নির্বাচিত কলাম
বেহুদা প্যাঁচাল
সিইসি’র চ্যালেঞ্জ এবং নির্বাচনী ট্রেন
শামীমুল হক
১০ নভেম্বর ২০২৩, শুক্রবার
২০১৮ সালের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা প্রয়াত মাহবুব তালুকদার বলেছিলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচন ব্যর্থতার গ্লানি।
সিইসি ইউএনওদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হবে, সেটি কঠোরভাবে প্রতিপালন করতে হবে। আমরা নির্বাচন কমিশন থেকে বিষয়টি কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করবো। জানার চেষ্টা করবো আপনারা কে, কীভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তথ্য নেবো। কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য তখনই হবে, যদি দায়িত্ব পালন করে মানুষকে দেখানো যায়। তিনি বলেন, ‘বাজারে পারসেপশন আছে, আমাদের ওপর আস্থা নেই, সরকারের ওপর আস্থা নেই। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয় না। আমরা এই চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করতে চাই, আমাদের অধীনে যে নির্বাচন হবে, সেটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হবে। স্বচ্ছতাটা গণমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকদের মাধ্যমে দেখাতে চাই। সিইসি যে অবাধ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতা দেখাতে চান সেটি একপক্ষকে নিয়ে কীভাবে সম্ভব? যেখানে দু’টি পক্ষ না হলে লড়াই-ই জমে উঠে না সেখানে তিনি একপক্ষকে নিয়ে স্বচ্ছতা দেখাতে চান! এ কেমন স্বচ্ছতা হবে
নির্বাচনী ডামাডোলে দেশ। আসুন সবাই নির্বাচন নিয়ে মাতোয়ারা হই। কে নির্বাচনী ট্রেনে উঠলো আর কে না উঠলো তাতে কী? নির্বাচন তো সময়মতো করতেই হবে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা পালন করতেই হবে। আর সেটা না করলে দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা দেখা দেবে। এতে ঘোর অন্ধকারে নিপতিত হবে দেশ। এ থেকে বাঁচাতে হবে দেশকে। দেশের মানুষকে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ক’দিনের মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। এজন্য নির্বাচন কমিশন শতভাগ প্রস্তুত। ইতিমধ্যে তাদের সার্বিক প্রস্তুতির কথা জানিয়েও দিয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সার্বিক বিষয় অবগত করেছেন। আর বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, যেকোনো মূল্যে নির্ধারিত সময়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে। দ্রুত নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। যেকোনো মূল্যে নির্ধারিত সময়, ২৯শে জানুয়ারির আগেই নির্বাচন করতে হবে। সিইসি বলেন, নির্ধারিত সময় ও পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশন বদ্ধপরিকর। নির্বাচনের তফসিল নিয়ে এখনো পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। কমিশনের বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। যথাসময়ে নির্বাচন হবে। এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, রাজনৈতিক সংকট নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তাদের কোনো কথা হয়নি। সিইসি’র কথা স্পষ্ট। তিনি স্পষ্ট কথা বলতেই পছন্দ করেন। তার এ স্পষ্ট কথা নিয়ে একাধিকবার বিতর্কের জন্মও দিয়েছেন। তাতে কী? তিনি তো সিইসি। তার নির্বাচন ছাড়া আর কোনো উপায় আছে কী? এ প্রসঙ্গে পরে আসছি। বুধবার

