ঢাকা, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বুধবার, ২৭ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সাম্প্রতিক

আগামীর অর্থনীতির লাইফলাইন এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব

এম এম মাসুদ
১৪ নভেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবারmzamin

উদ্ভাবনগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সামগ্রিক প্রভাব আমাদের জীবনে কতোটা বিস্তৃত এবং গভীর হতে যাচ্ছে তা খুব সহজেই অনুধাবন করা যাবে। যেমন- চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হলো ধীরে ধীরে মানুষের সকল পরিধেয়- কাপড়, চশমা, ঘড়ি সকল কিছু ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যাবে। এ ছাড়া ঘরে-বাইরে ব্যবহৃত নানা আসবাবপত্র, পানির লাইন, বিদ্যুৎ লাইন, সুয়ারেজ লাইন সকল কিছুই ইন্টারনেটে সংযুক্ত সেন্সরের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে

দেশে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। এ বিপ্লব দেশের শিল্প জগতে, পণ্য উৎপাদনে ও সেবা প্রদানে বিশাল পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। পাশাপাশি মানুষের জীবনধারা ও পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি ব্যাপকভাবে বদলে দিচ্ছে। পরিবর্তন আনছে অর্থনীতি, সমাজ, ব্যবসা ও ব্যক্তিজীবনে। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবটিক্স, ইন্টারনেট অব থিংস, ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি, থ্রিডি প্রিন্টিং, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও অন্যান্য প্রযুক্তি মিলেই এ বিপ্লব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া সহ উন্নত দেশগুলো এসব উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। বাংলাদেশও এসব প্রযুক্তি ধীরে ধীরে গ্রহণ করছে। বিশেষ করে চীনের সহজলভ্য আধুনিক প্রযুক্তি দেশের সব খাতকে সমৃদ্ধি করেছে। খেলনা থেকে শুরু করে সব ধরনের বড় প্রজেক্টে চাইনিজ মেশিনারিজ ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকতা দেশের বর্তমান শিল্পকে বড় ধরনের পরীক্ষার সম্মুখীনও করেছে। 
এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও সুফল ঘরে তোলার বিষয়টিতে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে আওয়ামী লীগও। দলীয় সূত্র জানায়, নির্বাচনী ইশতেহারে বিশেষ গুরুত্ব পাবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বাস্তবতায় বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো ও চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় পরিকল্পনার কথা তুলে ধরা হবে। রোবটিকস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যানো টেকনোলজির মতো অত্যাধুনিক বিষয়গুলোতে সম্পৃক্ততা বাড়াতে বড় ধরনের পরিকল্পনা থাকবে। 

ক্লাউস সোয়াব তার ‘ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভ্যুলুউশন’ বইতে বলেছেন, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, ডিজিটাল টেকনোলজি এবং জীববিজ্ঞানের প্রভূত উন্নয়ন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রধান চালিকাশক্তি। রোবটিক্স, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং, ইন্টারনেট অব থিংস, স্বচালিত গাড়ি, মোবাইল সুপার কম্পিউটিং, নিউরোসায়েন্সের অ্যাডভান্স গবেষণা আমাদের শিল্প উৎপাদন এবং মানুষ হিসেবে জীবনধারণের পদ্ধতিকেই আমূল পরিবর্তন করে দিচ্ছে। 
আমাদের বাণিজ্য ইকোসিস্টেম এখনো পুরোপুরি ডিজিটালাইজড হয়নি। অথচ দুবাই ইতিমধ্যেই বিশ্বের প্রথম সরকার, যারা ১০০ শতাংশ কাগজবিহীন হয়ে গেছে। বাংলাদেশেও সরকার, চেম্বার অফ কমার্স এবং ট্রেড এসোসিয়েশনগুলো আন্তঃবাণিজ্যের জন্য কাগজবিহীন ব্যবস্থা কার্যকর নিশ্চিত করার জন্য নিরলসভাবে চেষ্টা করছে। তবে চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষুদ্র পর্যায়ে ডিজিটাল রূপান্তর হিসেবে অনেক এগিয়েছে। তাদের মতে, টেলিযোগাযোগ এবং ইন্টারনেট সংযোগে বাংলাদেশের অগ্রগতি সত্যিই আশাব্যঞ্জক। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস দেশের জন্য সাফল্যের আরেকটি মূল ক্ষেত্র। বাংলাদেশের ইন্টারনেট এবং মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার এখন প্রায় ৮০ শতাংশের উপরে। দেশের আইসিটি রপ্তানিও ২০২৫ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে আশা করা হয়েছে। 

তৈরি পোশাকশিল্প বৃহৎভাবে স্বয়ংক্রিয়করণের দিকে ধাবিত হলে এবং রোবট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়লে এর ব্যাপক প্রভাব দেশের অর্থনীতি, উন্নয়ন সহ সবক্ষেত্রেই দেখা যাবে। অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবটের ব্যবহারের দিকে পরিবর্তন গার্মেন্ট সেক্টরে দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে। যার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত দেশের অর্থনীতি উপকৃত হতে পারে। উৎপাদন খরচ কমলে তা বৈশ্বিক বাজারে পোশাক খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতেও সাহায্য করবে। 

বিকেএমইএ’র প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাংলাদেশের অনেক অবকাঠামো খাতে চায়নার প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। ইনভেস্টমেন্ট, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং টেকনোলজি সাপোর্ট দিচ্ছে। পোশাক খাতে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছি।

বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিসিসিআই) সেক্রেটারি আল মামুন মৃধা বলেন, দেশের বিভিন্ন খাতে চায়নার কোম্পানির অবদান রয়েছে। চায়না বাংলাদেশের বিশ্বস্ত সঙ্গী। গত ১০ বছরে দেশের রোড, ব্রিজ ও বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক অবদান রেখেছে চীনারা। সব ধরনের বড় প্রজেক্টে চাইনিজ মেশিনারিজ ব্যবহার করা হয়। দেশে একটি স্পেশাল চীনা ইকোনমিক জোন হচ্ছে। চীনের বড় বড় প্রকল্পে বিনিয়োগের ফলে আমরা টেকনোলজির বিষয়েও অভিজ্ঞতা লাভ করছি। অর্থাৎ এমন কোনো ক্ষেত্র নাই যেখানে চীনা প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে না। 
শিল্প বিপ্লবের ইতিহাস: ১৭ শতাব্দীতে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে গতানুগতিক উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রথম শিল্প বিপ্লব সূচিত হয়। ১৯ শতকের শুরু থেকে দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের আরম্ভ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কম্পিউটার প্রযুক্তি, সেমিকন্ডাক্টর, মাইক্রোচিপস ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি ও আণবিক শক্তিসহ অন্যান্য উদ্ভাবন নিয়ে তৃতীয় শিল্প বিপ্লব। এ শিল্প বিপ্লব ইন্টারনেট, মোবাইল যোগাযোগ ইত্যদি প্রদান করেছে এবং আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা, ঔষধ শিল্প ও বায়োটেকনোলজি ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মানুষের জীবন ধারায় প্রতিনিয়ত ব্যাপকতর পরিবর্তন নিয়ে আসছে। মানুষের জীবনে এ বিপ্লবের প্রভাব এবং পরিবর্তনের গুণগত মাত্রা ও ব্যাপ্তি আগের তিনটি বিপ্লবের সঙ্গে অতুলনীয়।

এক নজরে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব: উদ্ভাবনগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সামগ্রিক প্রভাব আমাদের জীবনে কতোটা বিস্তৃত এবং গভীর হতে যাচ্ছে তা খুব সহজেই অনুধাবন করা যাবে। যেমন- চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হলো ধীরে ধীরে মানুষের সকল পরিধেয়- কাপড়, চশমা, ঘড়ি সকল কিছু ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যাবে। এ ছাড়া ঘরে-বাইরে ব্যবহৃত নানা আসবাবপত্র, পানির লাইন, বিদ্যুৎ লাইন, সুয়ারেজ লাইন সকল কিছুই ইন্টারনেটে সংযুক্ত সেন্সরের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। ঘরবাড়ি থেকে শুরু করে বড়-ছোট নানা বস্তু থ্রিডি প্রিন্টিং-এর মাধ্যমে কম্পিউটারের কমান্ডে তৈরি হবে। সকলের কম্পিউটার-ইন্টারনেট- স্মার্টফোন থাকবে, গাড়িগুলো ড্রাইভারবিহীন হবে। অডিট হিসাব-ট্যাক্স কালেকশনের কাজ কম্পিউটার করে দিবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও ব্লকচেইন-এর মাধ্যমে। যানবাহনগুলো মেশিন লার্নিং ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে সুচারুরূপে পরিচালিত হবে। 

স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী সাদ্দাম হোসেন বলেন, মোট কথা প্রশাসন, আইন, চিকিৎসা, ড্রাইভিং, নির্মাণ শ্রমিক, এমনকি যুদ্ধের সৈনিকসহ প্রায় সকল ক্ষেত্রে আস্তে আস্তে মানুষের প্রয়োজনীয়তা কমে যাচ্ছে। এসব বিষয় ১/২ বছরের মধ্যে না হলেও খুব শিগগিরই আমরা এ নতুনত্বের স্বাদ পেতে যাচ্ছি।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা: চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দৃশ্যমান প্রধান সমস্যা হয়ে যাবে নির্বিচারে চাকরি হারানো। আগামীতে ৫০% কাজ মানুষের শ্রম বাদ দিয়ে যন্ত্রের মাধ্যমে অটোমেটেড হয়ে যেতে পারে। একসঙ্গে সবাই মিলে চতুর্থ বিপ্লবের চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়াই এখন ভবিষ্যতের প্রধান লক্ষ্য। চতুর্থ বিপ্লবের এ সুযোগকে পৃথিবী ও মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে হবে। 

উদ্যোগ ও অবকাঠামো: প্রত্যাশা করা হয়, যদি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে দক্ষ জনবল গড়ে তোলা যায় তবে পোশাক শিল্প খাতের রপ্তানিকেও অতিক্রম করে একটি বহুমুখী রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা যাবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাত থেকে শত গুণের বেশি রপ্তানি আয় হতে পারে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে চায়না এক্সপোর্টার্স অব বাংলাদেশের সভাপতি কে চ্যাং লিয়াং বলেন, গত কয়েক দশক ধরে চীনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ দেশের স্বপ্ন পূরণে কাজ করছে। ৬৭০টি চীনা কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রায় ১৫টি চীনা কোম্পানির দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক হেডকোয়ার্টার্স এখানে রয়েছে। এসব কোম্পানি সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। তারা বাংলাদেশ ও চীনের অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সহযোগিতার প্রধান চালিকাশক্তি। তিনি বলেন, ‘তারা বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগ করেছে। তারা বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক নির্মাণে অংশগ্রহণ করেছে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অবদান রেখেছে।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

সা ম্প্র তি ক/ পিতা ও কন্যার পরিণতি

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status