পী। ইয়াবা কারবারের সঙ্গে জড়িত মামুনকে বেশ কয়েকবার যেতে হয়েছে কারাগারে। কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি পুনরায় মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়তো। মামুনের বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানা, বগুড়া সদর থানা, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানা এবং কক্সবাজারের টেকনাফ থানায় পৃথক চারটি মাদক মামলা রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের ৪৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান অনিক, মীর মশাররফ হোসেন হলের এই ইয়াবা চক্রের মূল হোতা। মীর মশাররফ হোসেন হলে সে ‘গুটি অনিক’ নামে পরিচিত। এর আগে, ৪৩তম ব্যাচের শিক্ষা সমাপনী উৎসবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এম্বুলেন্সে মদ আনতে গিয়ে বংশাল থানায় আটক হয় এই শিক্ষার্থী। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব হোসাইন বর্তমানে এই ব্যবসার মূল হোতা। এ ছাড়াও মামুনের ইয়াবা সিন্ডিকেটের সঙ্গে ৪৩তম ব্যাচের একজন, ৪৪তম ব্যাচের শাহ পরাণসহ আরেকজন এবং ধর্ষণকাণ্ডের মূল অভিযুক্ত ৪৫তম ব্যাচের মোস্তাফিজুর রহমান জড়িত। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রাঙ্গামাটি এলাকায় মাদক ব্যবসা করেন ফরিদ হোসেন ওরফে পাঞ্চু। ফরিদের কাছ থেকে দৈনিক ২ হাজার টাকা চাঁদা নিতেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সাব্বির হোসেন নাহিদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান জয়। তবে চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় গত বছরের ১৬ই জুলাই নাহিদ ও জয়ের নেতৃত্বে ফরিদকে তুলে এনে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায় করেন ছাত্রলীগের নেতারা।
ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের আহ্বায়ক আলিফ মাহমুদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে হাত বাড়ালেই মাদক পাওয়া যায়। ছাত্রলীগের আশ্রয়ে এসব মাদক ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। প্রশাসনের এদিকে বিশেষ নজর দেয়া উচিত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার প্রধান সুদীপ্ত শাহিন বলেন, শিক্ষার্থীরা মাদক গ্রহণ করে কিনা সেটি দেখভাল করার দায়িত্ব প্রক্টরের। বহিরাগত কেউ ছদ্মবেশে মাদক সাপ্লাই দিতে ক্যাম্পাসে আসলে আমরা তাদের ধরবো কীভাবে? যদি না প্রক্টরিয়াল টিমের সহযোগিতা পাই। অপরাধে জড়িত কাউকে আটকালে তো ছাড়িয়ে নিতে ক্যাম্পাসে লোকজনের সুপারিশের অভাব হয় না।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেল ও সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটনকে একাধিকবার বিভিন্ন মাধ্যমে চেষ্টা করেও বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
পাঠকের মতামত
বাংলাদেশে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে হবে তা না হলে শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস নিশ্চিত।
কোত্থেকে শুরু করব, তা-ও বুঝতেছিনা।
This is the right time to close this education centre. We can utilize this place for treatment purposes ONLY.
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড এ কথা আমরা সবাই জানি কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার যে অবস্থায় চলছে এতে একটা জাতিকে সহজে পথভ্রষ্ট করার জন্যই সহজ উপায়। একটা জাতিকে ধংস করতে প্রথমেই শিক্ষা ব্যবস্থা ধংস করা হয় আর এটাই বাংলাদেশে চলছে।