নির্বাচিত কলাম
সময়-অসময়
ক্রিকেট, হামনেহি জিতেগা হামারা মর্জি
রেজানুর রহমান
৪ নভেম্বর ২০২৩, শনিবার
বাংলাদেশের খেলা দেখতে গিয়েছিল। নেদারল্যান্ডস’র সঙ্গে বাংলাদেশের হারার দিন দর্শক সারিতে অনেক দর্শককে কাঁদতে দেখেছি। ব্যর্থতার কান্না। পাকিস্তানের সঙ্গে খেলার দিনও অনেক আশায় বুক বেঁধেছিল বাংলাদেশের দর্শক। একটা জয়ের আশায় সে কী আকুলতা। কলকাতার স্থানীয় দর্শকও বাংলাদেশের জয়ের আশায় মাঠে এসেছিল। পারলো না বাংলাদেশ! ইডেনের গ্যালারিতে একটা প্ল্যাকার্ড দেখা গেল। তাতে লেখা- হামনেহি জিতেগা, হামারা মর্জি... যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘আমি জিতবো না, আমার ইচ্ছা...’
এই প্ল্যাকার্ডের অনেক মানে দাঁড়ায়। তবে সেটা আমাদের ক্রিকেট কর্তাদের পাশাপাশি প্রিয় খেলোয়াড়রা বুঝলেই হয়
তাহলে কী ষোলো কলা আমাদের পূর্ণ হলো? বিশ্বকাপের ৭ ম্যাচের মধ্যে ৬টিতেই হার। বাংলাদেশ দলের জন্য এটাও একটা অর্জন! সবাই জিতে। আমরা না হয় হারলাম। হার এবং জিত দুটোই খেলার অংশ। সবাই জিততে চাইলে হারবে কে? বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি নাটকে জিতে গেছি মামুজান বলে একটা সংলাপ বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। এবার হেরে গেছি মামুজান এই সংলাপটাকে জনপ্রিয় করা যেতে পারে। কারণ জেতার মধ্যে যদি আনন্দ থাকে তাইলে হারার মধ্যে আনন্দ থাকবে না কেন? হেরেছি তো কি হয়েছে? কাউকে তো খুন করিনি। কারও পাকা ধানে তো মই দেইনি। সবাই জিততে চায় আমরা হারতে চেয়েছি। আমাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। হারার মধ্যেও আনন্দ আছে। এই যে আমাদের ক্রিকেট দলকে নিয়ে এত কথা হচ্ছে, এত আলোচনা হচ্ছে, হেরেছি বলেই তো হচ্ছে। হেরেছি বলেই তো কার কোথায় ভুল ছিল, কে কাকে ল্যাং মেরেছে। কে কাকে দলে ঢুকতে দেয়নি। কে কার বিরুদ্ধে গুটিবাজ করেছে, কে কার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। অন্যায় করেছে। সবই তো চোখের সামনে পরিষ্কার হচ্ছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যদি বিশ্বকাপে এভাবে ব্যর্থ না হতো তাহলে তো নেপথ্যের এত এত নেতিবাচক ঘটনা প্রকাশ্যে আসতো না। সে কারণে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যর্থতাকে স্যালুট করা উচিত।

আমার একজন বন্ধু বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্ধভক্ত। বাংলাদেশ হেরে যাচ্ছে দেখেও টেলিভিশনের পর্দা থেকে চোখ সরায় না। তার একটাই কথা হারতে হারতেই একদিন জয়ের দেখা পাবে বাংলাদেশ। জয় করতে শিখবে। সেই মানুষও দারুণ ক্ষুব্ধ। না বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা আর দেখবোই না। আরে ভাই পরাজয়েরও তো একটা শেষ আছে। টানা ৬ ম্যাচে কেবল হারে, হারতেই থাকে... সেই দলের ভবিষ্যৎ মোটেই ভালো না। বাংলাদেশের ক্রিকেটে শনি ঢুকছে, শনি তাড়াতে না পারলে এই দেশের ক্রিকেট আর দাঁড়াবে না। বলতে হঠাৎ কেঁদে ফেললো বন্ধুটি! পঞ্চাশ ছুঁয়েছে যে মানুষ সে যদি এভাবে কাঁদে তাহলে পরিস্থিতি কেমন দাঁড়ায়। বন্ধুকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম এভাবে কাঁদছিস কেন? সামান্য ক্রিকেটের জন্য কেউ কি এভাবে কাঁদে? আমার কথা শুনে বন্ধুটি হঠাৎ প্রতিবাদী হয়ে উঠলো। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো ‘ক্রিকেটকে সামান্য বলা যাবে না। ক্রিকেট হাসলে একটা দেশ হাসে। ক্রিকেটের এত শক্তি। অথচ ব্যক্তি বিশেষের ভুল, একগুয়েমি ঈর্ষাকাতর, মনোভঙ্গি, অনিয়ম, অন্যায়ের কারণে বাংলাদেশের ক্রিকেট ডুবতে বসেছে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।
বন্ধু ঠিকই বলেছে। ক্রিকেট বাংলাদেশের ভরাডুবির বিহিত হওয়া দরকার। এমন তো নয় বাংলাদেশ ভালো ক্রিকেট খেলে না। বিশেষ করে ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সুনাম আছে। টেস্ট পরিবারভুক্ত সকল দেশকেই হারানোর অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কেন এত দুর্বল হয়ে উঠলো? স্বয়ং বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন সাকিব আল হাসান বলেছেন, বিশ্বকাপ যাত্রার ইতিহাসে এটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বাজে পারফরমেন্স। কেন এমন হলো আমি নিজেই তা জানি না। সাকিবের বক্তব্যের শেষ লাইনটি সহজেই মেনে নেয়ার মতো নয়। দলের অব্যাহত ব্যর্থতার কারণ দল প্রধান জানবেন না তা কি করে হয়? দল যদি এভাবে বাজে পারফরমেন্স না করতো, যদি ভালো খেলতো তাহলে দল প্রধান হিসেবে সাকিব ক্রেডিট নিতেন। কাজেই ব্যর্থতার দায়ভার ও অন্যদের পাশাপাশি তার ওপরই বর্তায়। সে কথায় পরে আসছি। অব্যাহত পরাজয়ের কারণে বাংলাদেশের ক্রিকেট শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো বা দাঁড়াচ্ছে তা নিয়েই একটু বলি। ৯টি খেলার মধ্যে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ৭টি খেলা শেষ করেছে। জয় মাত্র একটিতে। বাকি আছে আর মাত্র ২টি ম্যাচ। জেতার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ভাগ্যগুণে দুটি খেলায়ও যদি জিতে যায় তাহলে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সরাসরি খেলার যোগ্যতা পাবে কিনা সন্দেহ আছে। বাকি দুইটা জিততে না পারলে র্যাঙ্কিং-এর তলানিতে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। আফগানিস্তান এমন কি নেদারল্যান্ডসও র্যাঙ্কিং-এ বাংলাদেশের উপরে স্থান পাবে। ফলে বাংলাদেশ পরের বিশ্বকাপে সরাসরি খেলতে পারবে কিনা তা নিয়েও সংশয়-সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
ক্রিকেটের এই যে ব্যর্থতা তার দায়টা মূলত কার? বাংলাদেশের এবারের বিশ্বকাপ যাত্রা খুব কি মসৃণ ছিল? ভারতে যাওয়ার ৭ দিন আগেও দলে কে থাকবেন কে থাকবেন না তা নিশ্চিত করা যায়নি। বিশ্বসেরা ক্রিকেটার তামিম ইকবালকে নিয়ে যে বিতর্ক দাঁড় করানো হলো তা ছিল দুর্ভাগ্যজনক। একই সঙ্গে মাহমুদউল্লাহরও দলে থাকা না থাকা নিয়ে অনিশ্চয়তা শুরু হয়। অথচ সেই মাহমুদউল্লাহই বাংলাদেশ দলের মান বাঁচিয়েছেন! ব্যক্তিগত রেষারেষি ও ঈর্ষাকাতর মনোভঙ্গি পরিহার করে শেষ পর্যন্ত তামিমকে যদি দলে রাখা যেতো তাহলে দলের মানসিক শক্তিটা আরও বাড়তো। তার মানে এই নয় যে, দলে তামিম থাকলেই দলের আজকের এই শোচনীয় অবস্থা হতো না। হয়তো হতো। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল পারফরমেন্সের দিক থেকে এতটা বিতর্কের মুখে পড়তো না। তামিম দলে থাকলে ওপেনিং জুটির ব্যাপারে হতাশাটা কেটে যেতো। শেষ পর্যন্ত মাহমুদউল্লাহকে দলে অন্তর্ভুক্ত করায় দল সত্যি সত্যি লাভবান হয়েছে। দলে তামিম থাকলে বোধকরি দল খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হতো না।
লেখাটি শেষ করি। তার আগে কলকাতার ইডেন গার্ডেনে দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। আমাদের পাশের বাড়ি কলকাতা। ভিসা জটিলতা থাকা সত্ত্বেও দেশের অনেক মানুষ কলকাতার ইডেন গার্ডেনে বাংলাদেশের খেলা দেখতে গিয়েছিল। নেদারল্যান্ডস’র সঙ্গে বাংলাদেশের হারার দিন দর্শক সারিতে অনেক দর্শককে কাঁদতে দেখেছি। ব্যর্থতার কান্না। পাকিস্তানের সঙ্গে খেলার দিনও অনেক আশায় বুক বেঁধেছিল বাংলাদেশের দর্শক। একটা জয়ের আশায় সে কী আকুলতা। কলকাতার স্থানীয় দর্শকও বাংলাদেশের জয়ের আশায় মাঠে এসেছিল। পারলো না বাংলাদেশ! ইডেনের গ্যালারিতে একটা প্ল্যাকার্ড দেখা গেল। তাতে লেখা হামনেহি জিতেগা, হামারা মর্জি... যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘আমি জিতবো না, আমার ইচ্ছা...’
এই প্ল্যাকার্ডের অনেক মানে দাঁড়ায়। তবে সেটা আমাদের ক্রিকেট কর্তাদের পাশাপাশি প্রিয় খেলোয়াড়রা বুঝলেই হয়।
ভারতের সাবেক ক্রিকেটার মহেন্দ্র সিং ধোনি একটি চমৎকার গল্প বলেছেন। ক্রিকেটার হওয়ার আগে তিনি ভারতের খড়গপুরে রেলওয়েতে চাকরি করতেন। কলকাতার পাশেই খড়গপুর। বাংলায় কথা বলেন অধিকাংশ মানুষ। আর তাই প্রয়োজনের খাতিরে বাংলা শিখেছিলেন ধোনি। ঢাকায় ক্রিকেট খেলতে এসেছেন। ব্যাটিং করছেন। তখন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা কীভাবে বল করলে ধোনিকে আউট করা যাবে তাই নিয়ে মাতৃভাষায় কথা বলছিলেন। পরিস্থিতি তখন কেমন দাঁড়িয়েছিল আসুন ধোনির জবানিতে শুনি- ‘খড়গপুরে রেলওয়েতে চাকরি করার সুবাদে আমি বাংলা শিখেছিলাম।’ লিখতে পারি না। ভাব বাংলা বুঝতে পারি, বলতেও পারি। একবার ঢাকায় খেলতে এলাম, ব্যাটিং করছি। তখন দেখলাম বাংলাদেশের বোলাররা আমাকে কীভাবে পরাস্ত করবে তাই নিয়ে কথা বলছে। আমি তাদের কথা বুঝতে পেরে সতর্ক হলাম। ওরা বুঝতে পারলো যে আমি বাংলা জানি। তারপর যা হয় তাই হলো।
আজকের এই লেখায় ধোনির প্রসঙ্গটি উল্লেখ করার একটিই কারণ তাহলো এত ঘটনার পরও আমরা কী শেষ পর্যন্ত ক্রিকেটের ব্যাপারে সতর্ক হতে পারছি? ভুল, অন্যায়গুলো কি ধরতে পারছি? ক্রিকেট হলো যোগ্যতা প্রদর্শনের খেলা। এখানে মেধার বিকল্প কিছু নাই। একজন যোগ্য ব্যক্তিকে সবার পছন্দ নাও হতে পারে। তবে তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে ব্যক্তি স্বার্থ না দেশের স্বার্থকেই আগে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ ক্রিকেট হাসলেই দেশ হাসে।