ঢাকা, ৫ ডিসেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

আন্তর্জাতিক

কীভাবে শুরু ভারত কানাডার সম্পর্কে ফাটল

মোহাম্মদ আবুল হোসেন
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবারmzamin

অন্যদিকে উগ্রপন্থা এবং কানাডায় বিদেশি হস্তক্ষেপের বিষয়ে নয়াদিল্লিতে সাংবাদিকদের ট্রুডো বলেন- আলোচনায় দুটি ইস্যুই উঠেছিল। কানাডা সব সময় মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বিবেকের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের স্বাধীনতার পক্ষে থাকবে। আমাদের কাছে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সহিংসতার বিরুদ্ধে আমরা সব সময়। ঘৃণার বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান।  কিন্তু দেশে ফিরে গিয়ে ১৯শে সেপ্টেম্বর হাউজ অব কমন্সে ট্রুডো ভারত সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ আনেন। বলেন, হরদিপ সিং নিজার হত্যায় ভারত সরকার এবং ‘র’ জড়িত। এ বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রমাণ আছে। শুরু হয় উত্তেজনা। এতদিন ভেতরে ভেতরে থাকলেও সেই উত্তেজনা যেন বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে।

বিজ্ঞাপন
প্রথমদিকে বিষয়টি দুই দেশের সরকারের ভেতরকার ইস্যু হলেও তা এখন সারা বিশ্বের কাছে পৌঁছে গেছে।


কানাডা ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা চরম পর্যায়ে। এই উত্তেজনা কি শুধু একজন শিখ নেতা হরদিপ সিং নিজার হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে! সম্ভবত উত্তর হবে- না। বহু আগে থেকেই এই উত্তেজনার পারদ উপরে উঠছিল। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে তা আস্তে আস্তে আরও উত্তপ্ত হতে শুরু করে। আর এ বছরের ১৮ই জুন তা যেন চরমে পৌঁছে দেয়। এদিন কানাডার ভ্যানকোভারের কাছে দুই আততায়ী গুলি করে হত্যা করে শিখ নেতা হরদিপ সিং নিজারকে। এ নিয়ে তদন্তে নামে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সরকার। তাতে ‘বিশ্বাসযোগ্য তথ্য’ পায় তারা। বলা হয়, এই হত্যায় ভারত সরকার এবং তার গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ জড়িত। এ অভিযোগ সদ্য সমাপ্ত জি-২০ সম্মেলনে এসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে জানিয়েছিলেন জাস্টিন ট্রুডো। কিন্তু মোদি বিষয়টিকে আমলে নেননি। ফলে গত সোমবার পার্লামেন্টের জরুরি অধিবেশন আহ্বান করেন ট্রুডো। সেখানে তিনি এবং তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জোলি প্রকাশ্যে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেন। একে কেন্দ্র করে দুই দেশই একজন করে সিনিয়র কূটনীতিককে বহিষ্কার করে পরের দিন। কানাডিয়ানদের জন্য ভারতের ভিসা বন্ধ করে দেয় ভারত। ট্রুডো একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্তে ভারতের সহায়তা চেয়েছেন। এতে সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। 

দৃশ্যত মনে হতে পারে এসব ঘটনা শুধুমাত্র গত সোমবার ট্রুডো প্রকাশ করেছেন, এখান থেকেই শুরু। কিন্তু না। কানাডা এবং ভারতের মধ্যে আস্তে আস্তে এই উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে মাসের পর মাস। প্রথমত এর কারণ, ভারতের পাঞ্জাবে শিখ সম্প্রদায়ের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ‘খালিস্তান’ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। এই আন্দোলনের তুখোড় সমর্থক ছিলেন হরদিপ সিং নিজার। ১৯৭০-এর দশকে এই আন্দোলনের শুরু হয়েছিল। তা থেকে ভয়াবহ সহিংসতা সৃষ্টি হয়। পাঞ্জাবের হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারান। শিখদের এই আন্দোলনকে ভারত সরকার দেখে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ড হিসেবে। সেই হিসাবে হরদিপ সিং নিজারকে একজন সন্ত্রাসী হিসেবে বার বার অভিহিত করেছে ভারত। তবে নিজারের সমর্থকরা এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। ২০২০ সালে হরদিপ সিং নিজার এবং  শিখস ফর জাস্টি-এর গুরপাতওয়ান্ত সিং পান্নুন সহ অন্য সাত জনকে সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা দেয় ভারত সরকার। ভারতের ভেতরে শিখদের এই খালিস্তান আন্দোলন মিইয়ে এলেও আন্তর্জাতিকভাবে বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে খালিস্তানপন্থি গ্রুপ। এ নিয়ে অনেক বছর ধরে উত্তেজনার মধ্যেও ভারত ও কানাডার মধ্যে নিয়মিত কূটনৈতিক যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। শীর্ষ কর্মকর্তাদের দ্বিপক্ষীয় সফর বিনিময় হচ্ছিল। 

