নির্বাচিত কলাম
সাফ কথা
তিন চিমটি ‘ডিগবাজি’ ও এক মুঠো ভোটের গল্প
কাজল ঘোষ
৩ ডিসেম্বর ২০২৩, রবিবারফি-বছর পর পর নির্বাচন আসে। ভোটে অংশগ্রহণ হোক আর না হোক মনোনয়ন বাণিজ্য কমবেশি সব রাজনৈতিক দল করে। আর এই বাণিজ্যের একটি থাকে প্রকাশ্যে আর আরেক অংশ থাকে নেপথ্যে। ইতিমধ্যেই যারা মনোনয়ন পেয়েছেন বাজারে কান পাতলে শোনা যায় কে কতো টাকায় নমিনেশন কিনেছেন? তার কতোটা সত্য আর কতোটা রটনা তা নির্বাচনে মাঠে থাকা প্রার্থীরাই বলতে পারবেন। তেমনি এক প্রার্থী মনোনয়ন চাইতে ধরনা দিচ্ছেন নেতা, পাতি নেতা এমনকি দূর আত্মীয়দের বাড়ি পর্যন্ত। হঠাৎ মনোনয়ন পেতে ইচ্ছুক এক প্রার্থী গভীর রাতে হাজির হলেন এক বাসায়
স্বৈরশাসক এরশাদের সময়কার কথা। টানা নয় বছর জগদ্দল পাথরের মতো এরশাদ চেপে বসেছিল জাতির বুকে। আর এই লম্বা সময় অগণতান্ত্রিক শাসন টিকিয়ে রাখতে নানা নাটক মঞ্চস্থ করতেন এই মৌ-লোভী। ক্ষমতার শুরুর দিন সাইকেল চালিয়ে অফিসে এসে চমক দেখিয়েছিলেন এরশাদ। তারপর জুম্মাবার একেক মসজিদে গিয়ে নামাজ পরা। দেশের নানাপ্রান্তে পীরদের ডেরায় গিয়ে হাজির হওয়া। এমনকি নিজের পালক পুত্র নিয়েও করেছেন সাবেক এই প্রেসিডেন্ট অনেক নাটক। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে দল ভাঙা-গড়ার খেলা চালিয়েছেন পুরো সময়জুড়ে। এরশাদের সময় রাজনীতিক, কবি, সাহিত্যিক ক’দিন পরপরই কেনাবেচা হয়েছে। চলেছে বহু রকমের ডিগবাজি। তেমনি একটি ডিগবাজির শোনা গল্প এমনÑ ছিয়াশির নির্বাচনে দল থেকে ভাগানোর নানা খেলা এরশাদ তার গোয়েন্দাদের দিয়ে করিয়েছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনার একটি বিএনপি’র সাবেক মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমানের দলবদল। সংস্থাবিশেষের সঙ্গে ওবায়দুর রহমানের যোগাযোগ হয়েছে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবেন তিনি। অথচ একটি বড় দলের মহাসচিব। খবরটি তৎকালীন সাতদলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে অনেকটা আগেই পৌঁছায়। তিনি এ নিয়ে খুব একটা সময় নষ্ট না করে কে এম ওবায়দুর রহমানকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। ওবায়দুর রহমান বহিষ্কারাদেশ পাওয়ার নিকটতম সময়ে প্রেসিডেন্ট এরশাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে দেখা করতে যান। এরশাদ রাষ্ট্রীয় কাজের অজুহাতে এক ঘণ্টা, দু’ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করিয়ে ওবায়দুর রহমানকে ভেতরে ডেকে নেন। যথারীতি হ্যান্ডশেক করতে করতেই বলে বসেন, অনেকগুলো কাজের ব্যস্ততায় আপনাকে অনেকটা সময় বসিয়ে রাখলাম। বলুন তো কী বিষয়? এরশাদের শিথিল চেহারা দেখে ওবায়দুর রহমান অবাক। বললেন, আমি তো জাতীয় পার্টিতে যোগ দেয়ার জন্য প্রস্তুত আছি। এরশাদ তখন ইউটার্ন করলেন তার অবস্থান থেকে। ওবায়দুর রহমানের দিকে উদাসীন দৃষ্টি নিয়ে বললেন, ওবায়দুর রহমান সাহেব আমি তো বিএনপি’র মহাসচিবকে আমার দলে ভেড়াতে চেয়েছি; কোনো বহিষ্কৃত বিএনপি নেতাকে নয়। শোনা যায়, এরপর ওবায়দুর রহমানের আর জাতীয় পার্টিতে যাওয়া হয়নি। এরশাদের পাইক পেয়াদাদের চাপে পরে জনতা দল গঠন করে পৃথক পার্টি হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। ইতিহাস বলে তিনি ও তার পার্টির নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছিল। পরে ১৯৯১ সালে নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করলে তিনি আবারো বিএনপিতে ফেরেন। পরে ১১৯৬ ও ২০০১ সালে ফরিদপুর-২ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শেষদিন পর্যন্ত তিনি জাতীয়তাবাদী দলের জার্সি পরেই ছিলেন। গল্পটি সত্য-মিথ্যা যাই হোক কিন্তু ডিগবাজির রাজনীতি আমাদের এখানে সুখকর নয়। মূলধারার পক্ষে যারা রাজপথের লড়াইয়ে থেকেছে, তারাই টিকেছে- ইতিহাস অন্তত তাই বলে।
ওটিটি প্ল্যাটফরম চরকিতে ‘সামথিং লাইক অ্যন অটোবায়োগ্রাফি’ তিশা ফারুকীর জীবন নিয়ে একটি ছবি মুক্তি পেয়েছে। ছবিটির প্রচারণায় একটি ডিগবাজির ভিডিও চাঞ্চল্যের জন্ম দিয়েছে। ভাইরে ভাই! একসাথে সব ভাইরাল ভাই! এই শিরোনামে প্রায় দু’মিনিটের একটি ভিডিও দেখা যায় জায়েদ খান, শাহরিয়ার নাজিম জয়, নাসির উদ্দিন খান, মারজুক রাসেল ও আশুতোষ সুজন অপেক্ষা করছে। ছবিটির পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীও আছেন তাদের সঙ্গে। শুরুতেই মোস্তফা সরয়ার ফারুকী মারজুক রাসেলের কাছে জানতে চায় ৩০ নভেম্বর ‘সামথিং লাইক অ্যন অটোবায়োগ্রাফি’ ছবিটি আসছে এটা পাবলিককে কীভাবে জানানো যায়। উপায়টা কি? মারজুক রাসেল আশুতোষ সুজনের দিকে একই প্রশ্ন ঠেলে দিলেন, উপায়টা কি বল তো? সুজন পাশে বসা সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত অভিনেতা নাসির উদ্দিন খানকে লক্ষ্য করে বলেন- ভাই, আপনি তো ভাইরাল। ‘সামথিং লাইক অ্যন অটোবায়োগ্রাফি’ ছবিটি পাবলিককে কীভাবে জানানো যায়? একটা আইডিয়া দেন? অভিনেতা নাসির উদ্দিন আমি তো শিশু ভাইরাল বলে শাহরিয়ার নাজিম জয়ের দিকে লুক দিয়ে বলে ওঠেন, ভাইরালের বাপ বসে আছে, তারে জিগাও। শুনেন নাসির ভাই বলে অভিনেতা জয় বলেন, সবসময় ভাইরালের বাপ দিয়ে কাজ হয় না। বাপেরও বাপ থাকে। জয় জায়েদ খানের দিকে লক্ষ্য করে বলেন, এই যে ভাইরালের দাদা। ভাই, আপনি কইয়া দেন কেমনে কি করার? পাঞ্জাবি পরে পারবেন ডিগবাজি দিতে? জায়েদ খান- যে পারে সে কাপড় পরেও পারে, কাপড় ছাড়াও পারে বলে হাতের ঘড়ি খানা খুলে জয়ের কাছে রেখে পাঞ্জাবির হাত গুটিয়ে তিনবার ডিগবাজি দিয়ে ক্যামেরায় বলেন, ‘সামথিং লাইক অ্যন অটোবায়োগ্রাফি’ দেখতে চোখ রাখুন। না হলে ডিগবাজি দিয়া যেকোনো সময় যেকোনো ঘরের দরোজা দিয়ে ঢুকে পড়বো। ফিল্মের ডিগবাজির গল্প এখানেই শেষ। তবে এই আইডিয়াটি প্রচারণার ক্ষেত্রেই দুর্দান্ত হয়েছে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
ফিল্ম থেকে রাজনীতির মাঠে চোখ রাখি, কি দেখছি, নানান ডিগবাজির খেলা। সবচেয়ে আলোচনায় শাহজাহান ওমর। নির্বাচনে অংশ নেয়ায় সব মামলায় দ্রুতগতিতে জামিন নিয়ে তিনি এখন নির্বাচনের মাঠে। আদালত থেকে জামিনে কারামুক্তি পাওয়ার পরদিনই বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হিসেবে ঝালকাঠি-১ আসনে জমা দিলেন মনোনয়নপত্র। ৩০শে নভেম্বর রাজধানীর কাওরান বাজারের ইউটিসি ভবনে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছেন, আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ তাকে ঝালকাঠি-১ আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছে। অথচ ঝালকাঠি-১ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত যে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তাতেও এই আসনে বজলুল হকের নাম রয়েছে।