ইসি সচিব জাহাংগীর আলম কী বলেছেন সেদিকে একটু নজর দেয়া যাক। সচিব বলেছেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার মতো পরিবেশ রয়েছে। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, রেওয়াজ অনুযায়ী তফসিল ঘোষণার আগে কমিশন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে। এ ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার এ সাক্ষাতের সূচি রয়েছে। সাক্ষাতে প্রেসিডেন্টকে নির্বাচন প্রস্তুতি সংক্রান্ত সব ধরনের অগ্রগতির বিষয়ে অবহিত করা হবে। প্রস্তুতি নিয়ে প্রেসিডেন্টের পরামর্শ ও নির্দেশনা থাকলে তা কমিশন শুনবে। পরে কমিশন সভা করে তফসিল চূড়ান্ত করবে। সবকিছু ঠিক থাকলে ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে বা জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি এমনই। সে হিসাবে বলা যায়-নির্বাচনী ট্রেন এখন লাইনে উঠেছে। হুইসেল বাজার অপেক্ষা। হুইসেল বাজলেই চলতে শুরু করবে। প্রশ্ন হলো এ ট্রেনে কারা উঠবেন? দেশ-বিদেশের সবাই জানেন, আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলো একপক্ষে, অন্যদিকে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো আরেক পক্ষে। দু’মেরুতে অবস্থান করছে তারা। এ অবস্থায় নির্বাচন হলে- একপক্ষই ট্রেনে উঠবে। অন্যপক্ষ দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখবে। কারণ সরকারি দল আওয়ামী লীগ সংলাপকে না বলে দিয়েছে। এখানে কোনো ধরনের ফাঁক ফোকর রাখেনি। অন্যদিকে বিএনপি নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। এখানেও কোনো ফাঁক ফোকর নেই। তাহলে কী দাঁড়ালো? বিচার যা-ই হোক তালগাছ আমার। আমরা সবাই জানি, এমন অবস্থা হলে কখনোই কোনো কিছুর মীমাংসা হয় না। বরং পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়। যে অবস্থা এখন বাংলাদেশের। এ ছাড়া গত ২৮শে অক্টোবর থেকে রাজনীতির পরিস্থিতি ভিন্ন মোড় নিয়েছে। ওই দিন বিএনপি’র মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়া, সহিংসতা, পুলিশের এক সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা, গুলিতে যুবদলের এক নেতার মৃত্যু, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, বাসে আগুন পরিস্থিতি ঘোলাটে করে দেয়। এর পরপরই বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেপ্তার দিয়ে শুরু হয় বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার অভিযান। বিএনপি’র শীর্ষ ক’জন নেতাসহ সারা দেশে চলে গ্রেপ্তার অভিযান। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। বিএনপি থেকে বলা হয়েছে তাদের কোনো নেতাকর্মী বাড়িতে থাকতে পারছে না। গ্রেপ্তারের ভয়ে তারা আত্মগোপনে চলে গেছেন। এ ছাড়া বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর তৃতীয় দফা অবরোধ শেষ হয়েছে। সামনে আরও কঠিন কর্মসূচির কথা বলা হচ্ছে দলটির পক্ষ থেকে। ইতিমধ্যে এলডিপি’র পক্ষ থেকে আগামী রোববার ও সোমবার অবরোধের ডাক দেয়া হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ট্রেনে চড়ে একদল গন্তব্যে পৌঁছাবে। অন্যদল আন্দোলন নিয়ে মাঠেই থাকবে। প্রশ্ন হলো- এখানেই কি শেষ?