কিন্তু সব পাল্টাতে শুরু করে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে। ১৫ই সেপ্টেম্বর এক্স-এ (সাবেক টুইটার) অটোয়াতে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশন বিএপিএস স্বামীনারায়ণ মন্দির টরেন্টোতে ভারতবিরোধী দেয়ালচিত্রের নিন্দা জানান। এতে বলা হয়, এ ঘটনা তদন্তে কানাডা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাই এবং দ্রুত এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা দাবি করি। ২০শে সেপ্টেম্বর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতীয় নাগরিক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য একটি পরামর্শমূলক সতর্কতা জারি করে। তাতে কানাডায় ঘৃণাপ্রসূত অপরাধ, গোষ্ঠীগত সহিংসতা এবং ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সতর্ক করা হয়। বলা হয়, এসব অপরাধে জড়িতদের কাউকে বিচারের আওতায় আনা হয়নি। 

২০২৩ সালের ২৩শে মার্চ ভারতীয় বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান আইনপ্রণেতা ইকবিন্দর গাহীরা কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জোলির কাছে প্রশ্ন করেন। তার জবাবে জোলি বলেন, পাঞ্জাবে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকার অবহিত। এর মধ্যদিয়ে তখন পাঞ্জাবে শিখ নেতা অমৃতপাল সিংকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানোর বিষয়ে ইঙ্গিত দেয়া হয়। অমৃতপাল তখন পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন।  মেলানি জোলি বলেন, আমরা পরিস্থিতি অত্যন্ত নিবিড়ভাবে অনুসরণ করছি। আমরা একটি স্থিতিশীল পরিস্থিতির প্রত্যাশা করছি। 

অমৃতপাল সিংকে ধরার জন্য যখন অভিযান চলছিল তখন নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে ভ্যানকোভারে ভারতীয় কনস্যুলেটের বাইরে সমবেত হন কয়েক শত মানুষ। ভারতের ওই অভিযানের ফলে যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, কানাডা সহ বেশ কিছু দেশে ভারতীয় কূটনৈতিক মিশনের বাইরে খালিস্তানপন্থি প্রতিবাদকারীরা বিক্ষোভ করেন। কানাডার কূটনৈতিক মিশন এবং কনস্যুলেটগুলোতে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী ও উগ্রপন্থিদের’ এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ‘কড়া প্রতিবাদ জানাতে’ ভারতে নিযুক্ত কানাডার হাইকমিশনারকে ২৫শে মার্চ তলব করে ভারত।
৫ই জুন কানাডার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জোডি থমাস অভিযোগ করেন দেশের ভেতরে বিদেশি হস্তক্ষেপের শীর্ষে যারা আছে তার মধ্যে ভারত অন্যতম। ওদিকে ১৯৮৪ সালে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হত্যা ঘটনা কানাডার ব্রামটনে এক প্যারেডে প্রদর্শন করা হয়। এতে ৮ই জুন কানাডার সমালোচনা করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। একই দিন এর জবাব দেন ভারতে নিযুক্ত কানাডার হাইকমিশনার ক্যামেরন ম্যাককে। তিনি এক্সে লিখেন- ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকে সেলিব্রেট করা হয়েছে। কানাডায় এমন একটি ইভেন্টের খবর দেখে আমি হতবাক হয়েছি। সহিংসতাকে প্রোজ্জ্বল করে দেখানো অথবা ঘৃণার কোনো স্থান নেই কানাডায়। এসব কর্মকাণ্ডের সরাসরি নিন্দা জানাই। কিন্তু ১০ই জুন ভারতের হিন্দুস্তান টাইমস কানাডার ব্রাম্পটনের মেয়র প্যাট্রিক ব্রাউনের অফিস থেকে দেয়া একটি বিবৃতি উদ্ধৃত করে। তাতে বলা হয়, পুলিশ এর ভিডিও দেখেছে। এতে দেখা গেছে যে, এখানে ঘৃণাপ্রসূত কোনো অপরাধ হয়নি। 

