শরীর ও মন
হাইহিল জুতার বিপদ ও প্রতিকার
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবদুল হাই
৩০ জানুয়ারি ২০২৪, মঙ্গলবারহাইহিল জুতা আধুনিক ফ্যাশনের একটি অনুষঙ্গ। যাদের শারীরিক উচ্চতা কম তারা তো বটেই, অন্যদেরও পছন্দের উপর দিকে রয়েছে হাইহিল জুতা। অনেকেই মনে করেন এটা নারীদের আত্মবিশ্বাস ও ব্যক্তিত্ব বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু এটা অনেকেরই অজানা যে হাইহিল জুতায় লুকিয়ে আছে অনেক বিপদ।
প্রকৃতিগতভাবে মানব শরীর তার নির্দিষ্ট কিছু গাঠনিক বা এনাটমিক কারণে নির্দিষ্ট কিছু দেহভঙ্গিতে অভ্যস্ত। এর বাইরে গেলেই শরীরের বিভিন্ন অস্থিসন্ধিতে নানা ধরনের বিপত্তি সৃষ্টি হয়। মানব ইতিহাসের দিকে তাকালে লক্ষ্য করা যায়, আধুনিক যুগের আগে পুরো সব যুগেই মানুষ খালি পায়ে হাঁটতে অভ্যস্ত ছিল। খালি পায়েই মানুষ হেঁটেছে, কাজ করেছে। মানুষের শরীরের দেহ ভঙ্গি বা অ্যালাইনমেন্ট খালি পায়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। হাই হিল জুতা পুরো শরীরের ভারসাম্যই অন্যরকম করে দেয়। সাধারণভাবে, স্বাভাবিক অবস্থায় পা বা গোড়ালি বহন করে শরীরের ৬০ শতাংশ ওজন। হাইহিল পরার পর আঙ্গুলের দিকে অর্থাৎ পায়ের পাতার সামনের দিকে ভর দিতে হয় বেশি। পায়ের সামনের অংশ অর্থাৎ আঙ্গুলগুলো এবং সংশ্লিষ্ট হাড়গুলো সব সময় হালকা গড়নের হয়ে থাকে, পুরো শরীরের ভার নেয়ার মতো সক্ষমতা এ অংশের নেই। তাই একনাগাড়ে দীর্ঘক্ষণ ও দীর্ঘদিন হাইফিল পরার ফলে বিপত্তি আসে নানা দিক থেকেই।
হাই হিল পরার ফলে কি কি সমস্যা হয়?
* হাইহিল দীর্ঘক্ষণ পরার ফলে পায়ের সামনের দিকে ও গোড়ালিতে এক ধরনের প্রদাহের সৃষ্টি হয়। দীর্ঘক্ষণ হিল পরার ফলে গোড়ালিতে ব্যথা হয়। অনেকের আবার পায়ের ও উরুর মাংসপেশীতে ব্যথা হয়।
* জুতো খোলার পর অনেকেরই গোড়ালির নিচের দিকে জ্বালা-জ্বালা ভাব থাকে। চিকিৎসার ভাষায় যাকে বলে ‘প্লান্টার ফ্যাসাইটিস’।
* ‘হ্যামার টো’ নামে পায়ের আঙ্গুলের এক ধরনের গাঠনিক পরিবর্তন হওয়ার আশঙ্কাও বাড়ে। অনেকে আবার স্টিলেটো নামে এক ধরনের হাইহিল জুতা পরেন। সেক্ষেত্রে জুতার সামনের দিকটা হয় খুব সরু। এতে একটা আঙ্গুলের উপর আর একটা আঙ্গল খুব চেপে থাকে। দীর্ঘদিন এই চাপা জুতা পরার ফলে পায়ের আঙ্গুলের দু’পাশের হাড়ে ‘বুনিয়ন’ নামে হাড়ের এক ধরনের বিকৃতিজনিত রোগ হয়।
* হাইহিল জুতা পরিহিতাদের ক্ষেত্রে প্রায় সময়ই পা মচকে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। বৃটেনের একটি সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, হাইহিল স্যান্ডেল পরার ফলে পড়ে গিয়ে ফ্র্যাকচার হওয়ার হার অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি।
* আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো হিল পরলে হাঁটু সামান্য ভাঁজ হয়ে থাকে একই সঙ্গে হিপ জয়েন্টে একটু ভাঁজের সৃষ্টি হয়। একারণেও সমস্যা আসতে পারে। হাঁটু ও কোমরের অস্থিসন্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কম বয়সেই অস্টিওআর্থ্রাইটিস হতে পারে।
* পায়ের ত্বকে নানা ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। পায়ের নিচে ত্বক শক্ত হয়ে কর্ন বা কেলাস নামে রোগের সৃষ্টি হতে পারে। একইভাবে পায়ের ত্বকের সামনের অংশে কেরাটোসিস নামে ত্বকের রোগের সৃষ্টি হতে পারে।
* ১১ থেকে ১৪ বছরের কিশোরীদের হিল পরা একেবারেই অনুচিত। কারণ, এটা বাড়ার বয়স। এই সময় পায়ে গঠনগত ত্রুটি হলে তা সারাজীবন থেকে যাবে।
এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, তাহলে কি হিল পরা হবে না?
উত্তর হলো, অবশ্যই পরবেন তবে মাঝেমধ্যে এবং স্বল্প সময়ের জন্য। হিলের সাইজ হবে এক থেকে দেড় ইঞ্চি। আর যদি অনুষ্ঠান বিশেষে আরও উঁচু হিল পরার শখ হয়, তাহলে তা তিন ঘণ্টার বেশি নয়। দরকার হলে ব্যাগে জুতা নিয়ে যান। অনুষ্ঠানে ঢোকার আগে হিল জুতা পরুন। অনুষ্ঠান শেষে আবার ফ্ল্যাট চটি পরুন। উঁচু হিল খুলে রাখার পর অবশ্যই পায়ের পাতার এক্সারসাইজ (পায়ের নিচে বল রেখে রোল) করুন। বাড়ি ফিরে হিল খুলে রেখে গরম পানিতে পা ডুবিয়ে রাখুন এবং ঘরে মাঝেমধ্যে খালিপায়ে হাঁটার চর্চা করুন। সমস্যার ব্যাপ্তি অনুয়ায়ী প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
লেখক: (চর্ম, যৌন ও এলার্জি রোগ বিশেষজ্ঞ), জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
চেম্বার-১২, স্টেডিয়াম মার্কেট, সিলেট। ফোন- ০১৭১২২৯১৮৮৭