এবার ফিরে যাই সেই সিইসি’র কাছে। কিছুদিন আগে তিনি বলেছিলেন, নির্বাচনের কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ নেই। তাহলে তিনি কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ ছাড়াই নির্বাচনী ট্রেন নিয়ে স্টেশনে পৌঁছাবেন। কেউ কেউ বলেন, নির্বাচন কমিশনের এ ছাড়া কোনো উপায় নেই। আবার কেউ কেউ বলছেন, সিইসি সাহসী এক পদক্ষেপ নিতে পারতেন তার এ বক্তব্যের মাধ্যমে। কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ না থাকায় তিনি পদত্যাগ করতে পারতেন। আসলে একেক মানুষ একেক রকম। কেউ একভাবে দেখেন। কেউ অন্যভাবে দেখেন। তবে এটা তো ঠিক বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের কারাগারে রেখে, তাদের মামলা দিয়ে আত্মগোপনে রেখে, ঘরের বাইরে রেখে যে নির্বাচন হবে সে নির্বাচন আনন্দের নয়। সুখের নয়। তৃপ্তির নয়। খেলার মাঠে একা খেলার মধ্যে কী কোনো মাহাত্ম্য আছে? তার চেয়ে খেলায় যাতে প্রতিপক্ষ থাকে সে চেষ্টা করা কি যৌক্তিক নয়? দেশবাসীর সামনে তো ২০১৪ ও ২০১৮ সালে হওয়া দু’টি নির্বাচন উদাহরণ হিসেবে রয়েছে। সে দু’টি নির্বাচনে কী হয়েছিল সবার জানা। সিইসি নিজেও বলেছেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের চাপ আমাদের ওপর পড়েছে। অক্টোবরের প্রথম দিকে নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে আয়োজিত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কাজী হাবিবুল আউয়াল এ কথা বলেছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন, এমন পরিস্থিতিতে কমিশন নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য করার চ্যালেঞ্জ নিতে চায়। নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিতর্ক ও সমালোচনা হতে পারে। অতীতেও হয়েছে। ৫০, ৬০, ৭০ বছরের ইতিহাস ঘাঁটলেও বিতর্ক পাওয়া যাবে। এমনকি বৃটিশ আমলের নির্বাচন নিয়েও কিছু কিছু বিতর্ক হয়েছে। তখন হয়তো মাত্রাটা কম ছিল।
সিইসি ইউএনও’দের উদ্দেশ্যে আরও বলেন, ‘আমরা যে নির্বাচনটি করতে যাচ্ছি, সেটার একটা বিশেষ দিক হচ্ছে, অভিযোগ বা বিতর্কের মাত্রাটা একটু অতিরিক্ত। সিইসি এখন বিতর্কের দিকেই যাচ্ছেন। দেশবাসী জানেন, ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। সেখানে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন প্রার্থীরা। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়। তবে ওই নির্বাচনে ভোটের আগের রাতে ব্যালটে সিল মারার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা প্রয়াত মাহবুব তালুকদার বলেছিলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচন ব্যর্থতার গ্লানি।
সিইসি ইউএনওদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হবে, সেটি কঠোরভাবে প্রতিপালন করতে হবে। আমরা নির্বাচন কমিশন থেকে বিষয়টি কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করবো। জানার চেষ্টা করবো আপনারা কে, কীভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তথ্য নেবো।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য তখনই হবে, যদি দায়িত্ব পালন করে মানুষকে দেখানো যায়। তিনি বলেন, ‘বাজারে পারসেপশন আছে, আমাদের ওপর আস্থা নেই, সরকারের ওপর আস্থা নেই। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয় না। আমরা এই চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করতে চাই, আমাদের অধীনে যে নির্বাচন হবে, সেটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হবে। স্বচ্ছতাটা গণমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকদের মাধ্যমে দেখাতে চাই।
সিইসি যে অবাধ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতা দেখাতে চান সেটি একপক্ষকে নিয়ে কীভাবে সম্ভব? যেখানে দু’টি পক্ষ না হলে লড়াই-ই জমে উঠে না সেখানে তিনি একপক্ষকে নিয়ে স্বচ্ছতা দেখাতে চান! এ কেমন স্বচ্ছতা হবে?
এক/এগারোর সময় বহুল আলোচিত একটি শব্দ ছিল-সুড়ঙ্গের ওপারে আলোর দেখা মিলবে কী? বর্তমান সময়ে এসেও একই কথা বলতে হচ্ছে সুড়ঙ্গের ওপারে অন্ধকারে গিজগিজ করছে। এ অন্ধকার ভেদ করে আলোর দেখা পাওয়া যাবে কী? নাকি অন্ধকারের চোরাবালিতেই এগিয়ে যেতে হবে সামনে। তাতে গর্তে পড়ে হাবুডুবু খেলেও কারও করার কিছু থাকবে না।