পেছনের ঘটনাবলী খেয়াল করলে দেখা যাবে, শাহজাহান ওমরকে ৪ঠা নভেম্বর রাতে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন তাকে ঢাকার নিউমার্কেট থানার বাসে আগুন দেয়ার একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। ওই মামলায় তাকে তিন দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। রিমান্ড শেষে বুধবার ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে জামিন পান শাহজাহান ওমর। সন্ধ্যার পরেই কেরানীগঞ্জে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। উল্লেখ্য, গত ২৮শে অক্টোবর বিএনপি’র মহাসমাবেশের দিন প্রধান বিচারপতির বাসভবন ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশ সদস্য হত্যা ও অগ্নিসংযোগের নির্দেশদাতা হিসেবে করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
জনমনে শাহজাহান ওমরের এই ডিগবাজি নিয়ে সাদামাটা কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা, তাহলে নির্বাচনে অংশ নিলেই আনীত সব অভিযোগ মাফ হয়ে যাবে। আর সফেদ ও কলঙ্কমুক্ত হয়ে নির্বাচনী মাঠ দাপিয়ে বেড়াবে। তাহলে আইনকানুন বলে কিছু নেই। সবই কোনো না কোনো ইশারাতে আবর্তিত হচ্ছে।
শেষ করতে চাই ভোটরঙ্গের দুটি গল্প বলে। ২০১৮-এর নির্বাচনে অংশ নেয়া দলছুট এক নেতার জামানত বাজেয়াপ্ত হলে একটি গল্প চাউর হয়েছিল। গল্পটি এমন: ভোটে জামানত হারানো নেতা মাত্র তিন ভোট পেয়েছিলেন। দিনের ভোটের হিসাবনিকাশ শেষ করে রাতে বাসায় ফিরলে তার স্ত্রী ঐ নেতার কাছে জানতে চান, বুঝলাম একটি ভোট আমি স্ত্রী হিসেবে তোমাকে দিয়েছি, আর তুমি নিজের ভোট দিলে কিন্তু অন্য যে ভোটটি সেটি কে দিলো? নিশ্চয়ই তোমার অতি ঘনিষ্ঠজন কেউ আছে, না হলে এই একটি ভোট তুমি কী করে পেলে?
ফি-বছর পর পর নির্বাচন আসে। ভোটে অংশগ্রহণ হোক আর না হোক মনোনয়ন বাণিজ্য কমবেশি সব রাজনৈতিক দল করে। আর এই বাণিজ্যের একটি থাকে প্রকাশ্যে আর আরেক অংশ থাকে নেপথ্যে। ইতিমধ্যেই যারা মনোনয়ন পেয়েছেন বাজারে কান পাতলে শোনা যায় কে কতো টাকায় নমিনেশন কিনেছেন? তার কতোটা সত্য আর কতোটা রটনা তা নির্বাচনে মাঠে থাকা প্রার্থীরাই বলতে পারবেন। তেমনি এক প্রার্থী মনোনয়ন চাইতে ধরনা দিচ্ছেন নেতা, পাতি নেতা এমনকি দূর আত্মীয়দের বাড়ি পর্যন্ত। হঠাৎ মনোনয়ন পেতে ইচ্ছুক এক প্রার্থী গভীর রাতে হাজির হলেন এক বাসায়। যে বাসায় তিনি গিয়েছেন তারা খানিকটা বিব্রত। এত রাতে তাও আবার মনোনয়ন নিয়ে কথা বলতে, বিষয় কী? কিন্তু রাজনীতির মাঠে থাকা ঐ প্রার্থী একটি গল্প বললেন। তা দিয়ে লেখাটির ইতি টানছি। আগের দিনে গ্রামেগঞ্জে এখনকার মতো বিদ্যুৎ ছিল না। ভোট এলে রাত গভীরেও প্রার্থীরা ছুটতেন বাড়ি বাড়ি। এক প্রার্থী রাতের অন্ধকারে যাকেই পাচ্ছেন তাকেই জড়িয়ে ধরছেন। এভাবে হেঁটে যাচ্ছেন হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে তিনি এক শ্যাওরা গাছ জড়িয়ে ধরে ভোট চাইতে লাগলেন। প্রচলিত আছে, শ্যাওরা গাছ নাকি জীন-ভূতের বাড়ি। নেতা যখন ভোট চাচ্ছিলেন তখন হাওয়ায় ভেসে আসে অদ্ভূত এক শব্দ। চমকে উঠেন ওই প্রার্থী। এ সময় পেছন থেকে সমর্থকরা তাকে টান দেন। বলেন, নেতা করেন কি? এটা তো মরা শ্যাওরা গাছ।