এমন এক প্রেক্ষাপটে ১৮ই জুন কানাডার সারে অঞ্চলে একটি শিখ উপাসনালয়ের বাইরে গুলি করে হত্যা করা হয় শিখ নেতা হরদিপ সিং নিজারকে। ২৯শে জুন খালিস্তান ইস্যুতে এক প্রশ্নের জবাবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, কানাডা সরকার বিষয়টিকে এমনভাবে  মোকাবিলা করছে যে, দেখে মনে হয় এটা তাদের ভোট ব্যাংক ইস্যুতে সীমাবদ্ধ। তিনি আরও বলেন, যদি এসব কর্মকাণ্ড জাতীয় নিরাপত্তা ও অখ-তার জন্য হুমকি হয়, তবে ভারত ব্যবস্থা নেবে। 

কানাডায় ভারতীয় কূটনীতিকদেরকে একটি পোস্টারে টার্গেট করায় খালিস্তানপন্থি সমর্থকদের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কানাডার হাইকমিশনারকে ৪ঠা জুলাই তলব করে ভারত। এর জবাবে এক্সে কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোলি বলেন, কূটনীতিকদের নিরাপত্তার বিষয় ভিয়েনা কনভেনশনের অধীনে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে অটোয়া। এরপর ৬ই জুলাই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি বলেন, কূটনীতিকদের প্রতি হুমকির বিষয়টি নয়াদিল্লি এবং অটোয়া কঠোরভাবে হাতে নিয়েছে। 

এরই মধ্যে অভিযোগ ওঠে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো শিখ সম্প্রদায়ের  ভোটের ওপর নির্ভর করছেন। এ জন্য তিনি শিথিল অবস্থান নিয়েছেন। এ অভিযোগ ট্রুডো প্রত্যাখ্যান করেন ৬ই জুলাই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গুরুতর সহিংসতা ও সহিংসতার হুমকিকে সবসময়ই কঠোরভাবে নেয় কানাডা। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের গুরুতর অ্যাকশন এবং তা অব্যাহত থাকবে। 
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর মধ্যে নয়াদিল্লিতে ১০ই সেপ্টেম্বর জি-২০ সম্মেলনের এক ফাঁকে বৈঠক হয়। এ সম্পর্কে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি- কানাডায় ভারতবিরোধী উগ্রপন্থিদের অব্যাহত তৎপরতা নিয়ে কঠোর উদ্বেগ জানিয়েছেন তিনি (মোদি)। তারা বিচ্ছিন্নতাবাদকে উৎসাহিত করছেন। ভারতীয় কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় উস্কানি দেয়া হচ্ছে। কূটনৈতিক স্থাপনার ক্ষতি করা হচ্ছে। কানাডায় ভারতীয় সম্প্রদায়কে হুমকি দেয়া হচ্ছে। এদের সংঘটিত অপরাধ, ড্রাগ সিন্ডিকেট, মানব পাচারের বিষয়ে কানাডার সচেতন হওয়া উচিত। এমন হুমকির বিষয়ে উভয় দেশের সহযোগিতা প্রয়োজন। 
অন্যদিকে উগ্রপন্থা এবং কানাডায় বিদেশি হস্তক্ষেপের বিষয়ে নয়াদিল্লিতে সাংবাদিকদের ট্রুডো বলেন- আলোচনায় দুটি ইস্যুই উঠেছিল। কানাডা সব সময় মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বিবেকের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের স্বাধীনতার পক্ষে থাকবে। আমাদের কাছে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সহিংসতার বিরুদ্ধে আমরা সব সময়। ঘৃণার বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান।  কিন্তু দেশে ফিরে গিয়ে ১৯শে সেপ্টেম্বর হাউজ অব কমন্সে ট্রুডো ভারত সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ আনেন। বলেন, হরদিপ সিং নিজার হত্যায় ভারত সরকার এবং ‘র’ জড়িত। এ বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রমাণ আছে। শুরু হয় উত্তেজনা। এতদিন ভেতরে ভেতরে থাকলেও সেই উত্তেজনা যেন বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমদিকে বিষয়টি দুই দেশের সরকারের ভেতরকার ইস্যু হলেও তা এখন সারা বিশ্বের কাছে পৌঁছে গেছে। এ বিষয়ে পাকিস্তান কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। তারা বলেছে, ভারত সন্ত্রাসী রাষ্ট্র তা আরও একবার বিশ্বের কাছে প্রমাণিত হলো। এমন মন্তব্য করছেন বড় বড় নেতারা। এখন এই সংকটের সমাধান কোথায়- নাকি ভারত-কানাডার সম্পর্কের ফাটল আরও বাড়বে তা বলা কঠিন। তবে এই মুহূর্তে যা মনে হচ্ছে, তাতে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান খুব কঠিন হবে।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

১০

স্বপ্নের স্বদেশের সন্ধানে/ তফসিল ঘোষণা- এরপর কি সব সমাধানের সুযোগ শেষ?

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2023
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status